লেট্স টেক দ্য মেম্বারশীপ অব দ্যাট ওয়ার্ল্ড !

0
তানভীর শাহরিয়ার রিমন

তানভীর শাহরিয়ার রিমন

গতরাতে আমার ছেলেকে বলছিলাম, শোনো বাবা, জীবনে বাপ-দাদার পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার মাঝে খুব একটা গৌরবের কিছু নাই । বড় হতে হবে নিজের কর্মগুনে ।
সে মাথা নাড়ায়-ভাবখানা এমন যে চিন্তা কইরোনা, তোমার নাম বেইচা কিছু করমু না ।
তার খুব শখ সে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কোনো একটাতে পড়বে । পড়তে পারুক বা না পারুক, এই ধরনের স্বপ্ন তো দেখতে হবে । আমি খুশী, সে এমন সাহসী স্বপ্ন দেখে ।
-শোনো, তেহজীব, বিশ্বের যেখানে ইচ্ছা, যে বিষয়ে ইচ্ছা, পড়তে যাও । তবে স্কলারশীপ নিয়া যেতে হবে । আর পড়াশোনা শেষ করে দেশকে সেবা দিতে দেশে ফিরে আসতে হবে ।
সে হাসে ।
-হাসলে হবেনা ব্যাটা । দেশে চলে আসতে হবে ।
কথা গুলো এমনি এমনি বলিনাই । কারণ আছে । আমার এক নিকটাত্নীয় নিজ হাতে তার একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতটা শেষ করেছেন । এর রেশ এখনো তাকে টানতে হচ্ছে ।
বছর সাতেক আগের কথা । একদিন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী নিয়ে পড়তে চাও ?
-আংকেল এত পড়ে কী হবে ? আব্বুর একমাত্র ছেলে আমি । আব্বু বলছে, উনার সব ব্যবসা আমাকে সামলাতে হবে । আমাকে প্রায়ই অফিসে নিয়া যায় । আব্বুর ব্যবসা দেখার মতো বুদ্ধি আমার চলে আসছে । সে হড়বড় করে বলে যায় ।
ওর বয়স তখন ১৮ । আমি অশনী সংকেত দেখলাম । তার বাবাকে সতর্ক করলাম । লাভ কিছু হলোনা । তিনিও দেখি টাকার গরমে হিতাহীত জ্ঞান শূন্য – একটা মাত্র ছেলে । সবকিছু তো ওরই । ও বসে বসে খেতে পারবে আজীবন ।
এখন সে বসে বসেই খায় । না বাবার ব্যবসা দেখে , না নিজে কিছু করে । গতকাল ঈদের সারাদিন নাকি ঘুমাইছে । এই খবর যখন রাতে শুনি তখনই আমার ছেলেকে নিয়ে বসি ।
তাকে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনবছর আগের একটা ঘটনা বলি । আমি তখন একজন এনালিস্ট খুঁজছিলাম । বিজনেস এনালিস্ট টু সিইও ।
অনেকেই ইন্টারভিউ দিতে আসল । তাদের মাঝে একজনকে এপয়েন্ট করলাম । সে বিদেশে পড়াশোনা করেছে, ফাইন্যান্স এ । চাইলে সেখানে স্যাটেল করতে পারত । করেনি । তারপর আবার ফাইন্যান্স প্রফেশনাল না হয়ে এনালিস্ট হতে চাচ্ছে, আমার জন্য বিষয়টা ইন্টারেস্টিং মনে হয় । আমি সেই ইন্টারভিউতে তাকে জিজ্ঞেস করিনি তার বাবার পরিচয় ।
সে জয়েন করে দারুন কাজ শুরু করল । একদিন কি এক প্রসঙ্গে জানতে পারলাম তার বাপ-চাচার পরিচয় । বিশ্বাস করুন, আমি প্রথমে একটু চমকে উঠলাম । চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ একটা ব্যবসায়ী পরিবার থেকে উঠে এসে সে চাকরি করছে !!!
আমি তাকে অকপট বলে ফেললাম, এ্যাই, তুমি তোমার বাবার পরিচয় দাওনি কেন ?
-স্যার, আমি নিজের পরিচয়ে কাজ করতে এসেছি । কাজ শিখতে এসেছি । বাবার পরিচয় কেন দেব ? সেও কনফিডেন্ট এর সাথে এ্যান্সার করলো ।
-তা, তুমি তো তোমার বাবার কোম্পানীতেই কাজ করতে পারতে ।
-না স্যার, পারতাম না । ওখানে সবাই আমাকে মালিকের মেয়ে হিসাবে দেখত । আমি কাজ শিখতে পারতাম না । আমি আপনার কাছ থেকে শিখতে এসেছি । যেহেতু সরাসরি আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, আমি মনে করি একজন সিইও কিভাবে কাজ করে, কিভাবে ক্রিটিক্যাল ডিসিশান নেয়, কিভাবে প্রবলেম সল্ভব করে, সেটা আমি প্র্যাকটিকালী শিখতে পারব । আর একটা কথা স্যার, আমাকে সবসময় আমার কাজ দিয়ে জাজ করবেন, প্লিজ । আমি কার মেয়ে সে পরিচয় যেন বিবেচ্য না হয় ।
আমি স্পষ্টই তার আপব্রিংগিং যে কতটা সলিড সেটা বুঝতে পারলাম । সে দুবছর কাজ করলো টানা । তারপর নিজের একটা স্টার্টআপ দাঁড় করানোর পরিকল্পনা থেকে গেলবছর মার্চে সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলো । এই সময়টায় আট-দশজন কর্মীর মতোই সে কাজ করেছে । কখনো ভুল করলে কথা শুনেছে । পরদিন দ্বিগুন উৎসাহে কাজে নেমে পড়েছে । সে ছিল কুইক লার্নার এবং ভীষণ বিনয়ী ।
আমি আবারো বলছি, আপনি কোন বংশে জন্ম গ্রহণ করেছেন, কে আপনার বাবা-এটা মোটেই আপনি নির্ধারণ করেননি । এই পরিচয় নিয়ে যেমন গর্ব করার কিছু নাই তেমনি হীনমন্যতায় ভোগারও কিছু নাই ।
একটু ভেবে দেখুন , জীবনে বাপ-দাদার পরিচয়, বংশ মর্যাদা এসবের জোর খাটিয়ে হয়ত আমাদের দেশে আমরা কিছুটা সাময়িক লাভের মুখ দেখি । কিন্তু প্রকৃত অর্জন কিছু কি হয় ? হয়না । আমি বহু দেশ ঘুরেছি । বহু মানুষের সাথে মিশেছি । বহু ভিন দেশি বন্ধু আছে আমার । ওরা কখনো এসব নিয়ে ভাবেনা । আপনার বাবার পরিচয়, আপনার বংশ পরিচয় কোনো ম্যাটার করেনা সেখানে । ম্যাটার করে আপনার যোগ্যতা । আপনাকে নো ওয়ান উইল আস্ক, হোয়েদার ইউ আর এ্যা চৌধুরী ওর সৈয়দ ? ওরা দেখে আপনাকে, আপনি কে ।
উত্তর কী হবে ? আমি একজন চৌধুরী ! বা আমি মীর বংশের ছেলে ।
না । উত্তর হওয়া চাই-আমি একজন অনট্রপ্রিনার, ডাটা সাইনটিস্ট, একজন ইকোনমিস্ট, ডক্টর, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, টাউন প্ল্যানার, আর্কিটেক্ট, অথর, জার্নালিস্ট, ক্রিকেটার, ফ্রিল্যান্সার, ডিজিটাল মার্কেটার, রিয়েলটর, রিসার্চার, জেনেটিসিস্ট ইত্যাদি ।
এখন যদি আপনি কৃষকের ঘরে জন্ম গ্রহন করে থাকেন, আপনার বাবা যদি একজন দিনমজুর হয়ে থাকেন, তিনি যদি টংয়ের দোকানে সিঙ্গারা বিক্রী করে থাকেন কিংবা হয়ে থাকেন ফেরিওয়ালা সেখানে আপনার হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নাই । জেনে রাখুন, এটাও আপনি নির্ধারণ করেননি । বরং আপনি যদি প্রতিকূলতা জয় করার মতো সাহস রাখেন । আপনি যদি মেধাবী এবং পরিশ্রমী হন, বলা যায়না একদিন আপনি বারাক ওবামার মতো হয়ে উঠতে পারেন । আপনি আইনস্টাইনের মতো হয়ে উঠতে পারেন ।
বারাক ওবামার বাবাকে ? দাদা কে ? তার গায়ের রঙ কী ? এসব কিছু পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে উঠেনি ।
বিশ্বাস করুন, আমি যে পৃথিবীর কথা বলছি সেই পৃথিবী স্রেফ যোগ্যদের সম্মান করে । আপনার মগজের জন্য আপনাকে সম্মান করে । আপনার বাবার অর্থ বিত্ত, আপনার বংশ গৌরব সেখানে বিবেচ্য নয় ।
লেট্স টেক দ্য মেম্বারশীপ অব দ্যাট ওয়ার্ল্ড !

  • লেখকের ফেসবুক থেকে