সাজিয়া সকাল এগারোটায় কোনো কারন ছাড়াই একবার বমি করেছে। সাজিয়ার আম্মু আগের কালের মহিলা হলে হয়তো উল্টাপাল্টা কিছু সন্দেহ করে বসতেন, কিন্তু রেহেনা খানম আধুনিক আম্মু। তিনি চোখমুখ শক্ত করে ঘোষণা করলেন সারাদিন ফেসবুক চালালে বমি তো আসবেই। সাজিয়া রেগে গিয়ে বললো,’সবকিছুতেই কেন ফেসবুকের দোষ হবে সবসময়, হুম? এমনও তো হতে পারে যে আমি প্রেগনেন্ট। হতে পারে না?’
সাজিয়ার আম্মু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন,’হুহ! তোমার ক্ষমতা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। ফেসবুকে ইন এ রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আর ইনবক্সে দুই একটা উম্মাহ দিলে কেউ প্রেগনেন্ট হয়ে যায় না।প্রেগনেন্ট হওয়ার জন্য কিছু করা লাগে। শুয়ে বসে ফোন টিপলে চলে না। আর তুমি লাস্ট কবে কোনো একটা কাজ করেছ বলবা আমাকে? একগ্লাস পানিও তো ঢেলে খাও না!’
সাজিয়া যারপরনাই হতাশা অনুভব করলো।আম্মু এখন আছে উপদেশ দেয়ার মুডে। দেড় দুই ঘন্টার আগে থামানো পসিবল হবে না মেবি।
রেহেনা বেগম টানা কথা বলার প্রস্তুতি হিসাবে একটা চকলেট গালে দিলেন; এতে গলা শুকিয়ে আসে না সহজে।
‘ইউ নো সাজিয়া? কোনো ধারণা আছে, তোমার এই বয়সে আমি কতকিছু করেছি? কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে চা বানাতে পারতাম। আম্মু একটু দেখিয়ে দিলে ডিমটাও পোচ করে ফেলতাম। তখন আমার বয়স কতো? মাত্র উনিশ।ভাবতে পারো! আর তুমি? একুশ চলতেছে এখনো পানি গরম করতে গেলে পুড়িয়ে ফেলো!
এমন না যে আমরা ফেসবুক চালাইনি; আমরাও তো চালাইছি তাইনা? কিন্তু সবকিছুর একটা লিমিট থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। আমরা অলওয়েজ নিয়ম করে দুইঘন্টা ফেসবুকিং করার পর অন্তত পনেরো মিনিট অফলাইনে থাকতাম।তোমার মতো চব্বিশ ঘন্টা পড়ে থাকতাম না!’
উপদেশের গুঁতোয় সাজিয়ার মাথা টন টন করতে লাগলো, কান ভন ভন করতে লাগলো।প্রায় জ্ঞান হারাতে যাবে; এমন সময় থামলেন রেহেনা খানম।চকলেট শেষ হয়ে উনার গলা শুকিয়ে গেছে।নাহ!হতাশ হলেন তিনি।এভাবে চললে কি করে হবে? এখনো পাশের ফ্লাটের ভাবিদের সাথে গতকাল রাতে দেখা সিরিয়ালের গসিপ বাকি।সেখানে ঘন্টা দুয়েক কথা বলতে না পারলে মান- সম্মান থাকবে না।রেহেনা খানম এককাপ আদা চা খাওয়ার জন্য কিচেনে গিয়ে ঢুকলেন।
উপদেশ শুনলে যে কারোরই মেজাজ খারাপ হয়, সাজিয়ারও হচ্ছে।মেজাজ খারাপ হলেই তার শুধু সেলফি তুলতে ইচ্ছা করে।সেলফি স্টিক টা টেনে নিয়ে সাজিয়া প্রায় সাড়ে চারশো সেলফি তুলে ফেললো।যাক,নাউ ফিইলং বেটার। এবারে সাড়ে চারশো সেলফির মধ্যে থেকে একটা বেছে ফেসবুকে আপলোড করে দিলো।ক্যাপশন দিলো,’বসে ছিলাম,এক ফ্রেন্ড হঠ্যাৎ করেই তুলে ফেললো ছবিটা।’
আপ্লোড করার কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রথম কমেন্ট পড়লো।খান মুহাম্মাদ অর্থহীন লিটন নামের একজন লিখেছে,’তুমি খুব খুব বেশি সুন্দর।তোমাকে আমার অন্নেক ভাল্লাগে।’
সাজিয়া কমেন্টের রিপ্লায় দিলো,’আপনাকেও আমার অনেক ভালোলাগে।’
সাথে সাথে ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো।খুশিতে আটপিস হয়ে লিটন নামের ছেলেটা ম্যাসেজ দিয়ে ফেলেছে,
-‘সত্যি? আচ্ছা এটা বলো আমাকে তোমার ক্যান ভাল্লাগে?’
-‘ক্যান আবার? আপনার কত্তো টাকাপয়সা!’
-‘ইয়ে..মানে..কে বলেছে?’
-‘কে আবার বলবে? ঢাকা শহরে যার নিজের ফ্লাট আছে সে গরীব হয় কিভাবে?’
-‘কিসের ফ্লাট? আমি তো কিছুই বুঝছি না।’
-‘ইস..! ন্যাকা! লিটনের ফ্লাটের কথা কে না জানে?’
লিটন নামের ছেলেটার বুঝতে কয়েক মুহুর্ত সময় লাগলো। তারপর সে এটাকে কোনো বিশেষ ইঙ্গিত ভেবে খুশি হয়ে উঠলো। একটু ইতস্তত করে বললো,’যাবা আমার ফ্লাটে?’
সাজিয়া একটা লাজুক হাসির ইমো পাঠিয়ে রিপ্লায় দিলো,’তুমি নিয়ে গেলে অবশ্যই যাবো।’
‘কাল বিকালে? ছেলেটা উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে প্রবলেম হবে নাকি বাসায়?’
‘আরে ধুর! কিসের প্রবলেম? আমার রাতেও কোনো প্রবলেম নাই।আশ্বস্ত করলো সাজিয়া!’
‘ওকে তাইলে বিকালে না। কালকে রাত আটটায় দেখা হচ্ছে। আমি বিকালের আগেই তোমাকে ঠিকানা পাঠিয়ে ম্যাসেজ দিবো।’
‘হুম ঠিকাছে, সম্মতি জানালো সাজিয়া।
নিজ খরচায় টিকিট কেটে ফ্রেন্ডের ফ্যামিলির সবাইকে স্টার সিনেপ্লেক্সে ইভিনিং শো দেখতে পাঠিয়ে ঘন্টা তিনেকের জন্য ফ্লাটের চাবি নিয়ে রেখেছে লিটন।তারপর ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়ে সেই বিকেল থেকে অপেক্ষা করে আছে সাজিয়ার আসার, কিন্তু মেয়েটার কোনো খোজ ই নেই।অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে শেষমেশ সাড়ে সাতটার দিকে ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলো ও,
-‘সাজিয়া কই তুমি?’
-‘কই আর থাকবো, বাসায় ই।’
-‘বাসায় মানে? তোমার না ফ্লাটে আসার কথা আজকে।’
-‘হুম আসবো তো! মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে।আটটা বাজুক, আটটা বাজলেই তোমার ফ্লাটে চেকইন স্ট্যাটাস দিয়ে দিবো। সাথে তোমাকেও ট্যাগ করে দিবো।’
-‘হোয়াট? তারমানে নিজে আসবা না তুমি?’
-‘এর মাঝে পার্থক্য কি, হুম? আরে বোকা ছেলে, এফবিতে চেকইন দেয়া মানে তো আমার নিজে আসাই হলো, নাকি? সবাই তো তাই ই দেখবে।তুমি আর আধাঘন্টা ওয়েট করো আমি আটটা বাজতেই স্ট্যাটাস দিয়ে দিবো, কেমন?’
-‘ধুররর! প্রচণ্ড হতাশ হয়ে ফোনটা ছুড়ে ফেললো লিটন।
পরদিন সকালে সাজিয়া আবার বমি করলো। আম্মুর কাছে গিয়ে বললো,’আম্মু আমি মনে হয় এবারে সত্যি সত্যি প্রেগনেন্ট!’
রেহেনা বেগম বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,’হাইরে বোকা মেয়ে!লিটনের ফ্লাটে চেকইন দিলেই কেউ প্রেগনেন্ট হয়ে যায় না।তারজন্য নিজে স্বশরীরে সেখানে যাওয়া লাগে।’
সাজিয়া অবিশ্বাসের সুরে বললো,’তাইলে আমার ডেইলি বমি হবে ক্যান,তুমিই বলো?’
‘বমি হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের জন্য, কারন তুমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করোনা।আজকে সকালের নাস্তাটাও করোনি।’
‘কিন্তু আম্মু আমি তো সেই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠেই এফবিতে ‘ইটিং পরোটা এন্ড ডিমভাজি’ লিখে স্ট্যাটাস দিয়ে দিছি।’
রেহেনা খানম কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। তিনি যারপরনাই হতাশা অনুভব করলেন।যে কারনেই হোক মেয়েটা ভার্চুয়াল আর রিয়েল লাইফটাকে এক করে ফেলেছে। এটা কোনো একটা মানুষিক রোগ হতে পারে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ ব্যাপারে একজন সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে কনসাল্ট করবেন। সাজিয়াকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,’শুনো আজকে বিকালে তোমাকে একজন ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যাবো,রেডি হয়ে থেকো।’
সাজিয়া ভালোমানুষের মতো মুখ করে বললো,’ওকে আম্মু তুমি চেম্বারের ঠিকানাটা বলো, আমি বিকালে চেকইন দিয়ে দিবো।’
রেহেনা খানম আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। প্রচন্ড এক চড় কষালেন।
‘গাধা মেয়ে!
‘গাধা মেয়ে! মাথায় একফোঁটা ঘিলু নেই তোমার? ঘাস খাও তুমি? অসহ্য!’
চড় খেয়ে সাজিয়া কাঁদতে কাঁদতে রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লক করে দিলো। আম্মু চড় মারলো? এতোবড় অপমান! এই জীবন আর রাখবে না সে। যেই ভাবা সেই কাজ, তখনই ফেসবুকে লগইন করে ‘ডুয়িং সুইসাইড!’ লিখে স্ট্যাটাস আপডেট করে দিলো।
স্ট্যাটাস পড়ে রেহেনা খানম হাসবেন না কাঁদবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। এই মেয়ে তো দেখা যাচ্ছে পুরাই সাইকো হয়ে গেছে। এখনই চিকিৎসা না করালে পরে প্রবলেম আরো বড় আকার ধারন করতে পারে।দরকার হলে ডাক্তারকে বাসায় আনতে হবে, তাতে যত টাকা লাগে লাগুক।
বিখ্যাত সাইক্রিয়াটিস্ট আশফাক আহমেদ ড্রয়িংরুমে বসে চা খেতে খেতে পুরো বিষয়টা মনোযোগ সহকারে শুনলেন। তারপর রেহেনা খানমকে আশ্বস্ত করলেন,’ব্যাপারটা তেমন সিরিয়াস কিছুই না।এটা নিয়ে এতো টেনশান করারও কিচ্ছু নেই।সাজিয়াকে শুধু বুঝালে হবে না, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে ফেসবুকের বাইরেও একটা পৃথিবী আছে। সেই পৃথিবীটা এফবির এই নীল সাদা স্ক্রিন থেকেও অসম্ভব সুন্দর!আচ্ছা আমি কি ওকে কোথাও নিয়ে যেতে পারি?’
‘ভাই আপনি যা খুশি করুন, শুধু আমার মেয়েটার মাথা থেকে এই ফেসবুকের ভূত নামিয়ে দিন। রেহেনা খানমের গলায় ঝরে পড়লো একরাশ উৎকন্ঠা।
‘ওয়াও!! সাজিয়া বাচ্চা মেয়ের মতো খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো, কি সুন্দর সবুজ গ্রাম!’
‘হুম, মুচকি হাসলেন আশফাক আহমেদ।আর এদিকে দেখ, কেমন নীল জলরাশির সমুদ্র।’
‘তাইতো! সাজিয়া বিস্ময় গোপন করতে পারলো না; এইসব তো ফেসবুকের মধ্যে নেই।’
‘শুধু কি এই? ঐদিকে দেখ কি বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর শপিংমল! যেগুলো তুমি নিজ চোখে দেখতে পাবা, দুধের স্বাদ চেকইনএ মেটানো লাগবে না।’
‘আংকেল আপনাকে অনেক অনেক থ্যাংস। এফবির বাইরের এতো সুন্দর একটা পৃথিবীরর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য!’
‘থ্যাংস দেয়ার কিছু নেই আম্মু, আশফাক সাহেব যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে হাসলেন।তুমি যে সুন্দর গ্রামখানা দেখলে ওটা অজ্ঞাতনামা মুভির দৃশ্য, আর সুমুদ্রের নীল জলরাশি তোমায় দেখালাম টাইটানিক মুভি থেকে। আর টম ক্রুজের মিশন ইম্পসিবল ফাইভ সিনেমায় তুমি দেখতে পেলে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা। আর সবচে ইম্পর্টেন্ট কথা কি জানো? ফেসবুকের বাইরের এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীটার নাম হলো,’ইউ-টিউব!’
‘ওকে আংকেল, আমি এখন থেকে এফবি বাদ দিয়ে বেশি করে ইউটিউবে সময় কাটাবো।’
দুইদিন পর সকালে আবার বমি করলো সাজিয়া।আম্মুর কাছে গিয়ে বললো,’এইবার আমার মনে হয় ঘটনা ঘটে গেছে, তাইনা আম্মু?’
রেহেনা খানম হতাশ গলায় বললেন,’মা রে..ইউটিউবে ঐসব উউল্টাপাল্টা ভিডিও দেখলে কেউ প্রেগনেন্ট হয়ে যায় না।তার জন্য রিয়েল লাইফে কিছু করা লাগে।’
সাজিয়ার খুব মন খারাপ হলো।সে বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলো,
‘আমার মনে হয় আর এই জীবনে প্রেগনেন্ট হওয়া হবে না….!
লেখকঃ সোহাইল রহমান