যানবাহন দূর্ভোগে রাজধানীর সাধারণ মানুষঃ সিএনজি অটোরিকশা ও বাস ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য

0

ঢাকার গণপরিবহন গুলোতে চলছে যাত্রী হয়রানির মহাউৎসব। অতিরিক্তভাড়া আদায় সিটিং, গেইটলক, বিরতিহীন সার্ভিসের নামে চিটিংও বন্ধ হয়নি। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সিটিং, গেইটলক সার্ভিস বন্ধ করার সব চেষ্টা মাঠে মারা গেছে এক শ্রেণির মালিকদের কারসাজিতে। সে সময় বিআরটিএ’এর মোবাইল কোর্টের অভিযান শুরু করলে নগরী থেকে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় বাস ও মিনিবাস। এক পর্যায়ে পরিবহন যান সঙ্কটে যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারের সভায় তৃতীয় দফায় সিটিং সার্ভিসের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ঈদুল আজহার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বিআরটিএর পরিচালক শেখ মাহবুব ই রব্বানীকে প্রধান করে বিভিন্ন পেশাজীবীর সমন্বয়ে আট সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। রাজধানী তে যাত্রী দূর্ভোগ

শত চেষ্টা করেও রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। হয়রানিসহ নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাস-মিনিবাসের যাত্রীদের। সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সিক্যাবেও মিলছে না শান্তি। অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করা সিএনজি অটোরিকশা চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা আগের মতোই চলছে, একপ্রকার জিম্মি হয়ে আছে নগরবাসী। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মিটারবিহীন প্রাইভেট অটোরিকশার দাপট। এগুলো বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অথচ ৯ বছরেও অনুমোদন মেলেনি চালকদের জন্য বরাদ্দ করা ৫ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশার। অন্যদিকে, রাজধানীতে ট্যাক্সিক্যাবের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। সঙ্কটের মধ্যেও ট্যাক্সিক্যাবের ফের ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর নগরজুড়ে বাস-মিনিবাসে ভাড়া নৈরাজ্য ত চলছেই। সাথে সিটিং সার্ভিসের নামে নতুন আদলে ভাড়ার নামে স্বেচ্ছাচারিতা তো আছেই।

সাধারণ যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নগরীর বেশিরভাগ বাসেই বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করা হচ্ছে। রাজধানীর নর্দা বাজার থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার না হলেও এর জন্য গুনতে হয় ২৫ টাকা ভাড়া। মিরপুরের কালশী সড়কের মাটিকাটা অংশে ইসিবি চত্বর থেকে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের দূরত্ব মাত্র ১ কিলোমিটার। বিআরটিএ-এর হিসাব অনুযায়ী এই দূরত্বের সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। অথচ বাসগুলোা এর ভাড়া আদায় করছে ২৫ টাকা। সিটিং সার্ভিসের নামে এভাবেই যাত্রীদের কাছ থেকে গলা কাটা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। জানতে চাইলে একাধিক বাস কোম্পানীর মালিক ভাড়া নিয়ে অসঙ্গতির কথা স্বীকার করে বলেন, মিরপুর ১ নম্বর থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ১৫ টাকা। কিন্তু মিরপুর বাংলা কলেজ থেকেও একই ভাড়া নেয়া হয়। আবার কল্যাণপুর টেকনিক্যাল মোড় থেকে মিরপুর ১ নম্বরের ভাড়া ১০ টাকা। একইভাবে মিরপুর ১২ নম্বরের ভাড়াও ১০ টাকাই। মালিবাগ আবুল হোটেল থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা পর্যন্ত ২০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। অথচ এ পথের ভাড়া ১০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এই অসঙ্গতি দূর করা নিয়ে মালিকপক্ষের কোনো চেষ্টা নেই উল্লেখ করে একজন সাধারণ যাত্রী বলেন, টেকনিক্যাল থেকে মিরপুর এক নম্বরের দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি নয়। কিন্তু এ জন্য ১০ টাকা নিচ্ছে তারা। এ কারণেই যাত্রীদের সাথে বাসের সুপারভাইজার- হেলপারদের বাকবিতন্ডা হয়, মারামারি হয়।

ভুক্তভোগিদের মতে, গণপরিবহনে ভাড়া নিয়ে যাত্রী আর বাসের সুপারভাইজারদের বাকবিতন্ডা প্রতিদিনের চিত্র। মাঝে মাঝে তা পৌঁছে যায় হাতাহাতি পর্যায়ে। বিশেষ করে সিটিং সার্ভিসের অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে সব বাসেই ঝামেলা হয়। এ কারণেই সিটিং সার্ভিস পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন মালিকপক্ষের অনেকেই। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ১১৬ দশমিক ৮ বর্গমাইল আয়তনের রাজধানীতে ১২২টি রুটে চলাচল করে প্রায় ৫ হাজার বাস-মিনিবাস। অথচ ঢাকার জনসংখ্যা এখন প্রায় ২ কোটি। জনসংখ্যার তুলনায় রুট ও গণপরিবহন কম থাকায় প্রতিদিন ভোগান্তিতে পড়ছে লাখো মানুষ। সাধারণ মানুষের এসব ভোগান্তির সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন গণপরিবহন কোম্পানি। গত জুন মাসে নগরীর সিটিং সার্ভিস বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। তাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৮৮ শতাংশ গাড়ি চলাচল করছে সিটিং সার্ভিস লোগো লাগিয়ে। এগুলোতে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। নির্ধারিত স্টপেজ বাদ দিয়ে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে বাসগুলো যাত্রী ওঠা-নামা করায়।

জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা শহরে ১৫৯টি কোম্পানির বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। এর মধ্যে বাস ৪ হাজার ৯৩৭টি এবং মিনিবাস রয়েছে ২ হাজার ৮২৯টি। ৩২০টি রুটের মধ্যে ১৮০ থেকে ১৯০টি রুট সচল রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন খাতের নৈরাজ্যের জন্য দায়ী বেসরকারি বাস কোম্পানির ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা। এই নির্ভরতার সুযোগে যখন-তখন মানুষকে জিম্মি করে যান চলাচল বন্ধ রাখতে পারেন মালিকরা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পাশাপাশি সুবিধামতো যে কোনো বাসকে যখন তখন সিটিংয়ে রুপান্তরিত করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত ভাড়ার বৈধতা আদায়ে নিত্য-নতুন কৌশল অবলম্বন করতেও দ্বিধা করে না মালিকপক্ষ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটিং সার্ভিস চলবে কিনা- এ নিয়ে গঠিত কমিটির প্রথম বৈঠক হয় গত ১৪ মে। সিটিং সার্ভিসের জন্য পৃথক ভাড়া নির্ধারণের সুপারিশ আসে বিআরটিএ অফিসে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে। গত বৃহস্পতিবার কমিটির সর্বশেষ সভায় গণপরিবহনের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং সিটিং সার্ভিস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে ১০টি সুপারিশ করেছে এই কমিটি। কমিটি সূত্র জানায়, আগামী ঈদ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সিটিং সার্ভিসের।

তবে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নির্ধারণসহ গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে সিটিং ও নন সিটিং গাড়ির রং আলাদা করা হবে। এর সঙ্গে সিটিং সার্ভিসের ভাড়া এবং রুট নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। গণপরিবহনের মালিকানা থাকবে চার-পাঁচটি কোম্পানির হাতে। এতে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো এবং গাদাগাদি করে যাত্রী তোলার দৌরাত্ম্য কমবে। সিটিং সার্ভিসের স্টপেজ আলাদা থাকবে। নির্দিষ্ট স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা করানো যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগাতে হবে। এতে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে বা কোনো অপরাধ করলে তাদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনা যাবে। পথচারী পারাপারে রাস্তায় জেব্রাক্রসিং থাকবে।

এদিকে, ৪৫০টি ট্যাক্সিক্যাব নগরীতে যাত্রীর তুলনায় সংখ্যায় খুবই নগণ্য। প্রয়োজনমতো ট্যাক্সিক্যাব না পাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। সাথে বাড়তি ভাড়া তো আছে। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্য শুরু থেকেই বিদ্যমান। বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে অনুমোদিত সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ১১ হাজার ৪৮১টি। দুই দফায় এসব গাড়ির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আরেক দফা বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চলছে। মিটার থাকা সত্তে¡ও অটোরিকশায় বাড়তি ভাড়া দাবি এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। মালিকপক্ষ জমার পরিমান ৬০০ টাকা বাড়িয়ে ৯০০ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১১শ টাকা করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রাইভেট সিএনজি। ঢাকায় এর সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশকে ম্যানেজ করে এগুলো চলছে। ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন নিয়ে এসব অটোরিকশা এখন বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এর বৈধতা আদায়ে ‘ঢাকা মহানগর প্রইভেট সিএনজি অটোরিকশা মালিক কল্যাণ সমিতি’ নামে একটি সংগঠনও গঠন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। সিএনজি মালিক-শ্রমিকরা অটোরিকশা সেক্টরে বিশৃঙ্খলার জন্য এখন প্রাইভেট সিএনজিকেই দায়ী করে থাকেন।

অপরদিকে, ২০০৭ সালে শুধু চালকদের জন্য ৫ হাজার অটোরিকশা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত বহুদিন ধরে ঝুলে আছে। এ নিয়ে মামলা শেষ হওয়ার পরেও একটি চক্র কৌশলে এ বরাদ্দকে আটকে রেখেছে বলে ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জানান। তিনি বলেন, প্রতিবছর প্রায় ৩৭ হাজার গাড়ি ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছে, যার ৮০ শতাংশ হচ্ছে প্রাইভেট কার বা ব্যক্তিগত গাড়ি। অথচ চালকদের সিএনজিচালিত অটো বিতরণ করা হচ্ছে না যানজট সৃষ্টির অজুহাতে। এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না আনলে রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান কখনই হবে না বরং বাড়বে। তিনি বলেন, আমরা অনেক আগে থেকেই সিটিং সার্ভিসের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ এবং গণপরিবহনে সেবার মান বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু দফায় দফায় সিটিং সার্ভিসের মেয়াদ বাড়লেও যাত্রীদের দুর্ভোগ কমছে না।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে