বায়ো প্লাস্টিকঃ নতুন যুগের প্লাস্টিক

0

আমরা সোনা, ব্রোঞ্জ,তামা,লোহা কিংবা স্টিল যুগ পার হয়ে বর্তমানে এমন যুগে বাস করছি যাকে প্লাস্টিক যুগ বলা যেতেই পারে । ঘরে বাইরে আসবাবপত্র কিংবা খেলনা-যন্ত্রপাতিতে বা গাড়ি – উড়োজাহাজের বিভিন্ন অংশ, ল্যাবরেটরির বিভিন্ন কাজে দেখা যায় প্লাস্টিকজাত সামগ্রীর বহুল ব্যবহার । প্লাস্টিকের এই ব্যবহারের কারণ হলো এটিকে যেকোনো আকৃতির দেয়া যায়, রাসায়নিকভাবে উচ্চ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কমবেশি নমনীয়তার গুন থাকা ।

এসব ধর্মাবলীর জন্যই ঘরে বাইরের বিভিন্ন কাজে প্লাস্টিক ব্যবহার সমাদৃত হয়ে আসছে । তবে প্লাস্টিক জাতীয় বস্তু ব্যবহারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এদের উচ্চ আণবিক ওজন থাকা (প্রায় ১,৫০,০০০ ডাল্টন পর্যন্ত)। এই কারণে এরা জীবজভাবে সহজে ভেঙে যায় না এবং মাটিতে বেশ কিছুদিন জমে থাকতে পারে । প্লাস্টিক আবিষ্কারের সূচনাকালে বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন তেল, কয়লা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক হাইড্রোকার্বন পরিবর্তিত করে এক অন্য বস্তু বানানো যায় জেসব বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হতে পারে । এর ফলস্বরুপ আবিষ্কৃত হয় নানাধরনের প্লাস্টিক যেমন ক্যামিন, ব্যাকেলাইট, পলিথিন, সেলোফেন, পিভিসি ইত্যাদি ।

প্লাস্টিক শিল্পে ব্যবহৃত কাচামাল হলো মূলত পেট্রোলিয়ামজাতীয় বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন যেমন মিথেন, ইথেন, এসিটিলিন প্রভৃতি । তাই বলা যায় প্লাস্টিক শিল্প ছিলো এতোদিন সম্পূর্ন খনিজ তেল নির্ভর । বর্তমানে সারা বিশ্বে প্লাস্টিক উৎপাদন হয় ৪,০০,০০ টন, যা প্রমাণ করে বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিকের চাহিদা । পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন সারাবিশ্বে প্লাস্টিক শিল্পে ব্যবহৃত হয় প্রায় নয় মিলিয়ন ব্যারেল পেট্রোলিয়াম । যেহেতু বিশ্বে পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির সঞ্চয় সীমিত, তাই প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন বিকল্প কোন কাঁচামালের । তাছাড়া অব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রী পরিবেশে বিয়োজিত হতে অনেক সময় নেওয়ায় বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণের সম্ভাবনা থাকে, গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হয়– যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো ভয়ংকর ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে ।

বায়ো প্লাস্টিক
               বায়ো প্লাস্টিক চক্র

তাই এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে প্লাস্টিক শিল্পে কোন বিকল্প কাচামাল ব্যবহার করা, যা হবে কৃষি বা উদ্ভিদজাতীয় এবং সহজেই পরিবেশে দ্রুত বিয়োজিত হয়ে যাবে। এটাকেই বলা হচ্ছে বায়ো প্লাস্টিক বা জৈব প্লাস্টিক। যেহেতু উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বৃদ্ধি পায়, সেহেতু জৈব প্লাস্টিকের দহনে উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলের ভারসাম্য পরিবর্তন করবে না । তাই বিজ্ঞানীরা আগামীর সবুজ পৃথিবীর জন্য পছন্দ করেছেন বায়ো প্লাস্টিক বা জৈব প্লাস্টিককে। জৈব প্লাস্টিক হলো এক নতুন প্রজন্মের প্লাস্টিক যা প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হতে পারে আলু, ভুট্টা, ট্যাপিওকা, আখ, সয়াপ্রোটিন, ল্যাকটিক এসিড ইত্যাদি। পেট্রোলিয়ামের পরিবর্তে এসব জৈব উপাদান ব্যবহারের সুবিধা হলো এদের সহজলভ্যতা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা । জৈব প্লাস্টিক পরিত্যাক্ত অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রভৃতি আণুবীক্ষণিক জীবের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সহজেই কার্বন ডাই অক্সাইড, পানি ও জৈব পদার্থে পরিণত হয় । এভাবে প্রাপ্ত জৈব পদার্থ সার হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে । এই জৈব প্লাস্টিক পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় প্লাস্টিক শিল্প এখন নতুন দিকে মোড় নিয়েছে । বর্তমানে জৈব প্লাস্টিক শুধু ব্যাগই নয়, কৃত্রিম তন্তু, চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যবহৃত বস্তু, বাড়িঘর নির্মান কাজের সামগ্রী, আসবাবপত্র প্রভৃতি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ।

সমগ্র বিশ্বে জাপানের টয়োটা মটর কর্পোরেশন প্রথম জৈব প্লাস্টিক ব্যবহারের কৃতিত্বের দাবিদার । তাদের “রম” নামক মডেলের গাড়ির টায়ারের চাকা হিসেবে যে জৈব প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে তা মিষ্টি আলু এবং আখ থেকে প্রস্তুত । টয়োটা কোম্পানিতে প্রস্তুত জৈব প্লাস্টিক শুধু গাড়ির বিভিন্ন অংশ হিসেবেই ব্যবহৃত হয় না, নিয়মিতভাবে তাদের একটি কারখানায় প্রায় এক হাজার টন জৈব প্লাস্টিক উৎপাদিত হয় যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় । জাপানের মিৎসুবিশি কোম্পানি উচ্চ তাপমাত্রা সহনশীল এবং বেশি কাঠিন্যজুক্ত জৈব প্লাস্টিকের উৎপাদন করছে, যা সনি কর্পোরেশন তাদের কিছু ওয়াকম্যান তৈরিতে ব্যবহার করছে । আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের মেটাবলিক্স নামক কোম্পানি বৃহদাকারে প্রস্তুত করতে চলেছে “মিরেল” নামক এমন এক জৈব প্লাস্টিক যা তৈরি করতে শুধু প্রয়োজন হয় ব্যাকটেরিয়া, ভুট্টা এবং বায়ুর ।

এসব কোম্পানি মূলত বায়োডিগ্রেডেবল ম্যাটেরিয়ালস দ্বারা প্লাস্টিক প্রস্তুত করতে মনযোগী হয়েছে যেসব প্লাস্টিক ব্যাকটেরিয়া বা যেকোনো আণুবীক্ষণিক জীব দ্বারা সহজে ভেঙে মাটিতে দ্রুত মিশে যায় । বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই উদ্ভিদ বা উদ্ভিতজাত বস্তু যেমন বাঁশ, তন্তু, দানাশস্যের তুষ, আঠা প্রভৃতিকে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন বায়ো প্লাস্টিকে পরিবর্তিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যা হবে সুলভ এবং ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তাযুক্ত । আশা করা যায় এই ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা ও আধুনিক প্রযুক্তি অধিগ্রহণের ফলে জৈব প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ক্রমশই বৃদ্ধি পাবে । আর আমরা আগামীর সবুজ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবো আরও দ্রুত, এই নতুন জৈব প্লাস্টিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ।

লেখাঃ রিদওয়ান উর রাহমান

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে