ঢাকা অ্যাটাকঃ গল্প হলেও সত্যি!

1
ঢাকা অ্যাটাক

ঢাকা অ্যাটাক “হ্যান্ডস আপ! আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না!!”- কিছুদিন আগে পর্যন্ত এটাইছিল ঢাকাই চলচ্চিত্রের পুলিশের বহুল উচ্চারিত সিগনেচার ডায়লগ। ঢাকাইচলচ্চিত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সবার মস্তিষ্কে একটা ধারনাই বদ্ধমূল হয়েছিল- “পুলিশ তো আসবে একদম মুভির শেষে, সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পর! এর আগেমুভির মাঝখানে পুলিশের আর কাজ কী?!”

হ্যা, একদম শেষ মুহুর্তে ছাড়া পুলিশের দেখাই মিলত না বাংলা চলচ্চিত্রে, যেখানে কিনা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে চব্বিশঘণ্টাই আমরা পুলিশের সেবা ভোগ করছি! অপরাধ এবং অপরাধীর নগরী ঢাকা কীভাবেআমাদের বাসযোগ্য হল, কাদের রাত জাগার কারণে আমরা রাতে আরাম করে ঘুমাতেপারছি, কারা আমাদের চলার পথের কাটাগুলোকে প্রতিনিয়ত আমাদের পথ থেকে সরিয়ে সেই পথকে আমাদের চলার উপযোগী করছে- এই ব্যাপারগুলো আগে কখনোই বাংলাচলচ্চিত্রে স্থান পায় নি!

এই ব্যাপারগুলোই উঠে এসেছে সানি সানোয়ার ভাইয়ের রচনা এবং দীপঙ্কর দীপন দা’রপরিচালনায় নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ এ্যাকশন থ্রিলার “ঢাকা অ্যাটাক”চলচ্চিত্রে। এই চলচ্চিত্রটিকে শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র বললে ভুল-ই হবে, এটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাজারো ত্যাগ এবং বলিদানের একটি অনবদ্যউপাখ্যান। সেই সঙ্গে এটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক স্থাপনকারী চলচ্চিত্রও বটে!
ঢাকা অ্যাটাক

“ঢাকা অ্যাটাক” গল্প হলেও সত্যি। এই গল্পের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক হলেও বাস্তব। আর বাস্তব বলেই প্রতিটি চরিত্রই একদম দর্শকদের মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত! যারা এই ছবিটি দেখতে বসবেন, বাজি ধরে বলতে পারি যে ছবি শেষ না হওয়া অবধি আসন ছেড়ে উঠতে পারবেন না এক মুহুর্তের জন্যেও! ছবিটি দেখতে দেখতে প্রতি মুহুর্তেই একরাশ উত্তেজণা এবং এক ঝাক প্রশ্নের তীর আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে! লাশের পকেটে হাসি কেন? ভাড়াটে অপরাধীরা একে একে খুন হয়ে কীসের অশনি সংকেত দিতে চাইছে? পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়া মাস্টারমাইন্ড আতঙ্কবাদী আসলে কী চায়? তার উদ্দেশ্য কী? তার পরবর্তী টারগেট কে? বা কারা?? পুলিশ কি পারবে তাকে ধরতে? পারবে তার পৈশাচিক ধ্বংসলীলা থামাতে?? নাকি সেইচিতার চাইতেও ধূর্ত আতঙ্কবাদীর বোণা জালে পুলিশও জড়িয়ে পড়বে?? পুলিশও কি তবে তার পৈশাচিক আনন্দের খোরাকে পরিণত হবে??? তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এসি আবিদ রহমান কি পারবে খলনায়কের তৈরি করা জটিল ডিজাইনের বোম্বটি ডিফিউজ করতে? সোয়াট কমান্ডার আশফাক কি নিজের ডিউটি ছেড়ে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর কাছে ছুটবেন? মানসিক বিকারগ্রস্থ জিসানেরই বা কী পরিণতি হবে??!!!

ওপরের সব প্রশ্নের উত্তর একে একে পাওয়া যাবে, কিন্তু সেটা অবশ্যই টানটানউত্তেজণায় ভরপুর এই ছবিটি দেখার পর। আর এটা ২১ ইঞ্চি মনিটর কিংবা টিভিরপর্দায় কোনো রকমে দেখে শেষ করার মত ছবি না, এটা আকাশ সমান স্ক্রীণে দু’চোখভরে দেখার মতই একটা দুর্দান্ত ছবি!

ঢাকা অ্যাটাক
প্রথমত ছবিটির কাহিনী রচনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের এডিসি এবং বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান সানি সানোয়ার ভাই। পুরোকাহিনীতে কোথাও কোনো রকম ফাঁক ফোকড় রাখেন নি তিনি। আর দ্বিতীয়ত ছবিটির নির্মাণ কার্যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নির্মাতা দীপঙ্কর দীপন দা। চলচ্চিত্রে দীপন দা’র গল্প বলার ধরন খুবই ভালো ছিল। এক দৃশ্যের পর আরেক দৃশ্যের প্লেসমেন্ট তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে করেছেন, যার ফলে দর্শক একটি বারের জন্যেও পর্দা থেকে চোখ ফেরানোর সুযোগ পায় নি! যদিও ছবির কিছু কিছু জায়গায় সামান্য কিছু ভুল ছিল, ভুলগুলো এতই সামান্য যে “মানুষ মাত্রই ভুল হয়”তত্ত্বের ভিত্তিতে সেসব ভুলকে ভুলে যাওয়াই যায়!
ঢাকা অ্যাটাক

এবারে আসি অভিনয়ের প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলব আরিফিন শুভ ভাইয়ের কথা। তিনি এসি আবিদের চরিত্রটিকে চমৎকার ভাবে নিজের মাঝে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তার বডি ল্যাংগুয়েজ, ডায়লগ ডেলিভারি সবকিছু মিলিয়ে পুরো ছবিতেই তাকে একজন সত্যিকারের পুলিশ অফিসার বলেই মনে হয়েছে। যদিও তার হেয়ারস্টাইল তার চরিত্রের সঙ্গে কিছুটা বেমানান ছিল, এবং একেক দৃশ্যে তার একেক রকম হেয়ার স্টাইল দেখা যাচ্ছিলো,তবুও বলব আরিফিন শুভ একজন পারফেক্ট নায়ক। অন্যদিকে সোয়াট কমান্ডার আশফাকের ভূমিকায় নবাগত এবিএম সুমনের অভিনয় বেশ ভালো এবং ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিল। এই ছবিতে তার অভিনয়ে ব্যক্তিত্বের ছাপ পাওয়া গিয়েছে, যা তার পূর্ববর্তী দু’টো ছবিতে ছিল না। আমরা তার পরবর্তী ছবি গুলোতেও এরকম অভিনয়ই দেখতে চাই। ডিসি সাজেদুল করিমের ভূমিকায় শতাব্দী ওয়াদুদ ভাই এক কথায় অসাধারণ ছিলেন। শতাব্দী ওয়াদুদ ভাইয়ের মত একজন জাঁদরেল অভিনেতার অভিনয় নিয়ে মন্তব্য করার মত দুঃসাহস আমার একেবারেই নেই! তিনি বরাবরই একজন শক্তিশালী অভিনেতা। আশফাকের স্ত্রীর ভূমিকায় নওশাবার অভিনয়ও অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ছিল। একবারের জন্যেও মনে হয় নি যে নওশাবা অভিনয় করছেন। তবে এই ছবির কোনো দুর্বল দিক যদি থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে মাহিয়া মাহির অভিনয়। তার অভিনয়ের মধ্যে অনেকটাই মেকি ভাব ছিল। যদিও তার পূর্ববর্তী ছবিগুলোর তুলনায় এখানে তার অভিনয় অনেকাংশেই উন্নতমানের হয়েছে, তবুও এত অসাধারণ একটা ছবির এত টানটান উত্তেজণাময় মুহুর্তে মাহিয়া মাহির ন্যাকামো যেন ঠিক হজম হচ্ছিলো না(তারমানে অবশ্যই এটা নয় যে সে খারাপ অভিনেত্রী, বরং তার ঐ ন্যাকামো গুলো বাদ দিলে নিঃসন্দেহে সে একজন ভালো অভিনেত্রী)!
ঢাকা অ্যাটাক
ঢাকা অ্যাটাক

এই অসাধারণ চলচ্চিত্রটিতে ভিলেনের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তার সম্পর্কেএক প্যারায় লিখে শেষ করা যাবে না। এই চলচ্চিত্রে সবাই-ই নায়ক, আর খলনায়ক যেন তাদের থেকেও বড় নায়ক! সেই খলনায়ক বেশী নায়ক, কিংবা নায়কবেশী খলনায়ক হচ্ছেন তাসকিন রহমান। “ঢাকা অ্যাটাক”-এ যতবার তাকে দেখছিলাম, মনে হচ্ছিলো যেন ডিসি কমিকের “ডার্ক নাইট” ছবির Heath Ledger-কে দেখছি! সেই জোকারের চাইতে কোনো অংশেই কম না আমাদের তাসকিন রহমান!!

অসাধারণ গল্প, অসাধারণ নির্মাণশৈলী, চমৎকার ক্যামেরার কাজ, সবার দুর্দান্ত অভিনয়, অত্যন্ত শক্তিশালী কিছু সংলাপ যা বাংলা চলচ্চিত্রে সচরাচর শোনা যেতনা, রিয়েলিস্টিক এ্যাকশন- সবকিছু মিলিয়ে দুর্দান্ত এই চলচ্চিত্রটি ১০-এ ৮.৫ পাওয়ার অধিকার রাখে (যদিও এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত রেটিং)।
ঢাকা অ্যাটাক

পরিশেষে ধন্যবাদ জানাতে চাই পুরো ঢাকা অ্যাটাক টীমকে, আমাদের এত অসাধারণ এবং দুর্দান্ত একটি ছবি উপহার দেয়ার জন্য। বছরে এরকম অন্তত দু’টো ছবি রিলিজ হলেই আগামী পাঁচ বছরের মাথায় আমাদের ইন্ডাস্ট্রি আবার ঘুরে দাঁড়াবে, আমরা আবার আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে বিশ্বের দরবারে গর্ব করতে পারব। এই চলচ্চিত্রটি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উন্নয়নের একটি মাইলফলক-ই স্থাপন করে নি, বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে আসা এবং বাংলা চলচ্চিত্রের নাম শুনেই নাক সিটকানো সংকীর্ণমনাদের মুখে রীতিমত ঝামা ঘষে দিয়েছে! বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে নাক সিটকানোকে যারা ফ্যাশন বলে মনে করেন তাদেরকে বলব, বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে বাজে কথা বলার আগে একবারের জন্যে হলেও “ঢাকা অ্যাটাক” দেখে আসতে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, “ঢাকা অ্যাটাক” একবার দেখে তাদের মন ভরবে না। আমার নিজেরই তো ভরে নি!

জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের

লেখকঃ Dewan Tanvir Ahmed

1 মন্তব্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে