শিয়া ও খারেজি: ইসলামের প্রাথমিক যুগে উম্মতের মাঝে বিভেদ রচনা করা দুই মতবাদ

0
শিয়া

মহানবী (স) এর মৃত্যুর পর কে মুসলমানদের খলিফা হবেন এ নিয়ে শুরুতে কিঞ্চিৎ মতবিরোধ দেখা দিলেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) কে মনোনীত করার পর তা দূর হয়ে গিয়েছিল। তাঁর সততা, যোগ্যতা, ঈমানদারীর কারনে সবাই প্রায় বিনাবাক্যেই তাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়। এরপর উমার (রা) এর ক্ষেত্রেও তেমন কোন বিরোধ হয়নি। কিন্তু উমার (রা) এর মৃত্যুর পর যখন উসমান (রা) খলিফা হলেন তখনই কিছুটা গোলযোগের সূচনা হয়, একটা পক্ষ আলী (রা) কে খলিফা পদে দেখতে চাইলো। আসলে এই পক্ষ শুরু থেকেই খলিফা হওয়ার ক্ষেত্রে আলী (রা) কে অধিকতর যোগ্য মনে করতো।

উসমান (রা) নিহত হওয়ার পর খলিফা হলেন আলী (রা)। কিন্তু আলী (রা) এর সময়ে কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষ করে উসমান (রা) এর হত্যাকারীদের বিচারের প্রশ্নে মতবিরোধ প্রকট আকার ধারন করে। অনিবার্য কিছু সমস্যার কারনে আলী (রা) উসমান (রা) এর হত্যাকারীদের বিচার কাজ খেলাফতের দায়িত্ব পেয়ে তখনি শুরু করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে হযরত আয়েশা (রা) , আবু সুফিয়ান (রা), তালহা (রা) ও  জুবায়ের (রা) সহ অনেকেরই দাবী ছিল হত্যাকারীদের বিচারের সম্মুখীন করার। এসব রাজনৈতিক কারনে দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যায় মুসলমানরা।  এমনকি উম্মতের মাঝে অনেকটা গৃহযুদ্ধের মত সমস্যা দেখা দেয়। জামালের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধের মত রীতিমত যুদ্ধ সংঘটিত হয় নিজেদের মধ্যে। জামালের যুদ্ধে আলী (রা) এর বিপক্ষে ছিল হযরত আয়েশা (রা) , আবু সুফিয়ান (রা), তালহা (রা) ও  জুবায়ের (রা)। সিফফিনের যুদ্ধে আলী (রা) এর বিপক্ষে ছিল মুয়াবিয়া (রা)। যুদ্ধের পরে আলী (রা) খিলাফতের রাজধানী মদিনা থেকে সরিয়ে কুফায় নিয়ে আসেন। এটা অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেন নি।

এইসব যুদ্ধের ফলে এতদিনের ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক’ মতবিরোধ রূপ নেয় ধর্মীয় বিশ্বাসের মতবিরোধে। বিবদমান দুই পক্ষের মাঝে কে সঠিক আর কে ভুল সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যই এরকম মতবিরোধ জন্ম নেয়। এবং নতুন মতবাদের জন্ম দেয়।

এরপর ধীরে ধীরে এইসব মতবাদ অনেকটা ধর্মীয় দর্শনের রূপ পায় এবং ইসলামের মাঝে ভিন্ন উপদল তৈরী করে। ইসলামের একেবারে প্রথমদিকে সূচিত হওয়া উপদলের মাঝে উল্লেখযোগ্য দুইটি হচ্ছে-

১। শিয়া  ২। খারেজি

শিয়াঃ

মহানবী (সা) এর ওফাতের সময়ই কিছু লোক ছিল যারা মনে করতো এখন আলী (রা)-ই খেলাফতের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। কিন্তু আবু বকর (রা) ও উমার (রা) এর যোগ্যতার উপর কোন প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকায় এসব ব্যক্তিরাও তাদের খলিফা হিসেবে মেনে নিয়েছিল প্রকাশ্য আপত্তি ছাড়াই। আলী (রা) নিজেও খলিফার দাবী করেননি। একইভাবে উসমান (রা) খলিফা হওয়ার পর যখন আলী (রা) নিজে উসমান (রা) এর হাতে বাইয়্যাত গ্রহন (আনুগত্য স্বীকার করা) করেন তখন তাদের আর আপত্তি করার সুযোগ থাকে না। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় এরপর যখন আলী (রা) খলিফা হলেন। জামালের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধের পর আলী (রা) এর পক্ষের মুসলমানরা আলী (রা) এর সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়া সাহাবী ও মুসলিমদের ইসলাম চ্যুত মনে করতে থাকে। তাদের চরম পাপী ঘোষণা করে। প্রচার করতে থাকে তাদের স্থান হবে জাহান্নামে। এরপর কারবালায় ইমাম হুসাইন (রা) এর শহীদ হওয়ার পর এই মতবাদের প্রচার আরো বাড়তে থাকে এবং ধীরে ধীরে একটি ধর্মীয় মতবাদ ও আলাদা উপদলের সৃষ্টি হয়।

শিয়া মতবাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিশ্বাস হলঃ

১। মহানবী (সা) এর পরে খলিফা হওয়ার অধিকার ছিল শুধুমাত্র আলী (রা) এর। আলী (রা) কে খলিফা বা ইমাম (শিয়ারা খলিফা না বলে ইমাম শব্দ ব্যবহার করে) না করে বাকিদেরকে (অর্থাৎ আবু বকর (রা) , উমার (রা) ও উসমান (রা) কে)  ইমাম বানানো ছিল মুসলমানদের ভুল সিদ্ধান্ত। এই তিনজন খলিফা হয়ে নিজেরাও ভুল করেছেন।

২। আলী (রা) ও মহানবী (সা) এর মাঝে পার্থক্য ছিল শুধু নব্যুয়ত এর। এই নব্যুয়ত ছাড়া বাকি সকল দিক থেকে দুজন সমকক্ষ ছিলেন।

৩। ইমাম হতে হবে মহানবী (সা) এর বংশধর তথা আলী (রা) এর বংশের কাউকে। অর্থাৎ কুরাইশ বংশের কাউকে।

৪। পরবর্তী ইমাম কে হবে তা নির্ধারণ করে যাবে বর্তমান ইমাম। সাধারন মুসলিমরা ইমাম নির্বাচন করতে পারবে না।

৫। মহানবী (সা) এর ওফাতের পর অনেক সাহাবীই ইসলামচ্যুত হয়ে গিয়েছিলেন।

৬। একইসময়ে পৃথিবীতে একাধিক ইমাম বা খলিফা থাকতে পারে না।

এই ধারনার বাইরে স্বল্প কিছু কট্টর শিয়া এটাও মনে করে জিবরাইল (আ) এর ভুলক্রমে ওহী আলী (রা) এর কাছে না এসে মুহম্মদ (সা) এর কাছে পৌছায়। অনেকে আয়েশা (রা) বিষয়েও নেতিবাচক কথা বলে।

আলী (রা), হাসান (রা), হুসেইন (রা) এবং এরপর পর্যায়ক্রমে আরো ৯ জন সহ ১২ জন ইমামকে শিয়ারা বিশেষ মর্যাদাপূর্ন মনে করে। মহানবী (সা) ও ফাতিমা (রা) এরপর এই ১২ জনকে নিষ্পাপ মনে করে তাঁরা।

তবে শিয়াদের মাঝেও কিছু মধ্যপন্থী আছে। যারা আবু বকর (রা) , উমার (রা) ও উসমান (রা) এর খলিফা বা ইমাম হওয়া নিয়ে আপত্তি তুলে না। আবার তারা এও মনে করে যদি আলী (রা) এর বংশের কেউ যদি ইমাম হতে রাজি না হয় বা কোন ইমামের উপর আপত্তি না তুলে তাহলে অন্য কোন যোগ্য ব্যক্তিও ইমাম হতে পারবে।

যা হোক মূলত এইসব মতবাদ ও বিশ্বাস কে কেন্দ্র করে ইসলামে শিয়া নামের মতবাদ ও উপদলের উদ্ভব হয়েছিল। পরবর্তীতে নানা মতবাদে শিয়াদের মাঝেও আরো অনেক উপদল তৈরী হয়েছে। এদের অনেক মত বা বিশ্বাসকেই সুন্নী মুসলিমরা চরম ভ্রান্তি ও পাপাচার মনে করে।

খারেজিঃ

খারেজি শব্দটি এসেছে খারেজ শব্দ থেকে। কোন মুসলিম কবীরা গুনাহ করলেই  তাকে ইসলাম থেকে খারেজ বা ইসলামচ্যুত বলে মনে করতো এরা এবং তাকে হত্যা করা জায়েজ বলে মনে করতো।  ধর্মীয় বিভিন্ন ব্যাপারে এদের মনোভাব ছিল অতি কট্টর।

জামালের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধের সময় যখন শিয়া মতবাদের উদ্ভব হল তখনি শিয়াদের এইসব মতবাদের বিরুদ্ধে আরেকটি মতবাদের উদ্ভব হয়। সিফফীন যুদ্ধের সময় আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (রা) নিজেদের সমস্যা মেটানোর উদ্দেশ্যে আমর ইবনুল আস (রা) ও আবু মুসা (রা) কে সালিশ নিযুক্ত করলেন তখন একদল লোক আল্লাহর উপর ভরসা না করে ও কুরানের মাঝে সমাধান না করে মানুষকে ফয়সালাকারী মানার কারনে আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (রা উভয়কে কাফের ঘোষণা করে। দুই সালিশ আমর ইবনুল আস (রা) ও আবু মুসা (রা) কেও অনেক বড় গুনাহকারী বলে। আবার জামাল যুদ্ধে জড়িত হওয়ায় তালহা (রা) ও  জুবায়ের (রা) এবং আয়েশা (রা) কেও গুনাহগার বলে রায় দেয়। পরে খারেজিদের হাতেই শহীদ হন আলী (রা)।

খারেজি মতবাদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধারনা হলঃ

১। কোন মুসলমান কবীরগুণাহ করলে কাফের হয়ে যাবে। তওবা করে আবার ইসলাম কবুল না করলে তাদের মুসলমান বলা যাবে না।

২। কুরান ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা দলের সিদ্ধান্তকে কোন সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে মানা যাবে না।

৩। যে কোন যোগ্য ইমানদার ব্যক্তি খলিফা হতে পারবে। তাঁকে কুরাইশ বংশেরই হতে হবে এমন কথা নেই। বরং মুসলমানরা যাকে নির্বাচিত করবে সেই খলিফা হবে।

৪। খলিফা থাকাকালীন কোন পাপ বা অন্যায় করলে সে ব্যক্তি খলিফা পদে থাকার অযোগ্য হবে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে তখন তাঁকে পদচ্যূত করা ও হত্যা করা সকল মুসলিমের উপর ওয়াজিব।

এসব বিশ্বাসের উপর গড়ে ওঠা খারেজি দের মাঝে মধ্যপন্থী ও কট্টরপন্থী ছিল। কট্টরপন্থী খারেজিরা খারেজি ছাড়া বাকি মুসলমানদের হত্যা করা ও তাদের সম্পদ কেড়ে নেয়াকে জায়েজ মনে করতো। খারেজি ছাড়া কারো পিছনে নামাজ পড়া, আত্নীয়তার সম্পর্ক করা নাজায়েজ মনে করতো। তুলনামূলক মধ্যপন্থী খারেজিরা অন্য মুসলিমদের কাফের বললেও হত্যা করার পক্ষে ছিল না। অতি কট্টরপন্থা মনোভাবের কারনে সাধারন মুসলমানরা এদের উপর বিরক্ত ছিল ও এদের কারনে আতঙ্কে থাকতো। আবার উমাইয়া শাসন ও আব্বাসীয় শাসনামলে খলিফাদের অন্যায় কাজের বিরোধীতা করে, খলিফাদের বাহিনীর সাথে লড়াই করে করে এদের শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। ফলে পরবর্তীতে এই মতবাদ টিকে থাকতে পারেনি।

বর্তমানে মুসলমানদের মাঝে নানা মতবাদের কারনে বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের এই দুই মতবাদই ছিল মুসলমানদের বিভক্ত করার সূচনা। নিজেদের মাঝে এসব বিভিন্ন মতবাদকে ত্যাগ করে, কট্টরপন্থা ত্যাগ করে কুরান কে ভিত্তি করে মহানবী (সা) এর নির্দেশ ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরে একতাবদ্ধ হয়ে থেকে মধ্যপন্থা ও সিরাতুল মুস্তাকিম এর পথে থেকে শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলবে এই আশা সকল সাধারন মুসলমানের। এ আশা কবে পুরন হবে সে প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ ছাড়া আর কে জানে!

লেখকঃ আসিফ আল রাজীব