ক্রসেডারদের আতংক সুলতান গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী

0

“আপনি যদি একটি জাতিকে কোনরকম যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করে দিতে চান, তাহলে তাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে অশ্লীলতা আর ব্যাভিচারের প্রচলনের ব্যবস্থা করে দিন।”

“নেতারা যে জনগনের নেতৃত্বে থাকে, সেই মানুষদের চেয়ে যখন নিজেদেরকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়, তারা সেই পদের জন্য তখন আর যোগ্য থাকে না।” — সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী

সালাউদ্দিন আইয়ুবী
সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী

সপ্তম শতকের শুরুতেই মিসর, বাইজেন্টাইন, ইরাক, ইরান, আফগান সহ জেরুজালেম ইসলামের পরিপূর্ন সাম্রাজ্য বিস্তার এবং শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু এ সাম্রাজ্যের সূচনা হয় ষষ্ঠ শতকে মহান বীর খালিদ বীন ওয়ালিদের হাতে। মহানবী (সা) তাঁর জীবদ্দশায় বহু রাজ্য প্রধানের কাছে ইসলামের আহবান জানিয়ে পত্র পাঠান। এরই ধারাবাহিকতায় মিসর ও আলকজানিন্দ্রায় রোমক শাসনকর্তা বাদশাহ জুরায়হ মকুকাশ ইবনে ইয়ামিনকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ করেন। হযরত হাহিব ইবনে আবি বালতা (রা) মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের দূত হিসেবে উক্ত পত্র নিয়ে মকুকাশের দরবারে পৌঁছেন। মকুকাশ দূতকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করেন। কিবতীদের মধ্যে সুখ্যাতির অধিকারী মরিয়ায়ে কিবতীয়া ও শিরীন নামে দুজন দাসী, মূল্যবান কাপড় এবং দুলদুল নামের একটি ঘোড়া উপঢৌকন হিসেবে মদীনায় প্রেরণ করেন কিন্তু ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটি সুকৌশল এড়িয়ে যান। এভাবে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে সামিল হয় অনেকে করে বিরোধিতা। কিন্তু একসময় চিঠি পাঠানো সকল রাজ্যই মুসলমানদের হস্তগত হয়। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা)-এর শাসনামলে হযরত আমর ইবনুল আস (রা) মিসরের রোমক শাসনকর্তাকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে গোটা মিসরকে ইসলামী শাসনাধীনে আনয়ন করেন। মিসর মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এ সময়ে আধুনিক কায়রোর নিকটবর্তী আল ফুততা নামক স্থানে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়। উমাইয়া ও আব্বাসীয় বংশের শাসনের পর ৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মিসরে ফাতেমী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশের প্রথম শাসক জহর আল ফুসতাতের পরিবর্তে আল কাহিরা বা কায়রোতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন রাজধানীকে সুশোভিত করার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলমাদের ক্রমবর্ধমান বিজয় এবং শাসন ছিলো অব্যহত। এই সময়ের মধ্যে ইসলাম এবং ইসলামিক চর্চা, ধর্মীয় শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজ্য প্রসার, সেনাবাহিনী গঠনে মুসলমান অসামান্য ভূমিকা রাখে। এরপর শুরুহয় ইসলামের উপর সম্মিলিত ষড়যন্ত্র। যার মাত্রা ছিলো অত্যন্ত ভয়াবহ। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইউরোপিয়ান শাসকেরা একেএকে মুসলামদের কাছে রাজ্য হারিয়ে, মুসলমানদের অধীনে থেকে শাসন মেনে নিয়ে, তাদের পবিত্র ভুমিতে ইসলামের ব্যাপক চর্চায় যেমন ছিলো বিচলিত তেমনি আক্রোশে ছিলো জর্জরিত।

এহেন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে তারা গ্রহন করলো এক মহা কুটকৌশল। যার প্রধানতম উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের মধ্যে বিচ্ছেদ আর ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বিমুখ করে মুসলিম সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ করা। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে তারা গঠন করলো গুপ্তচর বাহিনী, শুরু করলো মিথ্যাচার, প্রোপাগান্ডা, নকল ইসলামী রীতি, মদ, জুয়া, নারীর ব্যবহার। অশ্লীলতা আর ব্যভিচার মুসলমানদের মধ্যে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিতে ইসলাম বিদ্বেষীরা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্ব করে আগাতে থাকলো অত্যন্ত গোপনে আর প্রকাশ্যে আরম্ভ করলো ক্রুসেড।

ক্রুসেডের প্রথম যুদ্ধেই জেরুজালেম মুসলমাদের হাত ছাড়া হয়।

এর প্রায় ২০০ বছর পর জেরুজালেম আবার পুনরুদ্ধার করেন মুসলিম সেনাপতি, অকুতোভয় সেনা নায়ক, সুলতান গাজী সালাউদ্দীন আল আইয়ুবী। ঝড়গতি সম্পন্ন, আপোষহীন অকুতোভয় আইয়ুবী যখন ইসলামের তরবারি হাতে আবির্ভূত হন তখন ক্রুসেডের সাজানো কৌশল বারেবারে কেপে উঠে। চক্রান্তের জাল ছিড়ে জেরুজালেম ছিনিয়ে এনে শত বছরপর আবার মুসলমানদের হৃদয়ে প্রশান্তি নিয়ে আসেন গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী।

বর্তমান ইরাকের টাইগ্রিস বা দজলা ও ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা মেসোপটেমিয়ার তিকরিতে ১১৩৭ সালে জন্ম গ্রহন করেন সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তার ব্যক্তিগত নাম ইউসুফ, সালাহউদ্দিন হল লকব যার অর্থ “বিশ্বাসের ন্যায়পরায়ণ”। তিনি ছিলেন মিশর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান এবং আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতে মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়েমেন এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। সালাহউদ্দীন ছিলেন মুসলিম, আরব, তুর্কি ও কুর্দি সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

১০৯৯ সালে মুসলমানদেরকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম তাদের দখলে আনেন ইউরোপিয়ানরা। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল। বিজয়ের পর ক্রুসেড যোদ্ধারা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বইয়ে দেন। এটা ইউরোপিয়ানদের নিজ বিবরণ অনুযায়ী। শহরে কী নারী, কী পুরুষ, কী শিশু, কী বৃদ্ধ –যাকেই পাওয়া গেছে, তাকেই নিধন করা হয়েছে। বহমান রক্তে নাকী সেদিন ঘোড়ার খোর পিছলে যাচ্ছিল। এই ছিল নিধনের নৃশংসতা।বিজয় ধরে রাখা, পরবর্তী যুদ্ধাদি চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গডফ্রি জেরুজালেমের বাদশাহর পদে সমাসীন হন। অথচ হযরত ওমরের (রা.) খেলাফত কালে জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসে। বিজয় যখন মুসলমানদের আয়ত্তে তখন জেরুজালেমের অধিপতি পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাস । ওমর (রা.) পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাসের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের জানমাল ও ধর্মীয় নিরাপত্তার বিষয়াদি নিশ্চিত করেন। সেই হতে জেরুজালেমে সকল ধর্মের (ইয়াহুদী/খৃষ্টীয়ান) লোকজনের যাওয়া আসা, ইবাদত-আরাধনার নিরাপত্তা বিধিত হয় এবং এটা এভাবেই যুগপৎ হয়ে পড়ে।

ক্রুসেডের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। হাজার বছর ধরে চলছে এ ক্রুসেড। গাজী সালাউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। কেবল সশস্ত্র সংঘাত নয়, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেও সে যুদ্ধ ছিল সর্বপ্লাবী। ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল খ্রিষ্টানরা। একে একে লোমহর্ষক অসংখ্য সংঘাত ও সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে বেছে নিয়েছিল ষড়যন্তের পথ। মুসলিম দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছিল গুপ্তচর বাহিনী। ছড়িয়ে দিয়েছিল মদ ও নেশার দ্রব্য। বেহায়াপনা আর চরিত্র হননের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল মুসলিম দেশগুলোর সর্বত্র। একদিকে সশস্ত্র লড়াই, অন্যদিকে কুটিল সাংস্কৃতিক হামলা- এ দু’য়ের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াল মুসলিম বীর শ্রেষ্ঠরা। তারা মোকাবেলা করল এমন সব অবিশ্বাস্য শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনার, মানুষের কল্পনাকে যা হার মানায়।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর ১১৯০ সালে তৃতীয় ক্রুসেড জয়ের পূর্ব পর্জন্ত ইহুদী, খ্রিস্টান, উপনেবেশিকরা সব ক্রসেডে মুসলমানদের ব্যাপকভাবে নিপীড়ন, নিষ্পেষণ চালায়। ১৩ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলতে থাকা এই দখলদারিত্বে ইউরোপিয়ান শাসকেরা নানান রকমের অত্যাচার ও নির্যাতন করেন এবং সর্বোপরি যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ করতে এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে যে চরম মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা করেন তার জের এখনও শেষ হয় নি। ইউরোপ ও মুসলমানদের মধ্যে হাজার বৎসরের টানাপোড়নের সম্পর্ক এই যুদ্ধংদেহী তৎপরতার সৃষ্টি।

১১৬৩ সালে তার জেনগি বংশীয় ঊর্ধ্বতন নূরউদ্দিন জেনগি তাকে ফাতেমীয় মিশরে প্রেরণ করেন। ক্রুসেডারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্যের মাধ্যমে সালাহউদ্দীন ফাতেমীয় সরকারের উচ্চপদে পৌছান। ফাতেমীয় খলিফা আল আদিদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১১৬৯ সালে তার চাচা শেরেকোহ মৃত্যুবরণ করলে আল আদিদ সালাহউদ্দীনকে তার উজির নিয়োগ দেন।

১১৭৪ সালে নূরউদ্দিনের মৃত্যুর অল্পকাল পরে সালাহউদ্দীন সিরিয়া বিজয়ে ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দেন। দামেস্কের শাসকের অনুরোধে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে শহরে প্রবেশ করেন। ১১৭৫ সালের মধ্যভাগে তিনি হামা ও হিমস জয় করেন। জেনগি নেতারা তার বিরোধী হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে তারা সিরিয়ার শাসক ছিল। এরপর শীঘ্রই তিনি জেনগি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুসতাদি কর্তৃক মিশর ও সিরিয়ার সুলতান ঘোষিত হন।

১১৮২ সালে আলেপ্পো জয়ের মাধ্যমে সালাহউদ্দিন সিরিয়া জয় সমাপ্ত করেন। তবে জেনগিদের মসুলের শক্তঘাটি দখলে সমর্থ হননি।

সালাউদ্দীনের সাথে ক্রুসেডারদের যুদ্ধ হয় ১১৮৭ সালে। এর কয়েক দশক আগে অপর এক ক্রুসেড যুদ্ধে এই মর্মে বিরতি আসে যে খৃস্টানরা মুসলমানদেরকে হজ্জে যাতায়াতে বাধা দেবে না, ব্যবসায় কাফেলাদেরকে এবং ধর্মীয় কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবেনা। এটাই প্রায় চার যুগ ধরে চলছিল। কিন্তু ১১৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি হজ্জযাত্রী কাফেলাকে রেনোল্ড আক্রমণ করেন, মালামাল লুট করেন এবং তাদেরকে মারধর করে জেলে নিক্ষেপ করেন। রেনোল্ডের উদ্দেশ্য ছিল সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামানো। অবস্থা এই ছিল যে জেরুজালেমের বাদশাহ বল্ডউইন কোষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে তার ভায়রা গী অব লুসিগনান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন। কিন্তু গীর সে ধরনের তেমন কোন দক্ষতা ছিল না। তাই তার এক প্রাক্তন-মৈত্রী রেনোল্ড তার কাজে সহায়তা করতেন এবং ‘সুযোগও গ্রহণ করতেন’। রেনোল্ড একজন রক্ত-লিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন। তবে রেনোল্ড কর্তৃক ব্যবসায় কাফেলাকে ইতিপূর্বে হয়রানী করার অভিযোগও আছে। পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাই রেনোল্ড ইচ্ছে করেই সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামিয়ে চূর্ণ করার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশেই একটি নিরপরাধ, নিরস্ত্র, হজ্জগামী কাফেলাকে আক্রমণ। এরই জওয়াব দিতে আসেন সালাউদ্দীন আইয়ূবী। ১১৮৭ সালে তিনি ক্রুসেডদেরকে দারুণভাবে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর জেরুজালেমে প্রবেশ ও বিজয় ছিল রক্তহীন।

৩য় ক্রুসেডে মুসলিম বাহিনীর উদ্দেশ্যে আইয়ুবীর নির্দেশনা (আইয়ুবী কে নিয়ে নির্মিত মুভি থেকে)

সালাউদ্দীনের বিজয় ইউরোপে তুমুল ক্ষোভ ও বিকম্পন সৃষ্টি করে। পোপ ৩য় আর্বান হার্ট এটাক করে মারা যান। ক্রুসেডাররা তখনো ধারনা করতে পারেনি সালাউদ্দিন ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আগমন করেছেন।

বাইতুল মুকাদ্দাসে খ্রিস্টানদের মহা বিপর্যয়ের পর মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পোপ ২য় আরবানুসের আহবানে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হল সমগ্র খ্রিস্টান শক্তি। ইংল্যান্ডের রিচার্ড দি লায়নহার্ট, ফ্রান্সের ফিলিপ অগাস্টাস আর জার্মানির ফ্রেডরিকের নেতৃত্বে প্রায় ৬ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান আক্রায় মুসলমানদের অবরোধ করা হয়।

১১৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর মেয়াদী ৬ লাখ সৈন্যের এই বিশাল অবরোধ সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মাত্র ২০ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে প্রতিরোধ করেন। অবশেষে খ্রিস্টান বাহিনী ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর অবরোধ তুলে নিয়ে নিজদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে শতশত বছর কোন খ্রিস্টান সম্রাট শত চেষ্টা করেও বাইতুল মুকাদ্দাস আর দখল করতে পারেনি।

১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা নামধারী মুসলিম শাসকদের সহায়তায় সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। এরপর তারা ১০৯৯ সালের ৭ জুন বাইতুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে এবং ১৫ জুলাই মসজিদের ভেতর প্রবেশ করে ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। ক্রুসেডাররা চালায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল পবিত্র আল কুদস। এভাবেই কুদসে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এর পর দীর্ঘ প্রতিক্ষা, গোলামীর জিঞ্জির ভেংগে, জিল্লতির জীবন ছেড়ে মাথা তোলে দাঁড়াবার জন্য মুসলিম মিল্লাত অপেক্ষা করছিল একজন মুক্তিদূতের। ১০৯৯ সালের পরের কোন এক সময়, তখন আল কুদস ক্রুসেডারদের দখলে। বাগদাদ শহরে এক কাঠমিস্ত্রি থাকতেন।লোকটি মনের সকল ভালোবাসা দিয়ে খুব সুন্দর একটি মিম্বর বানালেন। মিম্বরটির সৌন্দর্যের কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোক মিম্বরটি দেখতে আসতে শুরু করলো। অনেকেই মিম্বরটি কিনতে চাইতো, কিন্তু কাঠমিস্ত্রির জবাব ছিল এটি বিক্রির জন্য নয় এটি বানিয়েছি মসজিদে আল আকসার জন্য। তার কথাশুনে সবাই হাসতো। কাঠমিস্ত্রিকে পাগল ঠাওরাত। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। একদিন এক ছোট ছেলে তার পিতার হাত ধরে এসেছিল মিম্বরটি দেখতে এবং কাঠমিস্ত্রির কাছ থেকে তার স্বপ্নের কথাও জেনেছিল।ছোট ছেলেটি মনেমনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন সে পূরণ করবে। সময়ের ব্যবধানে সেই ছেলেটি মিম্বরটি আল আকসায় স্থাপন করেছিল। তিনি আর কেউ নয়, দিক বিজয়ী বীর সুলতান গাজী সালাউদ্দিন আইয়ূবী।

১৩ শতাব্দীর শেষের দিকে ক্রুসেডের যুদ্ধ শেষ হলেও ইউরোপিয়ান পক্ষ তাদের মানসিকতা ও আচরণ থেকে ‘ক্রুসেড’ যেন সরাতে পারছেন না। এই বিংশ শতাব্দী ও একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম ভূখণ্ডে যেসব আক্রমণ চালানো হয়েছে; বেপরোয়া ভাবমূর্তিতে অসমতুল্য শক্তির প্রবল প্রয়োগে যে ধ্বংস লীলা চালানো হয়েছে এবং এগুলোতে যে ধরণের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে –এসব বাস্তবতার কীরূপ ব্যাখ্যা মুসলমানেরা গ্রহণ করবে সেটাই হয়ে পড়ে এক মুস্কিলের বিষয়। ইসলামের পবিত্র নগরী মক্কায় পরমাণু বোমা হামলা চালানোর মতো বিষয়ে পড়ানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষণ কলেজে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালানোর কোর্সে এ বিষয়ে পড়ানো হয়। এসব বিষয় অত্যন্ত নাজুক। এসব বিষয় সামনে রাখলে ‘সভ্যতার’ আওয়াজ যে কত অন্তঃসারশূন্য তা সহজেই বুঝা যায়। সুলতান আইয়ুবী কর্তৃক বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ন্ত্রণে নেবার প্রায় ৮০০ বছর পর এবং ইসলামী খিলাফাত ধ্বংসের ৪৩ বছর পর মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করল এক বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা। মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক অনৈক্য ও দুর্বলতার ফলে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস আর মসজিদুল আকসা আবার চলে গেল বিধর্মীদের হতে। খ্রিস্টানদের মদদে সেখানে কর্তৃত্ব নিল অভিশপ্ত ইহুদী জাতি। ৮০০ বছর আগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল সেই পবিত্র মাটিতে। মুসলমানদের রক্তে নতুন করে ভিজতে শুরু করল ফিলিস্তিনের মাটি। যা এখনো বিরাজমান।আজ শুধু ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম মানবাত্মা ক্রন্দন করছে একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জন্য।

১১৯৩ সালের ৪ মার্চ সালাহউদ্দিন দামেস্কে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার ব্যক্তিগত সম্পদের মধ্যে এক টুকরো স্বর্ণ ও চল্লিশ টুকরো রূপা ছিল। তিনি তার অধিকাংশ গরিব প্রজাদের দান করে যান।দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাইরে তাকে দাফন করা হয়। যদিও সালাহঊদ্দীন বহুকাল পূর্বেই ইন্তেকাল করেছেন ,কিন্তু মুসলিমদের হৃদয়ে তিনি আজও জীবিত ক্রুসেডের হৃদয়ে তিনি আতংক ,আর মুসলিমদের হৃদয়ে তিনি খোদার আবর্তিত রহমত।

লেখকঃ সাইফুল ইসলাম