জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি। এ মামলার আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হবে কি না, তা নিয়ে বিএনপির রয়েছে নানা আলোচনা, হিসাব-নিকাশ। রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে দলের প্রতিক্রিয়া বা কর্মসূচি কী হবে, তা নিয়ে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি দলীয় চেয়ারপারসন জেলে গেলে সেই সময় দল কীভাবে চলবে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, দল পরিচালনায় কোনো সমস্যা হবে না। অবশ্য এই নেতারা মনে করেন, যে মামলায় খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। তবু ‘রাজনৈতিক’ কারণে চেয়ারপারসনকে জেলে নেওয়া হলে দল কীভাবে পরিচালিত হবে, সে ব্যাপারে একটা ধারণা শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আছে। বিএনপির এই নেতারা বলছেন, মূলত লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের পরামর্শে দল পরিচালিত হবে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটি ও মহাসচিব তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে করণীয় নির্ধারণ করবেন। এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন।
বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া বিদেশে অবস্থানের সময় স্থায়ী কমিটি ও মহাসচিব তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে দল পরিচালনা করেন। এখন চেয়ারপারসন অনুপস্থিত থাকলে দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেকের পরামর্শে চলবে, এটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৫(গ) ধারায় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তির মর্যাদা দিয়েছে। চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটির সভা ডাকাসহ চেয়ারপারসনের অন্য সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দল পরিচালানায় এই দুজন ছাড়া অন্যদের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কেননা এ দুজনের বাইরে কেউই দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক ডাকতে পারেন না। আর এ বৈঠক না হলে কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন পায় না।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘তিন মাস যে খালেদা জিয়া ছিলেন না (চিকিৎসার জন্য লন্ডনে ছিলেন), আমরা বিএনপি পরিচালনা করেছি না? স্থায়ী কমিটির মেম্বাররাই আমরা সময়-সময় বসে যেটা ভালো মনে করেছি, সেটা মহাসচিব বাস্তবায়ন করেছেন। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি হবে না বলে আমাদের বিশ্বাস। আর যদি হয়, তাহলে আমরা স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সমষ্টিগতভাবে আলোচনা করে আমাদের দল পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেব।’
প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনে আছেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করার সুযোগ থাকবে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে যৌথ নেতৃত্বে আমরা দল পরিচালনা করব। আমি মনে করি যে এই মামলা সাজানো, বানোয়াট এবং ভিত্তিহীন। কোনো সাক্ষী, কোনো দলিল–প্রমাণাদি কোর্টে দিতে পারেনি সরকার বা দুদক, যেটাতে খালেদা জিয়ার কোনো সম্পৃক্ততা আছে। অতএব কোনো শাস্তিই হবে না। আমরা মনে করি, তিনি সম্মানজনকভাবে খালাস পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘ওই পরিস্থিতি আমরা চিন্তাই করছি না। আর ওই পরিস্থিতি যখন হবে, তখন আমাদের দ্বিতীয় নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে দলের মহাসচিব আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে দল চালাবেন। দল চালানোর ব্যাপারে কোনো রকমের কোনো সমস্যা হবে না। আমি মনে করি, খালেদা জিয়ার জন্য এমন পরিস্থিতি আসবেই না।’
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে হয়রানি করার জন্য ‘জাল নথি’ ও ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা সাজানো হয়েছে। এই মামলায় সাক্ষী ও বিচারপ্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছতা’ নিয়েও তাঁরা আশ্বস্ত নন। যে কারণে তাঁরা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে সম্মানজনকভাবে এই মামলায় খালাস দেওয়া হবে। এ ছাড়া কোনো কারণে যদি খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বিএনপি এর প্রতিবাদ করবে। সরকার পতনের আন্দোলনই হবে বিএনপির সেই প্রতিবাদ। দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন তারেক রহমান দেশের বাইরে থাকলেও দেশে থাকা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দল পরিচালনায় কোনো সমস্যা হবে না। সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসনের নির্দেশনায় দল পরিচালিত হবে।
গুলশানে গত শনিবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রায়ে যদি খালেদা জিয়ার সাজা হয়, সে ক্ষেত্রে দলের রাজনৈতিক ও আইনগত প্রক্রিয়া কী হবে, সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। রায়ের পর বিএনপির প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত, সেটিও আলোচনায় এসেছে। এ ছাড়া রায়ের পর বিএনপি নেতা-কর্মীদের প্রতিক্রিয়ার কারণে সরকার তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়িয়ে দেবে কি না, সেটি আলোচনা করেছেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শনিবার দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, তড়িঘড়ি করে খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা সরকারের ষড়যন্ত্র বলে মনে করে স্থায়ী কমিটি। তিনি বলেন, ‘এ রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গোটা জাতি আজ ক্ষুব্ধ। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য এবং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনকে নষ্ট করার জন্য এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্র। স্থায়ী কমিটি এর নিন্দা জানাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।’
মামলার রায়ের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি এখনো অনেক দেরি। এর আগে দলের স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটির সভা হবে। এসব জায়গায় রায়ের বিষয়ে কথা হবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অনেক বিষয় আছে। তিনি বলেন, ‘দেখুন, রায়টি যদি বিচারিক হতো, তাহলে প্রত্যাশার জায়গা ছিল। এটি বিচারিক রায় হচ্ছে না। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে এই রায় হবে রাজনৈতিক। এই রায়ে শুধু বিএনপি না, জনগণের আশার কোনো প্রতিফলন থাকবে না।’