মমিফিকেশন বা মমিকরণঃ লাশের মমি করার প্রক্রিয়া (শেষ পর্ব)

0

সেই প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর সিংহভাগ রহস্য যেন মিশরেই লুকায়িত! পৃথিবীর অগ্রগতির পেছনে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদানও আছে । এইসব রহস্যের সবচেয়ে বড় রহস্য পিরামিড ও এর অভ্যন্তরের হাজার বছরের পুরনো মমি। কিভাবে মমিফিকেশন করা হত সেটা পাঠক জানাতে মমিফিকেশন বা মমি করার প্রক্রিয়া নিয়ে এর দুই ধাপ এর প্রথম পর্বে   মমিফিকেশন এর প্রথম ধাপ Embalming বা দেহকে পরিস্কার করা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।  যারা প্রথম পর্ব পরেন নি তারা এই লিংকে গিয়ে পড়ে নিতে পারেন।

মমিফিকেশন বা মমিকরণঃ লাশের মমি করার প্রক্রিয়া (Embalming  বা যত্নসহকারে ও সুগন্ধীর দ্বারা দেহকে পরিষ্কার করা)

আজ ২য় ধাপ Wrapping বা দেহকে দামী কাপড়‌ দিয়ে মুড়িয়ে সমাধিস্ত করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানবো!

Wrapping- (Wrapping & Burial process) :

১‌. এই ধাপে প্রথমত মাথা এবং ঘাড় আলাদাভাবে অতি উন্নত লিলেন কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয় । সেই‌ সাথে আঙ্গুল এবং পায়ের পাতাও আলাদাভাবে মোড়ানো হয় ।

২. এই ভাগে এসে হাত ও পা দ্বয় আলাদাভাবে ভালো করে মুড়িয়ে ফেলা‌ হয় এবং Embalmers রা এই পরতের উপর দুটি আলাদা ভিন্ন ভিন্ন কবচ রেখে দেন, যাদেরকে আমরা (amulets) বলে থাকি । এই ভাগে পুরোহিতরা দুটি ভিন্ন ধরনের অ্যামুলেটস্ ব্যাবহার করেন । একটি হচ্ছে আইসিস নট (Isis knot), যার কাজ হচ্ছে দেহকে যেকোন ধরনের ক্ষতি হতে রক্ষা করা । আরেকটি হচ্ছে প্লামমেট (Plummet), যার কাজ হচ্ছে মৃতদেহকে পরবর্তী জীবনের জীবন উপভোগ ও সামজ্ঞস্য বজায় রাখতে সাহায্য করা।

মমি
মোড়ানো হচ্ছে লাশ

৩. এই‌ ধাপে‌ মৃতের শরীরে যখন লিলেন এর আরেকটি পরত মোড়ানো হতে থাকে তখন, প্রধান পুরোহিত দেবতা আনুবিস এর মুখোশ পরিধান‌ করে মৃতদেহের মাথার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে “বুক অব ডেথ” এ উদ্বৃত মন্ত্র পড়তে থাকেন । যা‌ কিনা মৃতদেহ থেকে খারাপ ও অশুভ আত্নাদের দুরে রাখতে সাহায্য করে । এবং মৃতব্যাক্তির তার পরবর্তী জীবনের জন্য ভ্রমন এ সহায়তা করে । ৪.এই ধাপে হাত ও পা দ্বয়কে একসাথে বেধে ফেলা হয় এবং একটা “প্যাপিরাস স্ক্রল” যাতে কিনা “বুক অব ডেথ” থেকে নেয়া উদ্বৃতি আছে তা দুই হাতের মাঝে রেখে দেয়া হয় । “প্যাপিরাস স্ক্রোল” বা “Pupyrus Scroll ” হচ্ছে Pupyrus নামক একধরনের নলখাগড়া জাতীয় গাছ দিয়ে তৈরী কাগজ যা তৎকালীন অনেক উন্নতমানের লেখার কাগজ হিসেবে ব্যাবহৃত হতো এবং এই কাগজ কে গুটিয়ে Scroll করে রাখা হত ।

৫. এই ধাপে‌ মৃতদেহকে এবার ভালোভাবে অনেকগুলো লিলেন এর পরতে মুড়িয়ে ফেলা হত । প্রতিটি পরতে মাঝে (রেজিন বা Resin) নামক বিশেষ গাছপালা থেকে তৈরী আঠালো গ্লু ব্যাবহার করা হতো । এই রেজিন শুকিয়ে গিয়ে মৃতদেহে বাতাস বাতাস প্রবেশ এ বাধা দিতো । সেই সাথে রেজিন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমনেও বাধা দিতো । ফলে মৃতদেহ পচার কোন সুযোগই সৃষ্টি হতো না ।

৬. এবার উন্নতমানের কাপড় দিয়ে দেহকে মুড়িয়ে দেয়া হতো যার উপর দেবতা “অসেরিস” এর ছবি অঙ্কিত থাকতো ।

৭. এবার মৃতদেহকে আরেকটি বড় কাপড়ে মুড়িয়ে তার উপর থেকে নিচে, বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে, মাঝ বরাবর লিলেন এর তৈরী দড়ি দিয়ে দেহকে ভালোভাবে বেধে ফেলা হয় । এরপর মৃতদেহের মুখ একটা কাঠের তৈরী তার মুখোবয়ব অঙ্কিত ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় । রাজাদের ক্ষেত্রে সেটা বেশিরভাগ সময়ই সোনার হতো । এর উপর আরেকটা ঢাকনা রেখে মৃতদেহকে একটা কফিনে শুইয়ে দেয়া হতো । এই‌ কফিন কখনও কাঠের কখনো সোনার তৈরী হতো । এবার মৃতদেহের উদ্দেশ্য শুরু হতো ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠান ।

মমি
মৃতদেহকে একটা কাঠের তৈরী তার মুখোবয়ব অঙ্কিত ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়

৮. মৃতদেহের জন্য দুটি অনুষ্ঠান পালন হতো সবসময়ই । যতবড় রাজা তার ইচ্ছের উপর ভিত্তি করে আচার ও অনুষ্ঠান বাড়তো । অবশ্য পালনীয় প্রথম অনুষ্ঠানে‌ মৃতের আত্নীয় স্বজনরা তার জন্য শোক জানাতো । কফিনের পাশে বসে গান গেয়ে ও আহাজারি করে ।

৯. এরপর মৃতদেহের উদ্দেশ্য আরেকটি ধর্মীয় আচার পালন করা হতো । একে বলা হতো “Opening of the mouth”… এর দ্বারা লোকে বিশ্বাস করতো মৃতদেহ আবার খেতে ও পানীয় গ্রহন করার শক্তি লাভ করবে । এবার মৃতদেহ প্রস্তুত তার অনন্ত জীবনের দিকে যাত্রা শুরু করার এবং একই‌ সাথে ৭০ দিন ধরে ফারাও জন্য আগেই তৈরী করে‌ রাখা সমাধি ক্ষেত্রে (যেমনঃ পিরামিড অথবা ভ্যালি অব কিংসের চেম্বারগুলো) তে “বুক অব ডেথ” থেকে বিভিন্ন উদৃতি খোদাই করা কাজ শেষ হয়ে যায় । খোদাইকৃত স্থানগুলোতে মৃত্যুর পর “ফারাও” কিভাবে পরজগতে যাবেন সেই রাস্তা খোদিত হয় এবং ফারাও এর জীবনের বিভিন্ন কর্মকান্ড, সাহসীকতা ও বীরগাথা খোদিত হয় ।

দুই পর্বে এই পুরো মমিফিকেশন প্রসেস ৭০ দিনে শেষ হয় । এখানে উল্লেখ্য যে, মৃতদেহের স্থান নির্বাচন আর তার নির্মান একজন রাজা সিংহাসনে আসীন হওয়া মাত্রই শুরু হয়ে যায় । সবকিছু নির্মান চলে তার শাসনকলীন সময়েই । সোনা গলিয়ে পরজগতে ব্যাবহৃত জিনিস পত্র আর বীরগাথা কিছু কিছু খোদিত হওয়া বাকি থাকে । রাজা মারা যাবার পর তার মমি তৈরী পর্যন্ত এই‌ ৭০‌দিনে বাকি কাজ শেষ করে‌ ফেলতে হত । শেষ যাত্রায় বিশাল র‍্যালী বের হয় । সর্বাগ্রে প্রধান পুরোহিত মৃতদেহের দেবতা আনুবিস এর মুখোশ পরে মন্ত্র পড়তে পড়তে সামনে এগুতে থাকেন । পিছনে রাজার কফিন নিয়ে যাওয়া হয় । বহরে থাকে তার দুনিয়ায় ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র, আরাম আয়েশের সবকিছু । যা যা তার পছন্দের ছিলো‌ সবকিছুই নিয়ে যাওয়া হতো তার সমাধিতে ।

সবশেষে রাজার কফিন একটা বড় পাথরের সারকোফেগাসে (কফিন) রেখে ডালা এটে দেয়া হত । সেই‌ সারকোফেগাসে অঙ্কিত থাকতো রাজার পরিচয় আর তার জীবনের গুরুত্বপুর্ন কিছু কাজ । শেষে‌ প্রধান পুরোহিত রাজার শেষ নিদ্রার সব আয়োজন করে পুরো সমাধিস্থল সীল গালা করে দিতেন বিভিন্নভাবে । অনেক সমাধিতেই বসানো হতো বিভিন্ন ধরণের ফাঁদ । প্রতিটি ফাঁদেরই ক্ষমতা থাকতো মানুষ হত্যা করার । বিভিন্ন কঠুরীতে সেই সাথে বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেয়া হতো । তারপর অভিশাপ দেয়া হতো রাজার নিদ্রা ভঙ্গকারীদের উপর । সর্বশেষে মুল প্রবেশপথ বন্ধ করে সিলগালা করে পাহাড় ধসিয়ে মুলপ্রবেশ পথের শেষ চিহ্নও মুছে ফেলা হতো । এভাবেই সমাপ্ত হত একজন ফারাও এর প্রতাপশালী জীবনের।

মমি
সবশেষে রাজার কফিন একটা বড় পাথরের সারকোফেগাসে রেখে ডালা এটে দেয়া হত ।

লেখকঃ এ এস এম মিজানুর রহমান

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে