সোনিয়া গান্ধী :সাধারণ পশ্চিমা তরুণী থেকে ভারতীয় বধু হয়ে অসাধারণ হয়ে ওঠা (প্রেম ও বিবাহ অধ্যায়)

0

ইতালির ভেনেত অঞ্চলের  ভিসেনসা নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম লুসেনিয়া। এই গ্রামের রোমান ক্যাথলিক ধর্মালম্বী মাইনো পরিবারে ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করে আন্তোনিয়া মাইনো (পুরো নামঃ আন্তোনিয়া এদভিদ এ্যালবিনো মাইনো) নামের এক কন্যা শিশু। এই কন্যা শিশুই পরে সোনিয়া গান্ধী নামে বিখ্যাত হয়ে যায় ভারতীয় রাজনীতিতে। শিশুকাল থেকেই পড়ুয়া ও মেধাবী সোনিয়া ১৩ বছরে তুরিন শহরে থেকে স্কুল জীবন শেষ করে। স্কুল থেকে প্রাপ্ত সনদে তাকে মেধাবী, মনযোগী, প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

১৪ বছর বয়সে সোনিয়া, ফ্রাঙ্কো লুইসন নামে মোটামুটি নামকরা এক ইতালিয়ান ফুটবলারের প্রেমে পড়ে। ৪ বছরের প্রেম উভয় পরিবারের সম্মতিতে যখন বিয়ের দিকে মোড় নিতে যাবে এমন সময় সোনিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড এ আসতে চায়। প্রেমিক ফ্রাঙ্কো বাঁধা না দিলেও আপত্তি জানায় এতে। কিন্তু বিমান বালা হতে আগ্রহী সোনিয়া ইংল্যান্ডে এসে ইংরেজি ভাষায় উচ্চশিক্ষা নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

সোনিয়া গান্ধী
প্রথম প্রেমিক ফ্রাঙ্কোর সাথে সোনিয়া

১৯৬৪ সালে সোনিয়া ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ শহরের বেল এডুকেশনাল ট্রাস্টের ইংরেজি ভাষায় উচ্চশিক্ষা নিতে ভর্তি হয়। নিজের খরচ জোগাতে সোনিয়া পার্ট-টাইম চাকুরী নেয় এক রেস্টুরেন্টে।

সেসময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে ইংঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জৈষ্ঠ পুত্র রাজীব গান্ধী। রেস্টুরেন্টে প্রথমবার দেখেই ইতালিয়ান অষ্টাদশী তরুণী সোনিয়াকে ভালো লেগে যায় রাজীবের, ‘লাভ এট ফার্স্ট সাইট’! রেস্টুরেন্ট মালিকের সহায়তায় ন্যাপকিনে ছোট একটি কবিতা লিখে সবচেয়ে দামী পানীয়সহ পাঠিয়ে দিলেন সোনিয়াকে এবং দ্রুতই সোনিয়ার সাথে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে নেন রাজীব। তখনো সোনিয়া জানে না এই যুবক ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পুত্র।    রেস্টুরেন্টে দেখা হতে হতে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হয় রাজীব –সোনিয়ার সম্পর্ক। একসাথে সিনেমা দেখতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া চলতে থাকলো দুজনের। শোনা যায় তাদের একসঙ্গে দেখা প্রথম ছবিটি নাকি সত্যজিত্‍ রায়ের পথের পাঁচালি।

রাজীবের ব্যক্তিত্ব এর কাছে ফুটবলার ফ্রাঙ্কোর ব্যক্তিত্ব তুচ্ছ হয়েছিল নাকি কিশোরী বয়সের আবেগ থেকে জন্ম নেয়া প্রেমের আবেগ কমে গিয়েছিল নাকি  ইতিহাসের পাতার অংশ হতে ভাগ্যের লিখনে সাবেক প্রেমিক কে ত্যাগ করে নতুন প্রেমিক বেছে নিল সোনিয়া?

সময়ের সাথে রাজীব-সোনিয়ার প্রেম আরো গভীর হলো। রাজীবের প্রতি সোনিয়ার প্রেম যে কত গভীর ও নিখাদ ছিল তা পরবর্তীতে সোনিয়ার ধৈর্য ও ত্যাগ থেকে অনুমান করা যায়।

ইন্দিরা গান্ধী এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলেন ইংল্যান্ডে। সেখানেই রাজীব পরিচয় করিয়ে দেয় সোনিয়াকে, জানায় তাদের ভালোবাসার কথা। আলাদা ধর্ম, আলাদা সংস্কৃতির কারনে সম্মতি না থাকলেও রাজীবের দৃঢ়তার কাছে আপত্তি জানান নি ইন্দিরা। তাছাড়া নিজেও যে স্বামী ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ে করেছিলেন ভালোবেসেই তাই ভালোবাসার জিদ কেমন হয় সেটা তার জানা আছে। আপত্তি না জানিয়ে বরং সোনিয়াকে বললেন – চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবার ভারত ঘুরে আসো, সেখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতি দেখে, সেখানে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা ভেবে তারপর সিদ্ধান্ত নাও।

কিন্তু এদিকে বাঁধ সাধলেন সোনিয়ার বাবা স্টেফানো মাইনো। বেনিতো মুসোলিনির একনিষ্ঠ সমর্থক, নির্মান ব্যবসায়ী স্টেফানো কোনভাবেই মেয়েকে কোন রাজনৈতিক পরিবারে বিয়ে দিতে রাজি নয়।

পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে সোনিয়া আসলেন ভারতে। উঠলেন গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ বিখ্যাত বচ্চন পরিবারে। কিছুদিন থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়ে দিলেন তার কোন আপত্তি নেই ভারতে থাকতে। ইন্দিরা বুঝে গেলেন সোনিয়া ও রাজীব প্রেমের ব্যাপারে কতটা সিরিয়াস। ফলে মানুষের মুখে নেতিবাচক কথা ছড়ানোর কথা ভেবে দেরি না করে দ্রুত বিয়ের আয়োজন করলেন ইন্দিরা গান্ধী।

সোনিয়া গান্ধী
১৯৬৮ সালে ভারতে আসেন সোনিয়া। ছবিতে রাজীবের সাথে ইন্ডিয়া গেটের সামনে আইসক্রিম খাচ্ছেন সোনিয়া।

কিন্তু বিয়েতে আসতে রাজি হলেন না সোনিয়ার বাবা। তবে আসলেন মা, বোন ও বান্ধবীরা। বাবা আসেন নি কিন্তু এতে কোন সমস্যা বুঝতে দেননি  বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন। যেন নিজের মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন – এমন ভাবে কোন আয়োজনে কমতি রাখেন নি।  ১৯৬৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মহা ধুমধামে বিয়ে হল রাজীব-সোনিয়ার। বিয়ে হলো পুরো হিন্দু রীতি মেনে। ২২ বছরের এক সাধারন ইতালিয়ান তরুণী হয়ে গেল ভারতের বিখ্যাত গান্ধী পরিবারের সদস্য। পশ্চিমা তরুণী থেকে ভারতীয় নারী হওয়ার আয়োজন শুরু হল সেদিন থেকেই। ইন্দিরা গান্ধী পুত্রবধুকে বুঝিয়ে দিলেন সাধারন কোন পরিবারের বধু আসে নি সে। ভারতের মত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি পূর্ন দেশের এক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারেরর বধু সে। তাই ভারতের সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্ম ভালোভাবে মেনেই চলতে হবে তাকে।

সোনিয়া গান্ধী
পুরোপুরি হিন্দুরীতি মেনেই বিয়ে হল রাজীব-সোনিয়া জুটির
সোনিয়া গান্ধী
বিয়ের অনুষ্ঠানে রাজীব-সোনিয়ার সাথে ইন্দিরা গান্ধী ও সোনিয়ার মা পাওলা মাইনো

প্রচলিত আছে, আন্তোনিয়া নামটা স্পষ্ট বিদেশী নাম বলে, সাধারণ ভোটারদের মাঝে বিদেশী ইমেজ দূর করতে ইন্দিরা গান্ধী আন্তোনিয়া নাম পালটে সোনিয়া রাখলেন। যদিও এ অভিযোগ কে মিথ্যা বলে কংগ্রেস। সোনিয়ার বাবা নিজেই ডাকনাম সোনিয়া রেখেছিলেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করার অভিযোগে রাশিয়ায় দুই বছর যুদ্ধবন্দী থাকার সময় রাশিয়ান নামের প্রতি দুর্বলতা জন্মে সোনিয়ার বাবার। তাই এক কন্যার নাম রাখেন সোনিয়া ও আরেক কন্যার নাম রাখেন নাদিয়া। মজার ব্যাপার সোনিয়ার আরেক বোনের নাম আনুশকা। তাই সোনিয়া নামটা ভোটারদের বোকা বানাতে ইন্দিরা গান্ধীর দিয়েছিলেন এ কথাকে কংগ্রেস বিরোধীদের আরেকটি প্রোপাগাণ্ডাই মনে করা হয়।

যা হোক, প্রথমে শাড়িতে সমস্যার কারনে স্কার্ট পড়লেও ধীরে ধীরে শাড়ি পরা, সিদুর দেয়া সবই শিখে গেলেন এই পশ্চিমা নারী।

স্বামী রাজীব গান্ধী পাইলট হিসেবে যোগ দিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে। সুখী দম্পতির ঘরে ১৯৭০ সালে জন্ম নিল প্রথম সন্তান রাহুল। এর দুবছর পর ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় কন্যা প্রিয়াংকা।

সোনিয়া গান্ধী
বামের ছবিতে স্বামী রাজীব গান্ধী এবং ডানের ছবিতে শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দুই সন্তান রাহুল ও প্রিয়াংকাসহ সোনিয়া গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধী চাইলেও রাজীবের কোন আগ্রহ ছিল না রাজনীতিতে আসার।  সোনিয়ারও কোন ইচ্ছা ছিল না স্বামীকে রাজনীতির মাঠে দেখার। রাজনীতিতে আসলো ইন্দিরা গান্ধীর ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর পরে কংগ্রেসের পরবর্তী নেতা হয়ত সঞ্জয়ই হতো কিন্তু ১৯৮০ সালে ২৩ শে জুন এক বিমান দূর্ঘটনায় নিহত হয় সঞ্জয় গান্ধী। ইন্দিরা ভেবেছিলেন সঞ্জয়ের স্ত্রী মেনেকা গান্ধীকেই করবেন নিজের উত্তরসুরী। কিন্তু কংগ্রসের নেতা কর্মীদের দাবী ছিল রাজীবকে রাজনীতিতে আনার। কংগ্রেসের ৭০ জন সদস্য নিজেদের স্বাক্ষরসহ একটি প্রস্তাবে রাজীবকে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানায়।

ফলে না চাইলেও অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে আসতে হয় রাজীব কে। মেনেকা নিজেকে বঞ্চিত ভেবে পরে গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্য কংগ্রেস ছেড়ে চলে আসে বিরোধী শিবির বিজেপিতে। যা এখনো গান্ধী পরিবারে এক চরম বিরোধ বজায় রেখে চলেছে। যা হোক, সে ভিন্ন আলোচনা অন্য কোন লেখায় করা যাবে।

সঞ্জয়ের আসন থেকে এমপি হয়ে লোকসভায় আসেন রাজীব। কিন্তু সঞ্জয় নিহত হওয়ার ৪ বছরের মাথায় ১৯৮৪ সালের ৩১শে অক্টোবর ২ শিখ ধর্মালম্বী দেহরক্ষীর গুলিতে ৩১টি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর স্থানে কংগ্রেসের নেতা কর্মীরা রাজীবকেই চাইলো। প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজীব গান্ধী। তখনো স্বামীর সাথে কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে যাওয়া ছাড়া রাজনীতিতে আসেন নি সোনিয়া।

১৯৯১ সালের ২১মে তামিলনাড়ুর শ্রীপেরামবুদুরে নির্বাচনী জনসভায় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু হল রাজীব গান্ধীর। শ্রীলংকায় তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান চালানোর প্রতিবাদে এই হামলা করে শ্রীলংকার তামিল টাইগাররা (এলটিটিই) ।গায়ত্রী নামের এক মহিলা রাজীবের পদস্পর্শ করার অছিলায় পোশাকের নিচে বাধা আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেয়।

দূর্ঘটনায় সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু, এরপর ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর হত্যাকান্ড, ১০ বছরে ৩ হত্যাকান্ড গান্ধী পরিবারকে দুর্বল করে দেয়। নেতাকর্মীরা সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ করলেও সেটা প্রত্যাখান করেন সোনিয়া। রাজনীতিতে আসতে অপারাগতা দেখান। প্রিয়তম প্রেমিক ও স্বামীকে হারিয়ে বাইরের জীবন থেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। নিজের দুই সন্তানকে আগে শিক্ষা দীক্ষায় বড় করতেই মনযোগী হন তিনি।

তার রাজনীতিতে না আসা নিয়ে অনেকে এও ভাবা শুরু করে সোনিয়া হয়ত ভারত ছেড়ে চলে যাবে। পশ্চিমাদের কাছে তো স্বামীর মৃত্যু বা বিচ্ছেদের পর ২য় বিয়ে কোন ব্যাপার না। হয়ত আরেকটা বিয়ে করবে। কিন্তু সেসব ধারনা যে শুধু ভুল না, পুরোটাই মনগড়া ছিল তা সময়ই প্রমাণ করেছে।

এখনো ভারতে সেরা প্রেমিক জুটির কথা আসলে রাজীব-সোনিয়া জুটির কথা আসে তালিকার প্রথম দিকেই। প্রেমের জন্য নিজেকে যে আমুল বদলে সম্পূর্ন নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে মানিয়ে নেয়া যায় সেটার উজ্জ্বল উদাহরণ তো সোনিয়া নিজেই! স্বামীর মৃত্যুর পর রাজনীতি, নিজের আনন্দ ফূর্তির চেয়ে সন্তানদের শিক্ষিত করে বড় করাটাকেই মূখ্য ভেবে সেদিকেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন সোনিয়া। সন্তানদের বড় করার দায়িত্ব শেষ করেই ফিরলেন রাজনীতিতে।

সোনিয়া গান্ধী
সেরা প্রেমিক জুটির কথা আসলে রাজীব-সোনিয়া জুটির কথা আসে তালিকার প্রথম দিকেই

(চলবে……) [পরের পর্বে থাকবে- সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে পদার্পণ, পশ্চিমা এক নারীর জাত উপমহাদেশীয় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা, সাফল্য, ব্যর্থতা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও তাঁকে নিয়ে বিতর্ক]

লেখকঃ নূর নাহার শেফা