মাত্র ২৬ বছর বয়সেই ৭৫০০ কোটি রুপির (প্রায় ১০০ কোটি ডলার) মালিক তিনি। মাত্র ৭ বছর কাজ করেই এ আয় করেছেন পরিমাণ অর্থ। নিশ্চয়ই ভাবছেন এ কিভাবে সম্ভব! তিনি রিতেশ আগারওয়াল। ওয়ো রুমস এর প্রতিষ্ঠাতা। ওয়ো(OYO) এর পূর্ণরূপ “ON YOUR OWNS”। ২০১৩ সালে রীতেশ আগারওয়াল এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। মজার ব্যাপার হলো ওয়ো রুমসের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে রিতেশ আগারওয়ালের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর৷ অনেক দেশেই পর্যটনশিল্পে তুঙ্গে রয়েছে রিতেশের তৈরি ‘ওয়ো রুমস’। ওয়ো রুমসের অনলাইন ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসা হোটেল ব্যবসার নিয়ম পরিবর্তন করে দিয়েছে। ওয়ো রুমস মূলত হোটেল বুকিং দেওয়ার একটি ব্যবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন হোটেলে ওয়ো এর মাধ্যমে পছন্দের হোটেল বাছাই ছাড়াও হোটেল বুকিং দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে নিজের কোম্পানিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রিতেশ আগারওয়াল। ওয়ো এর অধীনে অন্যের হোটেল ছাড়াও কোম্পানির নামে তৈরি করেছেন অসংখ্য হোটেল। রিতেশ আগারওয়াল ওয়ো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুধু নিজের নয়, বিশ্বব্যাপী চাকুরি দিয়েছেন আরো ১৭০০০ জনকে।
উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রার শুরুটা রিতেশ আগারওয়ালের জন্য মোটেও সুখকর ছিলো না। তাঁর শৈশব কেটেছে ভারতের ওড়িশার রায়গড়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় দিদির কাছ থেকে প্রথমবারের মত ‘উদ্যোক্তা’ শব্দটি সম্পর্কে জানতে পারেন। সেই থেকেই তাঁর মনে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটি গেঁথে যায়। ছোট বয়সে তিনি মোবাইল সিম বিক্রি করা শুরু করেন অর্থ উপার্জনের জন্য। মাত্র ৮ বছর বয়সেই কোডিং নিয়ে কাজ করতেন তিনি। হয়ে যায় সফটওয়্যারের প্রতি ভালোবাসা। তাই ২০০৯ সালে রাজস্থানে চলে যান৷ উদ্দেশ্য ছিলো আইআইটিতে ভর্তি হবেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন ইন্জিনিয়ারিং তাঁর দ্বারা হবে না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এ সময়টিতে রিতেশ আগারওয়াল প্রায় সময় দিল্লি ভ্রমণ করতেন। সেখানকার বিভিন্ন স্টার্ট আপ-এ ইন্টার্নশিপ করতেন রীতেশ। এ সব টেরও পেতেন না তাঁর বাবা মা। এ সময়টিতে কভার করার জন্যে তাঁর সুযোগ হয় বিভিন্ন উদ্যোক্তার সাথে দেখা করার। নিয়মিত উদ্যোক্তাদের সাথে পরিচিত হওয়ার পর পুনরায় উঁকি দেয় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটি। যেহেতু তিনি বুঝতে পারেন ইন্জিনিয়ারিং তাঁর দ্বারা হবে না, তাই তিনি ২০১১ সালে পাকাপাকি ভাবে দিল্লিতে চলে আসেন। এবার উদ্দেশ্য ছিল স্যাট পরীক্ষা দিয়ে আমেরিকায় পড়ালেখার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। কিন্তু এখানেও তাঁর মন বেশিদিন টিকলো না। এমনকি তিনি পড়ার উদ্দেশ্যে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ইন্ডিয়া ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছিলেন৷ কিন্তু তিনি সেটিও ছেড়ে দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর দ্বারা আর যাই হোক, পড়ালেখা হবে না৷ পড়ালেখা বাদ দিয়ে সবসময় মন উসখুস করতো উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য। কিন্তু চাইলেই তো আর উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব না। এর জন্য প্রয়োজন ইউনিক কোনো আইডিয়া৷ সে সময়টিতে রিতেশ আগারওয়ালের ভ্রমণের বেশ শখ ছিলো। সুযোগ পেলেই ট্রেনে চেপে ভ্রমণ করতেন ভারতের শহরগুলো। বিভিন্ন সময় হোটেলে কাটাতে হতো রাত। কিন্তু থাকার মতো হোটেল খুঁজে পেতে তাঁর বেশ সমস্যা হতো। অনেক সময় বাজেটের মধ্যে হোটেল খুঁজতে পেতে হতো বেগ। আবার বাজেটের মধ্যে পেলেও পেতেন না সুযোগ সুবিধা। মূলত এ সূত্রেই তিনি তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার আইডিয়াটি পেয়ে যান।
রিতেশ আগারওয়াল বুঝতে পারেন হোটেল লাইন বেশ বড় এবং হয়ত এ সেক্টরে অনলাইন যুক্ত করে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করে ফেলা সম্ভব। এবার হোটেল সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে রিতেশ শুরু করলেন হোটেল ঘোরাঘুরি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হোটেল মালিকের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। থাকলেন বিভিন্ন হোটেলে। এর পরের ধাপ ছিল কঠোর পরিশ্রম। রিতেশ বুঝেছিলেন এ ছাড়া সাফল্য অধরা। হোটেলের এ ধারণা থেকেই ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ওরাভল স্টেইস। ওরাভল স্টেইস এর মাধ্যমে অনলাইনে মূলত কম ও মিড বাজেটের হোটেল, বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট জয়েন্টস, প্রাইভেট রুমের বুকিং দেওয়া যেত। অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি জনপ্রিয় হয়ে যায় তাঁর এই উদ্যোগটি। অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঞ্চার নার্সারি থেকে প্রায় ৩০ লাখ রুপির ফান্ড পেয়ে যায় ওরাভল স্টেইস। ওরাভল স্টেইসে কাজ চলাকালীন সময়টিতে তিনি জানতে পারেন থিয়েল ফেলোশিপ সম্পর্কে। পেপালের কো ফাউন্ডার ও ফেসবুকের শুরুর দিকের ইনভেস্টর পিটার থিয়েল বিশ্বব্যাপী এ ফেলোশিপটি প্রদান করেন। ফেলোশিপটি পাওয়ায় শর্ত হলো ২০ বছর বয়সের কম বয়সের ড্রপআউট হওয়া যে কেউ আবেদন করতে পারবে। তবে তাঁর অবশ্যই স্টার্টআপের জন্য ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া থাকতে হবে। আবেদন করার পরপরই প্রথম এশিয়ান হিসেবে রিতেশ আগারওয়াল পিটার থিয়েলের এ ফেলোশিপটি অর্জন করেন। ফেলোশিপের অধীনে অর্জন করেন প্রায় ১ লাখ ডলার। এছাড়াও সুযোগ পান বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণের।
ওরাভল স্টেইস প্রতিষ্ঠার বেশ কিছু মাস রিতেশ আগারওয়ালের জীবনে কঠিন সময় আসে। হঠাৎ করেই তাঁর কোম্পানিটি দিক হারিয়ে ফেলে। কিন্ত তিনি হাল ছাড়েননি। সবসময় নিজেকে মোটিভেটেড করেছেন এ সময়টিতে। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর উদ্যোগটি সফল করতে তাঁকে আরো আইডিয়া যুক্ত করতে হবে৷ দিনরাত ভাবতে লাগলেন কিভাবে নিজের উদ্যোগটি আরো আকর্ষণীয় করা সম্ভব! একসময় পেয়ে গেলেন আইডিয়া। তিনি বুঝতে পারলেন একজন মানুষের হোটেল বুকিংয়ের সময় লক্ষ্য থাকে মোটামুটি দামের মধ্যে ভালো সুবিধা সম্বলিত হোটেল। যদি মানুষ হোটেল বুকিংয়ের আগেই অনলাইনে হোটেল ভাড়াসহ হোটেলের রুমের ছবি, খাবার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধাসমূহ প্রথমেই জানতে পারে তবেই মানুষ সবচেয়ে বেশি অনলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে মাধ্যমে বুকিং দিবে। মূলত এই ধারণাটিই রিতেশের পূর্ব উদ্যোগকে অভাবনীয় গতি প্রদান করে।
এবার সম্পূর্ণ নতুনভাবে আগের আইডিয়ার সঙ্গে নতুন আইডিয়া যোগ করে রিতেশ ওরাভল স্টেইসকে ওহো রুমসে পরিণত করেন। মূল ধারণা আগের মত হলেও এবারেরটিতে যুক্ত করেন নতুন বেশ কয়েকটি ধারণা। সাধ্যের মধ্যে ভালো হোটেল পেতে যেহেতু মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের বেশ বেগ পেতে হয়, তাই তিনি এদিকটি লক্ষ্য রেখে কাজ শুরু করেন। যুক্ত করে দেন ওয়েবসাইটে হোটেল বুকিংয়ের সময় নিজের সাধ্যের মধ্যে হোটেল খুঁজে পাওয়া ছাড়াও হোটেলের প্রত্যেক রুমের ছবিসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা সমূহ সহজেই জানার সুযোগ। এছাড়াও অধীনে থাকা হোটেল মালিকদের জন্য বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেন তিনি। যেসব হোটেল মালিক ওহো রুমসের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়, তাদেরকে অবশ্যই ওহো এর বেশকিছু স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলার নিয়ম যুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর ওহো টিম হোটেল যুক্ত করার পূর্বে হোটেল ভ্রমণ করে সকল তথ্য যাচাইপূর্বক হোটেল ওয়েবসাইটের অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু করে।
কোম্পানিকে নতুন রূপ দেওয়ার পর বেশ পরিশ্রম শুরু করেন রিতেশ আগারওয়াল। কাজের প্রথম দিকে বিভিন্ন হোটেলে তিনি নিজেই রুমসার্ভিস বয় থেকে শুরু করে বেবি সিটারসহ বিভিন্ন কাজ নিজেই করেছেন৷ কথা বলেছেন কাস্টমারদের সঙ্গে। জানতে চেয়েছেন হোটেল সম্পর্কে তাদের ধারণা, তাদের ইচ্ছেগুলো। অনেকে তাঁকে হোটেল বয় মনে করে দিয়েছেন বখশিশও।
এরপর ওহো রুমস বেশ দ্রুতগতিতে অগ্রগতি করতে থাকে। রিতেশও যুক্ত করতে থাকেন নিয়মিত সুযোগ সুবিধা। ২০১৪ সালে ওহোতে ৪ কোটিরও বেশি রুপি ইনভেস্ট করে লাইটস্পিড ভেঞ্চার।
লাইটস্পিড ভেঞ্চারের বিনিয়োগের পর বিনিয়োগের টাকায় ওহোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বেশ কিছু নতুন সুবিধা। এরপর থেকেই ওহো প্রচুর বিনিয়োগকারীর দেখা পায়। ওহো যতবার নতুন নতুন বিনিয়োগ পেয়েছে, ততবারই নিত্যনতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হয়েছে। একসময় তৈরি করা হয় প্রায় সব ধরণের মানুষের জন্য সব ধরণের হোটেল রুমের সুবিধা পাওয়ার সুযোগ। খোলা হয় ওহো এর নিজস্ব বেশ কিছু হোটেলও। বিভিন্ন বাজেটের সঙ্গে মানানসই হোটেলের পাশাপাশি ‘ওয়ো রুমস’ এর মাধ্যমে রিতেশ জনপ্রিয় করেছেন ‘ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’ এবং ‘ভ্যাকেশন হোম’-এর ধারণাও।
চিরাচরিত হোটেলের থেকে রিতেশের নিত্যনতুন আবিস্কার করা এসব রীতি অনেকটাই অন্যরকম। হোটেল সম্পর্কিত নতুন নতুন আইডিয়া রিতেশ আগারওয়ালের ওহো রুমসকে তৈরি করেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর হোটেল সম্পর্কিত নিত্যনতুন সৃষ্টি করা এসব উদ্যোগ বেশ সাড়া জাগিয়েছে কাস্টমারদের কাছে। ওহো বর্তমানে যেসব সুবিধা প্রদান করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ওহো টাউনহাউস’, ‘ওহো হোম’, ‘ওহো ভ্যাকোশন হোম’, ‘সিলভার কি’, ‘ক্যাপিটাল ও’, ‘প্যালেট’, ‘কালেকশন ও’, ‘ওহো লাইফ’ সহ আরো অনেক নিত্যনতুন আধুনিক সুবিধা যা ওহোকে নিয়ে গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায়। কঠোর পরিশ্রম ও সময়ানুবর্তিতার ফসলও পেয়েছেন রিতেশ আগারওয়াল। তাঁর কোম্পানি ওহো রুমসের কার্যক্রম ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশের প্রায় ৮০০টিরও বেশি শহরে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে কাইলি জেনারের পর তরুণদের মধ্যে রিতেশ আগারওয়াল বিশ্বের দ্বিতীয় তরুণ বিলিওনিয়ার।