কখনও ভেবে দেখেছেন মানুষকে কেন শ্রেষ্ট জাতি বলা হয়?
অনেক প্রাণী আছে দেখতে প্রায় মানুষের মত, অনেকে আবার অনেক বুদ্ধিমান, অনেকেই অনেক সুন্দর, পৃথিবীতে টিকে থাকার বিচারে বিবেচনা করলে অনেক প্রাণী আছে যারা সর্বদা একতাবদ্ধ এবং অনুগত। তবুও মানুষ শ্রেষ্ট!
দৈহিক সৌন্দর্য ছাড়া আর কী আছে যেটা অন্যান্য জীব থেকে আমাদেরকে আলাদা এবং উন্নত করেছে?
আমি যদি বলি আবেগ ও অনুভূতি মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে তাহলে বিশ্বাস করবেন? হয়ত একটু কষ্ট হবে। কারণ মানুষ তাদের সৃষ্টি থেকে যেসকল অমঙ্গল ও অনুচিত কাজ করে এসেছে তার প্রায় সব ই আবেগের বশীভূত হয়ে করেছে।
এবার যদি বলি মানুষকে মর্যাদাবান করা হয়েছে তাদের বিবেক,বিবেচনা এবং সুষ্টু বিচারের ক্ষমতার জন্য তাহলে নিশ্চয়ই অমত পোষণ করবেন না!
সূক্ষভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিবেচনা ও সুষ্টু বিচার মূলত আবেগ দ্বারা কোন বিষয়কে নিরিক্ষণের ফল।
বেশীরভাগ সময় আমাদেরই আবেগ আমাদেরকে দুর্বল বানিয়ে দেয় সেজন্যই হয়ত আবেগ এবং অনুভূতির ব্যাপারে আমাদের এত নেতিবাচক ধারনা। আসলে সেটা নিতান্তই আমাদের অপারগতা। জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা সামাজিকভাবে এত শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে বসবাস করছি সেটা শুধুমাত্র এই আবেগের দ্বারাই।
অনুভূতির অনেক শাখা প্রশাখা থাকলেও মূলে গিয়ে ‘ভাল লাগা’এবং ‘খারাপ লাগা/বিষন্নতা’ এই দুটোকেই পাওয়া যায়।
মন ভাল থাকলে আমরা হাসি আর খুব খারাপ থাকলে কাঁদি!
ফুরফুরে মেজাজে থাকা কিংবা হাসিমুখে মানুষের সাথে কথা বলা সব সবসময়ই প্রশংসিত। ধারণাগুলো এমন যে সবাইকে সব সময় হাসিখুশি থাকতে হবে, সবার সাথে ভালো করে কথা বলতে হবে। আর সবার কাজ থেকে শুরু অরে সবকিছু এই ভাল থাকার উপলক্ষেই হতে হবে।
অপরপক্ষে মন খারাপ থাকাটা সমাজে সবার কাছে বর্জনীয়। মন খারাপ থাকা মানেই মানুষটি সুখে নেই অথবা অন্যসবার থেকে আলাদা। সচরাচর আমরা এটাই বুঝে থাকি। এমনকি অনেকেই মন খারাপ থাকাকে ‘সমস্যা জর্জরিত অনুভূতি’ হিসেবেও নামকরণ করেছেন। অবশ্যই এরকম মনোভাব মুছে ফেলা প্রয়োজন।
কেন প্রয়োজন সেটা আমি বলছি।
এখন কিছু বিষয় খন্ডন করবো যার মাধ্যমে বিষন্নতায় আমাদের উপকারী অনুভূতি হতে পারে ।
* বিষণ্ণতা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে!
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ,
একটা বৃষ্টি ভেজা বিষন্ন একটি দিনে মানুষ কোন দোকানে গেলে সেই দোকানে কাটানো সময় ও দেখে আসা জিনিসগুলো অনেকটা বিস্তারিত মনে থাকে ।
অপরদিকে একটা আলোকিত ও সুন্দর দিনে মানুষ যখন ভালো অনুভব করে তখন সেই দোকানে গেলে সেখানে ঘুরে আসা বৃষ্টির দিনের তুলনায় কম বিস্তারিত মনে করতে পারে। গবেষণাটিতে একাধিক মানুষকে নিয়ে এটা পরিক্ষা করা হয়েছিল।
অতএব দেখা যায় আমাদের পরিবেশের আনুষঙ্গিক অবস্থাগুলোর বিস্তারিত মনোযোগ ‘ভালো অনুভূতি’ কমিয়ে দেয় এবং ‘বিষণ্নতা’ সেটা বাড়িয়ে দেয়।
আরেকটা নিরীক্ষায়,
কয়েকজন উপস্থিতিকে একটি কার দুর্ঘটনার ছবি এবং এবং একটি বিয়ের ছবি দেখার জন্য দেওয়া হয়।
তারপর তাদেরকে অতীতের কিছু ভালো ও খারাপ স্মৃতি মনে করে শুনাতে বলা হয় ,তাদের মেজাজ পরিবর্তন করার জন্য।
এর ফলে দেখা যায় অনেকেই বিষণ্ণ হয়ে গেছে আবার অনেকেই ভালো স্মৃতি মনে করে খুশী হয়েছে।
তাদেরকে তখন ছবির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। “ঐ ছবিতে কোন‘থামুন’ চিহ্ন ছিলো কী না?”। আসলে ছবিতে এরকম কোন চিহ্ন ছিল না বরং একটা ‘আশ্চর্যবোধক’ চিহ্ন ছিলো।
সবাই উত্তর দেওয়ার পর দেখা যায় খুশী থাকা মানুষের তুলনায় মন খারাপ করা মানুষেরা সঠিক উত্তর ও ভালো বর্ণনা দিয়েছিলো।
সাধারনভাবে আমরা দেখি, যখন আমরা মন খারাপ করে বসে থাকি তখন ফেলে আসা কোন দিনের বা বিশেষ কোন সময়ের কথা স্পষ্টভাবে মনে ভাসে। পুরোটাই জীবন্ত লাগে, সময়গুলো আবার ফিরে পাওয়ার ইচ্ছাও হয়। কিন্তু মন ভাল থাকলে স্মৃতি আমাদের খুব কমই মনে পড়ে!
ফুরফুরে মেজাজে থাকা অবশ্যই আমাদেরকে চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনায় মনোযোগী করে এবং বিষণ্নতা সেগুলোগে স্মৃতিতে ভালোভাবে ধরে রাখতে সাহায্য করে!
* বিষণ্নতা বিচার জ্ঞানের উন্নতি সাধন করে!
মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবেশের নানা বিষয় নিয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে । এটা এরকম না হলেও পারত, সেটা অন্যরকম হলেও পারত। কত জনের কত বিচার বিশ্লেষণ!
দুর্ভাগ্যবশত এরকম মতবাদ প্রায়ই ভিত্তিহীন হয়ে থাকে। কারণ সমাজে স্বার্থপর এবং পক্ষপাতী মানুষের আদিক্যই বেশী।
বরাবরই দেখা যায় মানুষ যখন সুখে থাকে তখন পক্ষপাতী হয়ে যেকোন বিষয়কে অপূর্ণমূল্যায়ন করে বসে।
একটা গবেষণায় বিষণ্ণ ও খুশী মানুষকে একটা ভিডিও ফুটেজ থেকে প্রতারককে শনাক্ত করার কথা বলা হয়। ফুটেজটিতে একটি চুরির দৃশ্যে আটককৃত একজনকে দেখানো হচ্ছিলো। (সে চুর কী না সেটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো না।)
খারাপ মেজাজে থাকা মানুষরা নেতিবাচক মন্থব্যের সম্ভাবনা বেশী করলো। যদিও তারা উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতারণা ও সত্যের পার্থক্য ভালোভাবে করেছিলো।
আরেকটা পরীক্ষায় কিছু মানুষকে ২৫টি সত্য ও ২৫টি মিথ্যা ছোট ছোট বিবৃতিতে নিজের মতামত অনুযায়ী শনাক্ত করতে বলা হয়েছিলো।
তারপরে সবাইকে বলা হয়েছিলো যে আসলে সবগুলো বিবৃতিই সত্য ছিলো !
দুই সপ্তাহ পরে আবার ঐ কাজটি আবার করতে দিলে খুশ মেজাজে থেকে শনাক্তকারীরা প্রায় সবগুলোকেই সত্য বলে।
কিন্তু বিষণ্ণ থাকা মানুষেরা কোনগুলো তারা সত্য বলেছিলো এবং কোনগুলো মিথ্যা তা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলো।
‘যেটা পরিচিত সেটা সত্য’ এরকম ভাবণার যে প্রবনতা সেটা সুখী মানুষ থেকে মন খারাপ করে থাকা মানুষের মধ্যে কম।
মন খারাপ করে থাকা বা বিষণ্নতা সাধারন প্রচলিত অনেক গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। যেমন একজন সুদর্শন মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও উদারতার মত গুণাগুণ থাকবেই!
এই ধরণের চিন্তাকে ইংলিশে ‘halo effects’ বা ‘বর্ণবলয় প্রভাব’ বলে। অর্থাৎ এটা থাকলে সেটাও থাকবে এরকম ভাবীকথন।
বিষণ্ণতা ‘primacy effects’ নামে আরেকটা প্রভাব থেকে মুক্তি দিতে পারে । যেটা হচ্ছে প্রথম কিছু অংশে মনোযোগ দেওয়া এবং পরের অংশগুলো অগ্রাহ্য করা।
এই সমস্যায় সব থেকে বেশী আচ্ছন্ন আমাদের প্রাইমারী স্কুলের খুশ মেজাজী শিক্ষকগন!
* বিষণ্নতা আপনাকে মোটিভেট করতে পারে!
আমরা যখন ভালো থাকি তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা এই ভালো থাকাটাই ধরে রাখতে চাই।
আর এই ভালো থাকাটা আমাদেরকে বুঝায় যে আমরা নিরাপদ ও আশানুরূপ অবস্থানে আছি। যেকোনো সময় আমরা ইচ্ছা করলেই কিছু একটা করে নিতে পারবো। স্বভাবতই নিজের মধ্যে একটা বাড়তি শক্তির সঞ্চার হয়!
বিষণ্নতা, অপরপক্ষে, একটা হালকা বিপদশঙ্কার বিপদসংকেত হিসেবে সব সময় কাজ করে । সবসময় বোধ করায় যে আমরা কোন কিছুর জন্য উপযুক্ত না বা আআদের বরতমান অবস্থা সময় ও পরিবেশের সাথে মানানসই নয়। আর এটাই এক সময় নিজেকে প্রমান করার জন্য আরও পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় করার মোটিভেটর রূপে কাজ করে।
এই বিষয়ে একটা পরিদর্শনের জন্য কিছু মানুষকে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয়। প্রশ্নগুলো একটু চিন্তা করে দেওয়ার মত কঠিন ছিলো। দেলহা গেল ফুরফুরে মেজাজে থাকা উপস্থিতিরা খুব কম সময়ে সবগুলো উত্তর দিয়ে দিলো কিন্তু যারা অতটা উৎফুল্ল ছিলো না তারা অনেক চিন্তা করলো এবং উত্তর দিতে অনেক সময় নিলো।
হিসেব করে দেখা গেলো যারা কম সময়ে কিছু না ভেবেই উত্তর দিয়েছিলো তাদের প্রায় উত্তরই ভুল!
কিন্তু যারা উত্তর খুঁজতে মাথা খাটিয়েছিলো তাদের প্রশ্নেরগুলো সঠিক!
এতে বুঝা যায় একজন সুখী মানুষ নিজের অবস্থান নিয়ে তুষ্ট। নতুন কিছু করে দেখানোর প্রত্যয় নেই তাদের মাঝে।
কিন্তু অপরদিকে বিষ্ণনতায় আবিষ্ট মানুষরা উদ্যমী।
*বিষণ্নতা কিছু ক্ষেত্রে ভালো স্বভাব গঠনে সাহায্য করে!
সাধারনত একজন সুখী মানুষ সব সময় হাসিখুশি এবং ফুর্তিতে থাকে। সবার শাথে হেসে কথা বলে। তারা ভালো সংবাদদাতা ভালো কথাসাথী এবং বন্ধুভাবাপূর্ণ হয়ে থাকে বিষণ্ণ মানুষের চেয়ে।
একটা গবেষণায় কয়েকজন খুশী মানুষকে পাশের একেকটা অফিস থেকে একটা করে নির্দিষ্ট ফাইল আনতে বলা হয়। তাদেরকে না জানিয়ে গোপনে কাজগুলো গোপনে ভিডিও করা হচ্ছিলো । তারা গন্থব্যে গিয়ে সরাসরি ফাইলটা চায় এবং নিয়ে আসে।
এই কাজই কিছু বিষণ্ন মানুষকে করতে দিলে তারা অফিসে যায় এবং খুব সাধারণ ও বিনিয়ের স্বরে কথা বলে, ফাইলটা সে নিলে কোন সমস্যা হবে কী না সেটা জিজ্ঞেস করে তারপর ফাইল নিয়ে আসে।
পরে লক্ষ্য করে দেখা যায় খুশী মানুষরা তুলনামূলক খোলাখুলি তাদের কাজে। যেখানে বিষণ্ণ মানুষরা যথেষ্ট বিনয়ী এবং অনুগত ।
আমরা সাধারনত খুশী থাকি তখন অন্যের মতামত বা ধারণার তোয়াক্কা করিনা। নিজের কাজে অন্যের মতামতের দাম দেওয়াটা অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আত্মতুষ্টিতে ভোগার ফলে মানুষ অনেক অনৈতিক কাজ করে বসে।
পরে বলে আমার জীবন আমার ইচ্ছা,কে কী বলবে!
এক্ষেত্রে মন খারাপ থাকলে বা কোন বিষয় নিয়ে আমরা আবিষ্ট থাকলে অন্যের মতামত জানতে চাই এবং সেটার গুরুত্ব দেই। যার মাধ্যমে সামাজিকতার মাত্রাই শুধু বহাল থাকেনা বরং মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়।
আবেগের তাড়নায় অথবা জীবনের ধারাবাহিকতায় আমরা ভালো বা খারাপ থাকি। বেঁচে থাকার অমূল্য সুখ নিয়ে আমরা খুব সহজেই ভালো থাকতে পারি। খারাপ থাকাটা অস্থিতিশীল অবস্থা মাত্র।
খারাপ থাকাটাও একটা অনুভূতি। এটাকে খুব সহজ রূপে দেখে এর থেকেই আমরা আমাদের অনেক উপকার পেতে পারি খুব সহজেই। পাল্টানো দরকার শুধু আমাদের দৃষ্টিকোণ।
-এ এস এম মিজানুর রহমান