বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ভিডিও এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্টে অসামঞ্জস্যতা!

0

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বরে বিরোধীদলের অবরোধ কর্মসূচি ঠেকাতে সরকারি দলের অন্যতম প্রধান ও সক্রিয় সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগও মাঠে অবস্থান করছিলো। ঐদিন শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পুরনো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকেই কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় বিশ্বজিৎ দাসকে। কিছু ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী দ্বারা সংঘটিত এই হত্যার ঘটনাটি ঘটে একাধিক সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনেই। বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনের চ্যানেলে এই হত্যাকাণ্ডের যে ফুটেজ দেখানো হয় তার সঙ্গে একেবারেই বেমানান এই হত্যা মামলায় আদালতে দায়ের করা বিশ্বজিৎ-এর মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন।

এ নিয়ে স্বয়ং মামলার বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে মামলার সংশ্লিষ্ঠ এসআই এবং চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলা ছিলো কিনা তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন। সাংবাদিকদের ভিডিও ফুটেজের একটিতে দেখা গেছে, বিশ্বজিৎকে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার বারান্দায় বেশ ক’জন মিলে এলোপাথারি আঘাত করে যাচ্ছে। কারও হাতে ছিলো ধারালো অস্ত্র, কারও হাতে চাপাতি, কারও হাতে কাঠের টুকরা আবার কারও হাতে রড। তারা সবাই বিশ্বজিৎকে ঘিরে ধরে আঘাত করছিল। এসময় বিশ্বজিৎ কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কোনও আঘাতকারী সেদিকে লক্ষপাত না করেই আঘাত করা অব্যাহত রেখেছিলো।এমনটাই ভেসে উঠেছে ভিডিও ফুটেজে। হামলাকারীদের একজনের শরীরে শার্টের ওপর হাতাকাটা সুয়েটার, একজনের শরীরে কালো রঙের শার্ট, একাধিক ব্যক্তিকে সাদা রঙের জামা ও দুইজনকে লাল রঙের শার্ট পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে। দ্বিতীয় তলায় বিশ্বজিৎকে ৭-৮ জন মিলে যখন আঘাত করছিল তখন সে পালিয়ে বাঁচতে চেস্টা করাতেও ব্যর্থ হয়,চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরে আঘাত করতে থাকে। এসময় অনেককে কিল ঘুষিও মারতে দেখা গেছে। কয়েকজন হামলাকারীকে দেখা গেছে বিশ্বজিৎকে ধাক্কা মেরে ভেতরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। একপর্যায়ে বিশ্বজিৎ ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে চলে যান। তখন আর কিছু দেখা যায়নি।

বিশ্বজিৎ কে কোপানোর দৃশ্য

এরপর আরেকটি ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিৎকে প্রথমে যে মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আঘাত করা হয়েছিল তার সামনে নিচতলায় রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। ওইসময়ের ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, বিশ্বজিৎ তখন রক্তাক্ত। দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে দৌড়ে নামছেন। তাকে ধাওয়া করছে বেশ কয়েকজন যুবক। এরপর আবারও তারা বিশ্বজিৎকে ঘিরে ধরে মারতে থাকে। হামলাকারীদের প্রত্যেকের হাতেই রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দেখা গেছে। আরেকটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, দোতলায় যখন বিশ্বজিৎকে আঘাত করা হচ্ছে তখন রাস্তায় দাঁড়ানো অনেক মানুষ ছিলো। এদের কেউ কেউ ছেলেটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চিৎকার করছেন। তাদের সঙ্গে আশপাশ থেকে ভেসে আসছে আরও অনেক হইহুল্লোড়,তবু সেদিকে কোনো আঘাতকারীর ভ্রুক্ষেপ ছিলোনা। অপর একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, শার্টের বোতাম খোলা এক যুবক বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে, যার পরনের শার্টের বাম পাশের বুক পকেটের ওপর লাল রক্তের ছোপ। পরবর্তীতে ওই যুবককে রফিকুল ইসলাম শাকিল ওরফে চাপাতি শাকিল হিসাবে শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বজিতের রক্ত নিয়েই ক্যামেরার সামনে দিয়ে তাকে চলে যেতে দেখা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থির চিত্রেও রড, লাঠি দিয়ে পেটানো ও চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য দেখা গেছে।

আশ্চর্যের বিষয়, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা এসব ভিডিও চিত্রে বিশ্বজিতের ওপর এমন নৃশংস হামলার দৃশ্য দেখা গেলেও তার মৃত্যুর পর মিডফোর্ড হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক বিশ্বজিতের মরদেহে এসব রড-লাঠি-ধারালো অস্ত্রের কোনও আঘাত খুঁজে পাননি। ধরা পড়েনি কিল-ঘুষি ও লাথির জখমও। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মাকসুদুর রহমান বিশ্বজিৎ-এর শরীরে ধারালো অস্ত্রের মাত্র একটি আঘাত উল্লেখ করেছিলেন। রিপোর্ট নম্বর ৪৬৭/১২। রিপোর্ট তৈরির তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর/২০১২। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, পিঠের ডান পাশে ৩ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও দেড় ইঞ্চি প্রস্থের একটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বাম পা থেঁতলে গেছে। মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। এর বাইরে আর কোনও তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গেও মেলেনি ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন। লাশের সুরতহাল তৈরিকারী পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বজিতের শরীরে ২৫-২৬ টি আঘাতের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন। রক্তাক্ত ক্ষত স্থানসহ অসংখ্য ফোলা-জখমের দাগ ছিল লাশের দেহে বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

এদিকে, ময়নাতদন্তের সময় লাশ কাটায় নিয়োজিত কর্মচারীরা (ডোম) বিশ্বজিৎ-এর শরীরে পৃথক অস্ত্রের পৃথক আঘাত শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকের চূড়ান্ত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে তা আর উঠে আসেনি। ফলে এ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর সেসময়ে ময়নাতদন্তে তথ্য গোপনের অভিযোগও উঠেছিল গণমাধ্যমে। আজ আদালতের রায়ে ভিডিও ও স্থিরচিত্রগুলোর সঙ্গে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের মিল নেই এমন পর্যবেক্ষণের পর এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বজিতের মরদেহের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. মাকসুদুর রহমান কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে, মামলাটির দুর্বলতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার তদারকি কর্মকর্তা ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালের চিকিৎসকরা যে ধরনের প্রতিবেদন দেন তার বাইরে তদন্ত কর্মকর্তাদের কিছু করার থাকে না। উনারা যেটা দিয়েছেন সেটাই উল্লেখ করা হয়েছে।’

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে