সামান্য জলোচ্ছ্বাসেই ভেঙে যায় বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নের বাঁধ। ফলে পায়রা নদী পাড়ের এ গ্রামটিতে বছর জুড়েই লেগে থাকে বাঁধ ভাঙার আতঙ্ক। এবার ইয়াসের ছোবলেও যার ব্যতিক্রম হয়নি। মাটি ক্ষয়ে বাঁধের উচ্চতা কমে যাওয়ায় এবার ইউনিয়নের রামরা পয়েন্টে উপচে উঠে গ্রাম প্লাবিত করেছে ইয়াসের প্লাবন। জাঙ্গালিয়া আর পাতাকাটা পয়েন্টে ভেঙেছে বাঁধ। এলাকাবাসী দিন-রাতের পরিশ্রমে কোনোভাবে শেষ রক্ষা করতে পারলেও বর্তমানে হাঁটা মেঠোপথের মতো কোনোভাবে টিকে আছে বাঁধের সরু অংশ। আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মজিবুল হক কিসলু বলেন, ‘বাঁধ ভেঙে পায়রা নদীর পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হওয়া এখন আমাদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। বিষয়টি নিয়ে বহুবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে গিয়েছি আমরা। আবেদনের পর সামান্য কিছু মাটি আর জিও ব্যাগ ফেলে ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত ছাড়া আর কিছুই করে না তারা। ফলে পরের যে কোনো উঁচু জোয়ারেই আবার ভেঙে যায় মেরামত করা অংশ।’
আয়লা পাতাকাটার মতোই দুঃখ দক্ষিণের নদী তীরে বসবাস করা লাখো মানুষের। ৫০-৬০ বছর আগে নির্মাণ করা বাঁধগুলোই যেন এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। উঁচু জোয়ার কিংবা সামান্য জলোচ্ছ্বাসের চাপও সামলাতে পারে না পুরনো এসব বাঁধ। তার ওপর ক্রমাগত মাটি ক্ষয়ে অধিকাংশ বাঁধগুলোই হারিয়ে ফেলেছে তার স্বাভাবিক উচ্চতা। ফলে ঝড় জলোচ্ছ্বসেরও দরকার হয় না। উপচে আসা এসব পানি আটকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। মাসের পর মাস পানিবন্দি হয়ে থাকে মানুষ। উপকূলের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে যেখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এসব বাঁধ সেখানে বাঁধের মেরামত কিংবা টেকসই উন্নয়ন প্রশ্নে বছরের পর বছর ধরে চলছে গাফিলতি। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসে কোথাও বাঁধ ভাঙলেই পরে খানিকটা মাটি কিংবা বালুর বস্তা ফেলে দায়িত্ব সারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এসব বিষয় নিয়ে অবশ্য প্রকাশ্যে মুখ খোলেন না পাউবোর কর্তাব্যক্তিরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ’৭০-এর জলোচ্ছ্বাসের পরেই মূলত শুরু হয় উপকূলীয় এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় বাঁধ নির্মাণের কাজ। এর আগের ৫০ বছরের জোয়ারের সর্বোচ্চ উচ্চতা এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করা হয় বাঁধের উচ্চতা। পরিকল্পনা অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে নির্মাণ করা হয় প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার বাঁধ। পরে অবশ্য তা আরও ৪৩০ কিলোমিটার বাড়ানো হয়। বিশাল দৈর্ঘ্যরে এ বাঁধের মধ্যে দক্ষিণ উপকূল অর্থাৎ দক্ষিণের ৬ জেলায় রয়েছে ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার। ৮২টি পোল্ডারে থাকা এ ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার বাঁধ দিয়েই চলে দক্ষিণের সমুদ্র উপকূল আর নদী তীরের মানুষকে রক্ষার চেষ্টা। তবে একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে পড়া আর যথাযথ সংস্কারের অভাবে সেই চেষ্টা এখন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। আর এজন্যে দায়ী বরাদ্দের অভাব। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না মেলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের যথাযথ মেরামত কিংবা টেকসই উন্নয়নের কোনো কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। পাউবো সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানা ব্যাপক বিধ্বংসী ঝড় সিডর-এ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণ উপকূলের ১৮০ কিলোমিটার বাঁধ। সে সময় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাঁধের দৈর্ঘ্য ছিল ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এরপর ২০০৯ সালের আইলা এবং ২০১৩ সালের মহাসেনর আঘাতে দক্ষিণ উপকূলের ৫২৭টি বাঁধের মধ্যে পুরোপুরি এবং আংশিক মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৭৪ কিলোমিটার বাঁধ। গত বছরের মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আম্পানও গুঁড়িয়ে দিয়ে যায় মোট বাঁধের ১৬১ কিলোমিটার অংশ। সর্বশেষ ইয়াসে দক্ষিণের ৬ জেলায় ১২ পয়েন্টে ভেঙেছে বাঁধ। সর্বশেষ এ আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের দৈর্ঘ্য ৮৮ কিলোমিটারেরও বেশি। সবমিলিয়ে গত ১৪ বছরে ২ হাজার ১০০ কিলোমিটারের বেশি বাঁধ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এই সময়ে টেকসই সংস্কার হয়েছে মাত্র ৫৯ কিলোমিটার বাঁধে। বাকি অংশগুলোতে চলেছে শুধুই জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। যে কারণে প্রায় ৫০ বছর আগে নির্মিত এ বাঁধগুলো এখন আর সাধারণ মানুষের জানমালের রক্ষা বলতে কিছুই করতে পারছে না। বরং ভাঙা অংশ কোনোরকমে মেরামত করতে গিয়ে আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে পুরোনো বাঁধ। সামান্য জোয়ারের চাপেই ভেঙে যাচ্ছে সেগুলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডর বরিশাল অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘বাঁধগুলোর টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি উচ্চতা বৃদ্ধি শুধু আলোচনার বিষয় নয়, এটা এখন বাস্তবতা। বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা প্রতি বছরই নতুন নতুন প্রকল্প তৈরি করছি এবং মন্ত্রণালয়ে জমা দিচ্ছি। অনেক প্রকল্পের অনুমোদনও পাওয়া গেছে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে তা হলো আর্থিক সীমাবদ্ধতা। চাহিদা আর বরাদ্দের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও এ সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সব কাজ এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছি আমরা। খেয়াল করলে দেখবেন পূর্বের তুলনায় বর্তমানে কিন্তু ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভাঙার আয়তন কমছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় উপকূলীয় এলাকায় ইসিআরআরপি এবং সিইআইপি প্রকল্পের আওতায় ৪৮ পয়েন্টে বাধ উঁচুকরণ-সংস্কার এবং ৫৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাঁধ নতুনভাবে উঁচু করে নির্মাণ কাজ চলছে।’