আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার করা ১৬৫ কোটি টাকা দেশে ফিরিয়ে আনতে তিন কৌশল বা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মূলত অর্থের যথাযথ তথ্য পেতেই দুদকের যত কৌশল। যে তিন পদ্ধতিতে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে তা হলো-
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) মাধ্যমে দুবাইয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটের (এফআইইউ) পাচার করা অর্থের বিষয়ে তথ্য চাওয়ার অনুরোধ। গত ৮ মার্চ দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বিআইএফইউয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বরাবর পাঠানো চিঠিতে এ অনুরোধ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, অনুসন্ধান কর্মকর্তা যে পদ্ধতির সাহায্য নিতে চাচ্ছেন তা হলো মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর)। রোববার কমিশনের কাছে অগ্রগতিমূলক প্রতিবেদন জমা দিয়ে এমএলএআর পাঠানোর জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক পরিচালকের মাধ্যমে কমিশনের কাছে দুবাইয়ে এমএলএআর পাঠিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য ওই অনুমতি চান।
সর্বশেষ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুবাইয়ে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহে সরকারের সাহায্য চাওয়ার বিষয়ে কমিশনের কাছে অনুমতি চেয়েছে অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এক্ষেত্রে সরকার দূতাবাসের মাধ্যমে দুবাইয়ের এডিসিবি ব্যাংকের কাছে পাচার করা ব্যাংক হিসাবের বিবরণী, ওই হিসাবে কী পরিমাণ টাকা পাঠানো হয়েছিল তার বর্ণনা ও অর্থ পাঠানোর পরে ওই হিসাব থেকে কোন কোন হিসাবে টাকা স্থানান্তর হয়েছে এসব সহ সব তথ্য সংগ্রহের জন্য অনুরোধ করতে পারে।
এ বিষয়ে দুদকের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত দুদক চাচ্ছে যেকোনো উপায়ে পাচার করা অর্থ বাংলাদেশের ফেরত আসুক। এজন্য ওই তিন পদ্ধতির বিষয়ে কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কেননা দুদকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি দেশের বা ব্যাংকের টাকা পুনরুদ্ধার করা। বিআইএফইউয়ের কাছে চিঠি এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া এমএলএআর ও দূতাবাসের মাধ্যমে হিসাবের তথ্য সংগ্রহের জন্য কমিশনের কাছে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। অনুমোদন পাওয়া গেলে ওই দুই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হবে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, পাচার বা আত্মসাত করা অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত আসুক এই বিষয়টি দুদক সব সময়ে অগ্রাধিকার দেয়। আমাদের লক্ষ্য অপরাধী সাজা পাওয়ার পাশাপাশি অর্থ যেন রিকভারি হয়। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বেশ কিছু সফলতাও এসেছে।
এদিকে দুদকে এবি ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ চৌধুরী, মো. ফজলুর রহমান ও কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামালকে রোববার সাত ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবাই নিজেদের ভুল স্বীকার করেছেন বলে জানা যায়। তারাও চান যেকোনো উপায়ে হোক পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আসুক। এজন্য দুদককে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে আসামিরা জানিয়েছে। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এসব কথা জানিয়েছেন।
ভুয়া অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের নামে ১৬৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গত ২৫ জানুয়ারি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় মোট ৮ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন- এবি ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ চৌধুরী, মো. ফজলুর রহমান, কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামাল, এবি ব্যাংকের হেড অব অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের (ওবিইউ) মোহাম্মদ লোকমান, হেড অব করপোরেট ব্যাংকিং মোহাম্মদ মাহফুজ উল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. নুরুল আজিম এবং এবি ব্যাংকের গ্রাহক আটলান্টিক এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল হক।
দায়ের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের নামে ১৬৫ কোটি টাকা এবি ব্যাংকের চট্টগ্রাম ইপিজেড শাখা থেকে দুবাইয়ে পাচার করে এবং পরে তা আত্মসাৎ করে। আত্মসাৎকালে ওয়াহিদুল হক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। কথিত ওই বিনিয়োগ এবং অর্থ আত্মসাতের নেপথ্যে ব্যাংকের গ্রাহক আটলান্টিক এন্টারপ্রাইজের সাইফুল হকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এক সময় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কাজ করা সাইফুল হকের এবি ব্যাংকে কোনো অংশীদারিত্ব নেই। তবে তিনি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের মেয়ের স্বামী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সাইফুল হক দুবাইয়ে থাকাকালে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য খুররম আবদুল্লাহ ও আব্দুস সামাদ খানের সঙ্গে তার সখ্য হয়। তিনি এবি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হকেরও পূর্বপরিচিত। সাইফুল হকই এবি ব্যাংকের অর্থপাচারের বিষয়ে ওই প্রতারক চক্রের সঙ্গে ওয়াহিদুল হকের পরিচয় করিয়ে দেন। পরে দুবাই ও বাংলাদেশে একাধিকবার বৈঠক করেন তারা।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ওয়াহিদুল হক ও আবু হেনা মোস্তফা কামাল ব্যাংকের বোর্ডকে না জানিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুবাই গিয়ে প্রতারক চক্রের সঙ্গে বৈঠক করেন। আর ওই প্রতারক চক্র পিনাকল গ্লোবাল ফান্ড (পিজিএফ) নামে একটি কোম্পানি সৃষ্টি করে। সেই কথিত পিনাকলের ৮ কোটি ডলারের সঙ্গে এবি ব্যাংকের ২ কোটি ডলার মিলিয়ে ১০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠন করে তা দুবাইয়ে বিনিয়োগের একটি কাল্পনিক প্রস্তাব তৈরি করা হয়। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও শামীম আহমেদের যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংকের বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে তা পাস করিয়ে নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুবাইয়ে চেং বাও জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি নামের এক কোম্পানির নামে পাঠানো ওই ২ কোটি ডলার আবুধাবির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যায়। সেখান থেকে পরে তা আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থ পাচারের ওই ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়। মামলার দায়ের করার পর এম ওয়াহিদুল হকসহ তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুদক। যদিও ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ছাড়া বাকি আসামিরা জামিনে আছেন।