মহাত্না গান্ধী ও ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্ক নিয়ে যে ভুল ধারনা অনেকের; জানুন প্রকৃত সত্য

0
ইন্দিরা গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধী কে ছিলেন?

এই প্রশ্ন করলে অনেকের কাছেই শুনেছি ইন্দিরা গান্ধী হচ্ছে মহাত্না গান্ধীর কন্যা, যিনি পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

যখন বলি- উঁহু, ইন্দিরা গান্ধী মহাত্না গান্ধীর কন্যা নয়, বরং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর কন্যা, তখন তারা জিভে কামড় দিয়ে বলে – ওহ, ভুল হয়েছে। আসলে কন্যা না, ইন্দিরা গান্ধী মহাত্না গান্ধীর পুত্রবধু ছিলেন। কেউ কেউ আবার নাতনীও বলেন।

এবারো যখন বলি- উঁহু এটাও ভুল। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে মহাত্না গান্ধীর পারিবারিক কোন সম্পর্কই নেই!- তারা বিশ্বাসই করতে চায় না।

এরকম ভুল ধারনা অনেকেরই আছে। উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ধারাবাহিকতার কারনে এরকম ধারনা অস্বাভাবিক নয়। নামে যেহেতু গান্ধী আছে সেহেতু এরকম মনে করাটাই বরং স্বাভাবিক।  এই ভুল ধারনা দূর করতেই আজকের এই সংক্ষিপ্ত লেখাটি লিখছি।

ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু, যিনি পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী নামেই খ্যাত হয়েছেন তিনি আসলে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কন্যা।

ইন্দিরা গান্ধী
পিতা জওহরলাল নেহেরুর সাথে কন্যা ইন্দিরা গান্ধী

জহরলাল নেহেরু ইন্দিরাকে অক্সফোর্ডে পাঠান উচ্চশিক্ষা লাভ করতে। সে সময় ভারত থেকে আরেকজন যুবক অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করছিলেন। যার নাম ফিরোজ জাহাঙ্গীর খান গান্ধী। উল্লেখ্য এই গান্ধী আসলে ভারতের ‘Gandhi’ নয়। এটি পার্সিয়ান পদবী ‘Ghandy’ কিন্তু ভারতে গান্ধীই উচ্চারণ করা হত। ফিরোজ জাহাঙ্গীর খান গান্ধী বা সকলের কাছে ফিরোজ গান্ধী নামে পরিচিত ব্যক্তির পুর্বপুরুষরা পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ফিরোজ গান্ধীকে অনেকে মুসলিম বলেন আবার অনেকে অমুসলিম বলেন। তবে তিনি হিন্দু ছিলেন না।

এখানে উল্লেখ্য ফিরোজ অক্সফোর্ডে যাওয়ার আগেই ভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য হন। পার্টির কাজের সুবাদে নেহেরু পরিবারের সাথে যোগাযোগ তৈরী হয় ফিরোজের। এক পর্যায়ে ১৬ বছরের ইন্দিরাকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেন ২২ বছরের যুবক ফিরোজ। ইন্দিরার মা কমলা গান্ধীকে জানালে সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়ে সেসময় অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। তাও আবার নেহেরু পরিবারের মত রাজনৈতিক পরিবারের জন্য বটেই।

কিন্তু অক্সফোর্ডে গিয়ে ইন্দিরা ও ফিরোজের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, একে অন্যের গভীর প্রেমে পড়েন।

পিতা জওহরলাল নেহেরুর সাথে কন্যা ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরুর সম্পর্ক ছিল গভীর, বন্ধুত্বপূর্ন। কন্যাকে অত্যধিক ভালোবাসতেন পিতা। লন্ডন থেকে পিতাকে অনেকগুলো চিঠি পাটাতেন কন্যা। পিতাও দিতে উত্তর। একপর্যায়ে নিজের প্রেমের কথা জানালে ইন্দিরা। কিন্তু পিতা জোড়ালো আপত্তি তুললেন। কোনভাবেই ভিন্ন ধর্মের কারো সাথে বিয়ে দিতে রাজি নয় সে। এরপর প্রতিটি চিঠিতে ইন্দিরা তার প্রেমের সম্পর্কের গভীরতার কথা জানিয়েছেন। ফিরোজ কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেন না এমন প্রতিজ্ঞা শুনিয়েছেন। জওহরলাল নেহেরু বুঝতে পেরেছিলেন তার কন্যাকে থামানো সম্ভব না।

দিশেহারা জওহরলাল নেহেরু ছুটে গেলেন মহাত্না গান্ধীর কাছে। ইন্দিরাকে বিশেষ স্নেহ করতেন তিনি।  গান্ধী হয়ত বুঝাতে পারবেন ইন্দিরাকে- এরকম ক্ষীণ আশা নিয়েই হয়ত গিয়েছিলেন নেহেরু।

ইন্দিরা গান্ধী
১৯২৪ সালে মহাত্না গান্ধীর পাশে ৭ বছরের ইন্দিরা গান্ধী

কিন্তু মহাত্না গান্ধীও পারলেন না অথবা চেষ্টা করলেন না। মহাত্না গান্ধী জওহরলাল নেহেরুকে বললেন – আমার পুত্রের সাথে ইন্দিরাকে বিয়ে দিতে রাজি হবে?

জওহরলাল নেহেরু সম্মতি জানালেন। মহাত্না গান্ধী বললেন আজ থেকে ফিরোজ আমার পুত্র। ততদিনে ফিরোজ গান্ধী এমনিতেও মহান্তা গান্ধীর নামের সাথে মিল রেখে নামের ‘Ghandy’ কে ‘Gandhi’ লিখে গান্ধী নামে পরিচত হয়ে গিয়েছেন।

১৯৪২ সালে হিন্দু রীতি মেনে বিয়ে হয় ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু ও ফিরোজ জাহাঙ্গীর খান গান্ধীর। শেষ পর্যন্ত আপত্তি থাকলেও পিতা জওহরলাল নেহেরু মেনে নিলেন বিয়ে। আসলে মেনে নিতে বাধ্য হলেন। ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহেরু হয়ে গেল ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী যিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হলেন ইন্দিরা গান্ধী নামে।

ইন্দিরা গান্ধী
১৯৪২ সালে হিন্দু রীতি মেনে বিয়ে হয় ইন্দিরা ও ফিরোজের

অবশ্য এই বিয়ের বিতর্ক আজীবনই শুনতে হয়েছে ইন্দিরাকে এবং কংগ্রেসকে। বিরোধী পক্ষ ফিরোজ গান্ধীকে মুসলমান বলে প্রচার করেছে ইন্দিরা গান্ধী আসলে মুসলমান হয়ে গেছে। সে অন্য ধর্মের লোককে বিয়ে করে হিন্দুত্ব ত্যাগ করেছে। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর নাম পরিবর্তন করে নাকি মায়মুনা বেগম রাখা হয়েছে। বিয়ের পর দুজন আলাদা ধর্মই বজায় রেখেছিলেন নাকি ফিরোজ হিন্দুর ধর্মই মেনে চলতেন নাকি ইন্দিরা হিন্দু ধর্মও মানতেন না সে নিয়ে আছে নানা মত।

ভারতের রাজনীতিতে গোঁড়া হিন্দু ও অশিক্ষিত সাধারন মানুষের কাছে এ প্রচারণা ভালোই গুরুত্ব পেয়েছে।

যা হোক, এসব নিয়ে ও ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন ও পারিবারিক জীবনের বিস্তারিত নিয়ে অন্য কোন লেখায় আলোচনা করা যাবে।আজ শুধু মহাত্না গান্ধী ও ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্ক নিয়ে যে ভুল ধারনা আছে আমাদের অনেকের সেটা দূর করতে এটুকুই লিখলাম। প্রকৃত পক্ষে মহাত্না গান্ধীর সাথে ইন্দিরা গান্ধীর পারিবারিক কোন সম্পর্ক নেই।

ইন্দিরা গান্ধী
স্বামী ফিরোজ গান্ধীর সাথে ইন্দিরা গান্ধী

স্বামী ফিরোজ জাহাঙ্গীর খান গান্ধীর সাথে বিয়ের কারনেই তিনি গান্ধী পদবী লাভ করেন। আর ফিরোজ জাহাঙ্গীর খান গান্ধীর পরিবার এসেছিলেন পারস্য থেকে। ফিরোজের পিতার নাম ফরিদুন জাহাঙ্গীর খান গান্ধী (Ghandy)। ফিরোজ গান্ধী নিজেও রাজনীতিবিদ ছিলেন। লোকসভার (ভারতীয় পার্লামেন্ট) নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন।

লেখকঃ আসিফ আল রাজীব