আমার মৃত্যুর পর আমার তিনটা অসিয়ত তোমরা পূরণ করবে।
অসিয়ত ১ঃ শুধু আমার চিকিৎসকরাই আমার কফিন বহন করবেন।
অসিয়ত ২ঃ আমার কফিন শহরের যে পথ দিয়ে যাবে সেই পথে আমার অর্জিত সোনা ও রুপা ছড়িয়ে থাকবে।
অসিয়ত ৩ঃ কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে খোলা থাকবে।’
আলেকজেন্ডারের সেনাপতি যখন তাঁকে এই ব্যতিক্রমধর্মী অসিয়ত কেন করেছেন বিনয়ের সাথে তার মাহাত্ম্য বা রহস্য জানতে চাইলেন। দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে আলেকজান্ডার যে উত্তর দিয়েছিলেন তা ছিল এক অনন্য শিক্ষা। উত্তর জেনে নেওয়ার আগে আমরা জেনে নেই মহাবীর আলেকজেন্ডার কে ছিলেন।
আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালের জুলাই মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। আলেকজান্ডারের বাবা ছিলেন মেসিডোনিয়ার রাজা। আলেকজান্ডার ছিলেন রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ও তাঁর চতুর্থ স্ত্রী রানী অলিম্পাসের সন্তান। তাঁকে সম্বোধন করা হয় হেলেনীয় লিগের হেজিমন, পারস্যের শাহেনশাহ, মিশরের ফারাও ও এশিয়ার প্রভু নামে। তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পুরো পৃথিবীর অর্ধেক অংশ জয় করেছিলেন। তাঁর সেনাবাহিনী ছিল অসীম সাহসী। সামরিক বাহিনীর কূটকৌশল তাঁর আয়ত্তে ছিল। তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে একজন সফল সামরিক প্রধান এবং সম্রাট।
https://en.wikipedia.org/wiki/Alexander_the_Great
শৈশব কাল থেকেই আলেকজান্ডার ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান। তাঁর বুদ্ধি ও সাহসের জন্য অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে আলেকজান্ডারই হবেন ভবিষ্যৎ রাজা। তাঁর শৈশবের ঘটনা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এই ঘটনাটি- আলেকজান্ডার একদিন তাঁর বাবার সাথে বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছেন। পথের ধারেই কতগুলো মানুষের সমাবেশ দেখে আলেকজান্ডার জানতে চাইলেন সেখানে কি হয়েছে? তাকে জানানো হলো সেখানে একটি কালো পাগলা ঘোড়াকে কিছু মানুষ বশ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কেউই সেই ঘোড়াটাকে বশ করতে পারছে না। ছোট্ট আলেকজান্ডার তখন কিছুটা কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। তিনি ঘোড়াটাকে বশ করার জন্য তাঁর বাবার কাছে অনুমতি চাইলেন। তাঁর বাবা ফিলিপ তাকে অনুমতি দিলেন এবং এটাও জানিয়ে দিলেন যে যদি তুমি ঘোড়াটা বশ করতে পারো তাহলে সেটা তোমার হয়ে যাবে। আলেকজান্ডার অত্যন্ত খুশি হয়ে কাজে লেগে পড়লেন। তিনি প্রথমে লক্ষ করলেন ঘোড়াটা কেন ভয় পাচ্ছে এবং মানুষকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। তিনি দেখলেন যে ঘোড়াটা তাঁর নিজের ছায়াকে ভয় পাচ্ছে। তিনি ঘোড়াটাকে সূর্যের দিকে মুখ করালেন যেন ঘোড়াটা তাঁর নিজের ছায়াকে দেখতে না পায়। তাঁর বশ করা এই ঘোড়াটা তাঁর সাথে তাঁর শেষ যুদ্ধে মৃত্যু বরন করার আগ পর্যন্ত তাঁর সাথেই ছিল। তিনি এই ঘোড়াটার একটি নামও দিয়েছিলেন। ঘোড়াটার নাম ছিল ‘বুসেফেলাস’।
আলেকজান্ডারের জীবনে তাঁর মায়ের ভূমিকা ছিল অসামান্য। ছেলেবেলা থেকেই তিনি শিশু আলেকজান্ডারকে বুঝিয়েছিলেন পারস্য জয় করার জন্য তাঁর জন্ম হয়েছে। বলা বাহুল্য অলিম্পিয়া ছিলেন ফিলিপের সাত স্ত্রীর মধ্যে চতুর্থ। অন্যদিকে অসম্ভব বিচক্ষণ এবং বীরযোদ্ধা রাজা ফিলিপ বালক আলেকজান্ডারের শিক্ষার কোন ত্রুটি করেননি। জগৎবিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টোটলকে নিযুক্ত করেছিলেন আলেকজান্ডারের শিক্ষক হিসাবে। আলেকজান্ডার আর দশজন অভিজাত গ্রীক কিশোরের মতই শিখছিলেন দর্শন, শরীরচর্চা ও যুদ্ধবিদ্যা। প্রায় তিন বছর সান্নিধ্যে থাকার পর ১৬ বছর বয়সে এরিস্টোটলের কাছে তাঁর পাঠগ্রহণ সম্পুর্ণ হয়। এরপর আলেকজান্ডার যোগ দেন পিতার সামরিক বাহিনীতে। অসম্ভব সাহসিকতার সাথে লড়েন প্রতিটি যুদ্ধে।খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ সালে এক ভোজ সভায় তিনি ঘোষণা করেন যে “এখানে একব্যক্তি গ্রিস থেকে এশিয়া জয় করার পরিকল্পনা করছে”… সেই ব্যক্তিটি ছিলেন আলেকজান্ডার নিজেই।
ম্যাসিডোনিয়ার সম্ভ্রান্ত ও সেনাবাহিনীর সমর্থনে আলেকজান্ডার মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ম্যাসিডোনিয়ার শাসক হিসেবে সিংহাসনলাভ করেন।আলেকজান্ডার সিংহাসনলাভ করেই তাঁর সম্ভাব্য শত্রুদের সরিয়ে দিতে শুরু করেন। তিনি প্রথমেই ম্যাসিডনের পূর্বতন রাজা চতুর্থ আমুনতাসকে হত্যা করেন। দ্বিতীয় ফিলিপকে হত্যার অভিযোগে হেরোমেনেস ও আরহাবিয়াস নামক দুইজন সম্ভ্রান্ত ম্যাসিডোনীয়কে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
এরপর শুরু হয় পৃথিবী জয় করার যুদ্ধ শুরু।আনুমানিক ৪৮,১০০ পদাতিক, ৬,১০০ অশ্বারোহী ও ১২০টি জাহাজে ৩৮,০০০ নাবিক নিয়ে আলেকজান্ডারের বাহিনী হেলেস্পোন্ট পার করেন। আলেকজান্ডার এশিয়ার মাটিতে একটি বল্লম ছুঁড়ে ঘোষণা করেন যে, তিনি দেবতাদের নিকট হতে এশিয়াকে উপহার হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
“এখানে দেবতা বলার একটি কারন ছিলো। জন্মের পর থেকেই আলেকজান্ডারকে দেবতাদের সন্তান হিসাবে প্রচার করা হয়। আলেকজান্ডারের জন্ম নিয়ে বেশ কিছু কল্পকথা প্রচলিত রয়েছে। গ্রিক জীবনীকার প্লুতার্কের রচনানুসারে, ফিলিপের সঙ্গে বিবাহের দিনে অলিম্পিয়াসের গর্ভে বজ্রপাত হয়। বিবাহের কয়েকদিন পর ফিলিপ একটি স্বপ্নে দেখেন যে, অলিম্পিয়াসের যোনিদ্বার সিংহের ছাপযুক্ত একটি শীলমোহর দ্বারা বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। প্লুতার্ক এই সমস্ত অলৌকিক ঘটনার বেশ কিছু ব্যাখ্যা দেন এই ভাবে যে, অলিম্পিয়াস বিবাহের পূর্ব হতেই গর্ভবতী ছিলেন এবং আলেকজান্ডার জিউসের সন্তান ছিলেন। যদিও ঐতিহাসিক ইতিহাসবেত্তাদের মতে, উচ্চাকাঙ্খী অলিম্পিয়াস আলেকজান্ডারের ঐশ্বরিক পিতৃত্বের কাহিনী প্রচলিত করেন। আলেকজান্ডারের জন্মের দিন ফিলিপ পটিডিয়া অবরোধের পরিকল্পনা করছিলেন। সেই দিনই তিনি তাঁর সেনাপতি পার্মেনিয়ন দ্বারা ইলিরিয়া ও পীওনিয়া রাজ্যের সেনাবাহিনীর পরাজয়ের এবং অলিম্পিক গেমসে তাঁর অশ্বের জয়লাভের সংবাদ লাভ করেন। কথিত যে, আলেকজান্ডারের জন্মদিবসের প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম আশ্চর্য হিসেবে পরিগণিত আর্তেমিসের মন্দির ভস্মীভূত হয়।পারস্য জয়ের পর আলেকজান্ডার তাঁর সভায় পারস্যের বেশ কিছু পোশাক এবং হস্তে চুম্বন ও দেবতাদের প্রতি ভূমিতে উল্লম্ব ভাবে শুয়ে সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি রীতিনীতির প্রচলন করেছিলেন।গ্রিকদের মনে এই কারণে অসন্তোষের জন্ম হয়, যে আলেকজান্ডার তাঁর প্রতি এই সব রীতির প্রদর্শন করিয়ে নিজেকে দেবতার আসনে উন্নীত করতে চেয়েছেন।”
লেভ্যান্ট ও সিরিয়া, মিশর, হাখমানেশী সাম্রাজ্যের পতন, ব্যাবিলন, পারস্য জয় করে সম্রাট আলেকজান্ডার সুদূর গ্রিস থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে ইরান আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাবে পৌছে যায়। সুদর্শন তরুণ সম্রাটের চোখে সারা পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অধিকারি তিনি। বিখ্যাত ইরান সম্রাট দারায়ুস থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম ভারতের পরাক্রমশালী রাজা পুরু পর্যন্ত কেউ তার সামনে দাড়াতে পারে নাই। এখন তার সামনে মাত্র একটা বাধা, বিপাশা নদীর ওপারের গঙ্গারিডই রাজ্য। ভারতের মূল ভুখন্ড। এটুকু করতলগত হলেই সমগ্র ভারত তার দখল হয়ে গেল। যে স্বপ্ন নিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন গ্রিক রাষ্ট্র মেসিডোনিয়া থেকে, তা পরিপূর্ণতা পাবে।আলেকজান্ডার যেমন বিবাদমান গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন ঠিক তেমনি তাঁর ১৫০০ বছর পরে জন্ম নেওয়া চেঙ্গিস ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন মঙ্গোলিয়ার বিবাদমান ছোট ছোট গোত্রগুলোকে। তবে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল চেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্যের প্রায় অর্ধেক। শুধু তাই নয় উত্তরাধিকারী না থাকায় আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই ভেঙে খান খান হয়ে গিয়েছিল।চেঙ্গিস খানের ইতিহাস ঘাটলে ধ্বংস ও মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রায় ৪ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য চেঙ্গিস প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। বেইজিং, উরগেঞ্জ, সমরখন্দের মত শহর সম্পুর্ণ ধ্বংস হয়েছিল তার তান্ডবলীলায়। অন্যদিকে আলেকজান্ডার শুধু বিজেতাই নন, বিচক্ষণ শাসকও। তবে ফিলিস্তিনের গাজা, টায়ার ও অন্যান্য কিছু শহরে আলেকজান্ডারও ভয়ানক গণহত্যা চালিয়েছেন। কিন্তু একটি কথা অনস্বীকার্য নতুন দেশ জয় করে তিনি সেদেশের সভ্যতা ধ্বংস করেননি বরং আত্মীকরণ করেছেন তাদের সংস্কৃতি। যেমন পারস্য জয়ের পর আলেকজান্ডারকে দেখা গেছে পারসিয়ান পোশাকে কিংবা ভারতের রাজা পুরুর সাথে গড়ে উঠেছিল তাঁর সখ্যতা। সবমিলিয়ে আলেকজান্ডার সেতু বন্ধন রচনা করেছিলেন প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের। ভারত, পারস্য ও গ্রীক এই তিনটি মহান সভ্যতার সম্মিলন খুব অল্প সময়ের জন্য সম্ভব হয়েছিল তাঁর বিজয়াভিযানের ফলে। তাই ইতিহাসে আলেকজান্ডার এত অনন্য, এত বেশি আলোচিত।
ঠিক কি কারণে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়েছিল তা বলা দুষ্কর। এই ব্যাপারে দুটি মত প্রচলিত। প্রথমটি হল ম্যালেরিয়া দ্বিতীয়টি হল বিষ প্রয়োগে মৃত্যু। তবে প্রথমটির পক্ষেই বেশি সমর্থন পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে আলেকজান্ডার দুই সপ্তাহের মত শয্যাশায়ী ছিলেন। অবশেষে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ১০ বা ১১ জুন পরলোকগমন করেন দিগ্বিজয়ী এই মহাবীর।
https://www.historytoday.com/james-romm/who-killed-alexander-great
শয্যাশায়ী থাকতে তিনি বলেন “আমি দুনিয়ার ক্ষমতাবান ও সাধারণ মানুষের সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই।”
১। আমার চিকিৎসকদের কফিন বহন করতে এই কারনে বলেছি, যাতে লোকে বলতে পারে যে চিকিৎসকরা মানুষের রোগ সারিয়ে দিতে পারে না। তারা ক্ষমতাহীন। চিকিৎসকরা মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না।
২।লাশের কফিন নিয়ে যাবার পথে সোনা-দানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি এই কারণে যে, সোনা-দানা, হীরা-জহরতের একটা কণাও আমার সাথে যাবে না। এগুলো পাওয়ার জন্য আমি সারাটা জীবন ব্যয় করেছি। কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। পৃথিবীর মানুষ বুঝুক এসবের পেছনে ছোটা মানে মরিচিকার পিছনে সময়ের অপচয় করা।
৩।কফিনের বাইরে আমার দুটি হাত খোলা রাখতে বলেছি এই কারণে যে, পৃথিবীতে আমি খালি হাতে এসেছি, আজ পৃথিবী থেকে খালি হাতেই বিদায় নিচ্ছি।
লেখকঃ সাইফুল ইসলাম