সবুজ ঘাসের উপরে লাল জামা পরিহিতা নারীর মৃতদেহ- মাত্র কয়েকদিন আগেও পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বহুল আলচিত এক ছবি। যে ছবি জাগিয়েছে হতাশা, বাড়িয়েছে ক্ষোভ।
সকলেরই ধারনা ছিল টানা ধর্ষণ করে এবং পরে মামলা করায় ধর্ষক নিজেই হত্যা করেছে ধর্ষিতাকে। কিন্তু ধর্ষককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষক স্বীকার করে সে ধর্ষণ করেছে ঠিকই কিন্তু খুনের সাথে জড়িত নয়। পুলিশ অবাক হলেও অবিশ্বাস করতে পারলো না। এরকম পরিস্থিতিতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে হত্যার কথা অস্বীকার করার কথা না। তাহলে কি আসলেই সে খুন করে নি?
পুলিশের তদন্তে বেড়িয়ে আসলো অবিশ্বাস্য কাহিনী, যেন কোন রহস্য উপন্যাস বা সিনেমার গল্প! ভিলেজ পলিটিক্স এর কুটিল দৃষ্টান্ত।
শনিবার বিকালে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পুলিশ সুপার বিধান ত্রিপুরার ব্রিফিং এর তথ্য অনুযায়ী- ধর্ষণকারী বাবুল মিয়া অলিপুরে প্রাণ কোম্পানিতে সুপারভাইজার হিসাবে চাকরি করতো। বাবুল মিয়ার মা বিগত ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। ফলে এলাকায় তার অর্থ এবং প্রভাব রয়েছে। তবে সে দুশ্চরিত্র লোক। এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ইতোপূর্বে বিয়ে করে বাবুল।
একই এলাকার ছায়েদ মিয়ার মেয়ে বিউটি আক্তারের উপর দৃষ্টি পরে বাবুলের। বিউটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখায় বাবুল। বাবুল অলিপুর এলাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বিউটিকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করে।
৯ ফেব্রুয়ারি বিউটিকে প্রাণ কোম্পানিতে চাকরি দিবে বলে সেখানে নিয়ে যায় বাবুল। খবরটি কানে যায় পারেন পাশেই আরএফএল কারখানায় চাকরি করা বিউটির মা হুসনা বেগমের। তিনি এবং বিউটির বাবা ছায়েদ মিয়া প্রাণ কোম্পানিতে গিয়ে নিখোঁজ মেয়েকে উদ্ধার করেন।
পরে বিষয়ট জানাজানি হলে এলাকায় সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাবুল বিউটিকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় সালিশে কোনো সমাধান হয়নি।
অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে ৪ মার্চ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়।
এরই মধ্যে ১২ মার্চ আবারো ইউপি চেয়ারম্যান জজ মিয়ার নেতৃত্বে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু মামলা হওয়ায় কোনো সালিশ হয়নি। ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় আনা হয়। পরে মেডিকেল করার পর আদালতে সে ২২ ধারায় জবানবন্দ দেয়। বাবুল মিয়া তাকে বিয়ে করলে মামলা তুলে নেবে বলেও সেখানে জানায়।

বিউটিকে বাড়িতে আনার পর দিশেহারা হয়ে পড়েন বিউটির বাবা ছায়েদ মিয়া। বাড়িতে না রেখে বিউটিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় লাখাই উপজেলার গুণিপুর গ্রামে তার নানি ফাতেমা বেগমের বাড়িতে।
এই সুযোগে নতুন করে এক জটিল ও কুটিল খেলা খেলে বিউটির চাচা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ময়না মিয়া। গত ইউপি নির্বাচনে ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ড থেকে সংরক্ষিত নারী আসনের মেম্বার পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার ও ধর্ষক বাবুল মিয়ার মা কলমচান বিবি। কথা ছিল কলমচান বিবি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আসমা আক্তারকে ছাড় দেবেন। শেষ পর্যন্ত কথা না রেখে কলমচান বিবি নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়ী হন। পরাজিত হয় ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার।
এর পর থেকেই ময়না মিয়া ও বাবুল পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এরই জের ধরে বিউটিকে অপহরণের পর ধর্ষণের ঘটনায় মামলায় সাক্ষী হয় ময়না মিয়া। মামলায় আসামি করা হয় বিজয়ী মেম্বার কলমচান বিবি ও তার ছেলে বাবুল মিয়াকে।
ময়না মিয়া ছায়েদ মিয়াকে বোঝাতে থাকেন- বাবুল যদি বিউটিকে বিয়ে না করে তাহলে এই নষ্ট মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না। অন্য সন্তানদেরও বিয়ে হবে না। বরং যদি বিউটিকে মেরে বাবুল মিয়া ও তার মা কলম চান বিবিকে ফাঁসানো হয় তাহলে প্রতিশোধও নেয়া হবে এবং তার অন্য সন্তানরা রক্ষা পাবে।
একপর্যায়ে ময়না মিয়ার ফাঁদে পা দেন ছায়েদ মিয়া। ময়না মিয়া ১০ হাজার টাকায় একজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করে ।
পরে ঘটনার দিন রাতে ছায়েদ মিয়া, ছায়েদ মিয়া ও ভাড়াটে খুনি গুণিপুর গ্রামে গিয়ে বিউটির নানি ফাতেমা বেগমকে জানায়, বিউটিকে চেয়ারম্যানের কাছে নেয়ার জন্য তারা এসেছেন। ওই দিনই লাখাই উপজেলার হরিণাকোন গ্রামে রাত ২টার দিকে বিউটিকে হত্যা করা হয়।
ভাড়াটে ওই লোক বিউটির হাত-পা বেঁধে রাখে আর ময়না মিয়া ছুরি দিয়ে পাঁচটি আঘাত করে হত্যা করে। পরে রক্ত ধুয়ে লাশটি হাওরে ফেলে রাখা হয়। ঘটনা শুনে ১৭ মার্চ নানি ফাতেমা বেগম বিউটির বাড়িতে আসলে তাকে শাসিয়ে দেয়া হয় কোনো কিছু না বলার জন্য।
পুলিশ সুপার আরো জানান, মেয়ে হত্যার পর একজন বাবার যে অনুভূতি থাকার কথা ছিল তা তার চেহারায় ছিল না। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তার এবং ময়না মিয়ার গুণিপুর গ্রামে উপস্থিতির প্রমাণ এবং তাদের আচরণে সন্দেহ হলে পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে। এর মাঝে ময়না মিয়াকে ৫ এপ্রিল এবং ছায়েদ মিয়াকে ৬ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়।
তিনি বলেন, ভাড়াটে লোকটিকে ধরতে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই সকল পরিকল্পনাকারী এবং হত্যাকারীকে আইনের আওতায় এনে অভিযোগপত্র দাখিল করে বিচার শুরু করা যাবে।
এসপি বলেন, বাবুল মিয়া সরাসরি হত্যায় জড়িত না থাকলেও তার কারণেই এই ঘটনা ঘটেছে। অবশ্যই তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে মামলার অভিযোগপত্রে রাখা হবে।
আদালতে বিউটির নানি ফাতেমা বেগম তার জবানবন্দিতে বিউটিকে রাতে কে নিয়ে এসেছে, কিভাবে নিয়ে এসেছে এবং তাকে কী বলে নিয়ে এসেছে এসব বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণণা দেন।
বিউটির বাবা এবং মামলার বাদী ছায়েদ আলী শনিবার পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী জবানবন্দিতে নিজেই অকপটে স্বীকার করেন মেয়ে হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততা। তিনি জানান, হত্যার রাতে নিজেই নানার বাড়ি থেকে নিয়ে এসে বিউটিকে তুলে দিয়েছেন খুনিদের হাতে। ধর্ষণকারী বাবুল নয়, মামলার সাক্ষী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, বিউটির চাচা ময়নাই হত্যাকারী।
সম্প্রতি ধর্ষণকারীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করার দাবী দেখা যায়, দুজনের ক্রসফায়ারে হত্যায় অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেছেন কিন্তু এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আইনি কাঠামোতেই বিচার হওয়া জরুরী। এতে প্রকৃত ঘটনা ও সকল অপরাধীকে আইনি আওতায় আনা যায়। বাবুল মিয়াকে যদি গ্রেফতারের পরেই ক্রসফায়ারে দেয়া হত তাহলে কি জানা যেত পিতা , চাচার এই নির্মম অবিশ্বাস্য ভিলেজ পলিটিক্স এর কাহিনী?