ফেসবুকে ৫ হাজার জনকে বন্ধু হিসেবে তালিকাভুক্ত করা যায়। এ সংখ্যাটা বিশাল, স্বাভাবিক হিসেবে সারা জীবনেও এত পরিমাণ মানুষ বন্ধু হয় না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এ সংখ্যাটা ছোট ঠেকতে পারে। যেমন কোনো একটি সৃজনশীল গ্রুপে আনাগোনা করলেন, হতে পারে সেটা বই সংক্রান্ত গ্রুপ কিংবা বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রুপ কিংবা ইতিহাস-শিল্প-সাহিত্য সংক্রান্ত গ্রুপ। এখানে দেখলেন অনেক মানুষ আছে যাদের চমৎকািত্বে আপনি মুগ্ধ। স্বাভাবতই আপনি চাইবেন তাদেরকে ফ্রেন্ডলিস্টে তালিকাভুক্ত করতে। আবার হঠাৎ একদিন আপনার প্রিয় লেখকের দেখা পেলেন ফেসবুকে, চোখ ছানাবড়া, উনার সূত্র ধরে দেখলেন দেশের আরো আরো লেখকেরা ফেসবুকে সক্রিয়। এমতাবস্থায় আপনার সম্মানিত লেখকদেরকে কখনোই আপনি হাতছাড়া করতে চাইবেন না। ইন্টারমিডিয়েটে পদার্থবিজ্ঞান পড়েছেন তপন-হাসান-চৌধুরীর বই থেকে, এখানের রানা চৌধুরী ফেসবুকে সক্রিয়। জীববিজ্ঞান পড়েছেন আজমল-আসমতের বই থেকে। গাজী আসমতকেও পাবেন ফেসবুকে। আপনার জীবনের হিরোগুলোকে কখনোই হাতছাড়া করতে চাইবেন না। তারপর দেখলেন গণ্যমান্য কিছু রুই-কাতলা ব্যক্তিত্বও ভাসছে ফেসবুকের কোনায় কোনায়। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিশ্চয়ই বঞ্চিত রাখতে চাইবেন না।
এদের সমান্তরালে আপনাকেও নানা প্রান্তের মানুষ ফ্রেন্ড করে নিতে চাইবে। অন্য কেউ আপনার ফ্রেন্ড হতে চাইলে না করার তো কিছু নেই। ফ্রেন্ড বেশি থাকা মানে ফেসবুকে ‘ফেসবুকীয় প্রভাবশালী’ হওয়া। অবস্থা অনেকটা এমন- “পান্তা আমি খাই না ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাই না, একটা যদি পাই, অমনি ধরে একসেপ্ট কইরালাই।” পাশাপাশি গণহারে নিজেও বেশ কিছু রিকোয়েস্ট দিয়েছেন যেগুলো দরকার ছিল না। কিন্তু একসময় দেখবেন এই পদ্ধতি আসলে ক্ষতি করছে। যত্রতত্র ফ্রেন্ড হবার কারণে আপনার ফ্রেন্ডের ৫ হাজারের কোটা শেষ হয়ে আসছে। ফলে আরো চমৎকার চমৎকার মানুষের ফ্রেন্ড আর হতে পারবেন না। এমতাবস্থায় ফ্রেন্ডলিস্ট খালি করার কোনো বিকল্প নেই।
তবে সবার বেলায় এই সমস্যা খুব প্রকট আকার ধারণ করে না। যারা একটু আধটু বিখ্যাত মানুষ তারা এই সমস্যাগুলো ফেস করে থাকেন একসময়। যেমন একজন শিক্ষার্থী বুয়েটের বা মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম কিংবা দ্বিতীয় কিংবা এরকম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পেয়েছে। সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে আইকন। স্বভাবতই অনেক রিকোয়েস্ট এসে ভিড় করবে তার কাছে। কিংবা কেউ একজন সেবা প্রকাশনী থেকে একটি থ্রিলার বই প্রকাশ করেছে। সেবার ভক্ত অনেকের কাছে সে হয়ে যাবে আইকন। কিংবা ড্যান ব্রাউনের মতো বিখ্যাত লেখকের বই অনুবাদ করেছে কোনো একজন মেধাবী। তাহলে ড্যান ব্রাউন প্রিয় অনেকের কাছে সে হয়ে যাবে আইকন। কিংবা গণিত অলিম্পিয়াডে কেউ কোনো পদক পেয়েছে। সারা বাংলাদেশের গণিতপ্রেমীদের কাছে সে হয়ে যাবে আইকন। দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা যারা আছেন তারা অতিরিক্ত ফ্রেন্ডের সমস্যায় পড়েনই পড়েন। ফ্রেন্ড ৫ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে সেক্ষেত্রে তাদেরকে ফ্রেন্ড ছাটাই করতেই হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন ফ্রেন্ড ছাটাই করবেন?
ফ্রেন্ড ছাটাই করার মূল কারণ নতুন ফ্রেন্ডদেরকে স্থান করে দেয়া। প্রশ্ন হতে পারে অলরেডি ফ্রেন্ড হয়ে আছে এমন লোকদের তাড়িয়ে দিয়ে নতুন কাউকে নিলে তো ঘটনা একই থাকছে। তার চেয়ে অতিরিক্ত কষ্টটা না করলে হয় না? আসলে পুরাতন ফ্রেন্ডদের মাঝে মাঝে এমন কতগুলো আইডি থাকে যারা না থাকলেই ভালো। যারা দরকারি কিংবা যারা কাজের তারা অবশ্যই থাকবে। আর তাছাড়া আপনি গুরুত্বপূর্ণ কেউ হলে নতুনদের অধিকার আছে আপনার সংস্পর্শে আসার। সকলের মাঝে যারা নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিতে চান তাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ বড় হবার সাথে সাথে কিছু আইডিওলজির আলোকে নিজেদেরকে গড়ে তোলে। যেমন কেও মানবতাবাদী, কেও সাম্যবাদী, কেও অস্তিত্ববাদী, কেও বাস্তুবাদী, কেও মৌলবাদী, কেও চরমপন্থি, কেও পাকিস্তানপ্রেমী, কেও তার উল্টো, কেও উত্তর কোরিয়াপ্রেমী, কেউ তার বিপরীত, কেও আল্লাহ ও মোহাম্মদপ্রেমী আবার কেও তাদের বিদ্বেষী। এদের মাঝে এক আইডিওলজির ব্যক্তি অন্য আইডিওলজির বিপক্ষে অবস্থান করেন। এমতাবস্থায় ফ্রেন্ডলিস্টে পছন্দ করেন না এমন কোনো আডিওলজির আইডিগুলোকে অবশ্যই সরিয়ে নিজেকে হালকা করে নেবেন।
কী উপায়ে ছাটাই করবেন?
একদিন বসে ধরে সব খালি করে ফেলবেন? না এমনটা করলে আপনার মাহাত্ম থাকে না। মনে রাখতে হবে এমন কিছু করবেন না যার কারণে আপনি কিছুটা অহংকারী হয়ে যান। প্রত্যেকেই আপনার ফ্রেন্ড থাকার দাবী রাখে। এদের মাঝে যেগুলোর দাবীর জোর কম এবং স্বল্প দরকারি তাদেরকেই শুধু বের করবেন। এর জন্য দরকার সময় এবং ঝামেলাহীন মস্তিষ্ক। এমনভাবে করতে হবে যেন দরকারি একটা ফ্রেন্ডও লিস্টের বাইরে না যায় এবং বাদ যাওয়াদের মাঝে এমন কেউ না থাকে যে বাদ গেছে দেখে সে মনে মনে কষ্ট পাবে। এমন কাউকে বাদ দেয়া উচিৎ যারা আপনার বাদ দেয়াতে হাসবেও না কাঁদবেও না। ধীরে ধীরে ফ্রেন্ড ছাটাই করার উপায় বাতলে দিচ্ছি আপনাকে।
১. ফেসবুক প্রতিদিন জন্মদিনের রিমাইন্ডার দেয়। সেখানে গেলে দেখা যায় আজ কার কার জন্মদিন। এখানে একটা একটা করে দেখবেন। এখানে প্রায় সময়ই কয়েকটা দরকারি আইডির পাশাপাশি অদরকারী আইডি পাবেন। তাদেরকে সরিয়ে দেবেন। যে কাজটা হুটহাট একদিনে বিরক্ত হয়ে করতেন সেটা করবেন ৩৬৫ দিনে, অল্প অল্প করে। ফলে প্রত্যেকটা আইডিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। তবে বছরের ৩৬৫ দিন এই কাজ করার সময় ও মোড থাকবে না। ভাববেন না, ফ্রেন্ড ছেঁকে নেবার জন্য আরো ছাঁকনি আছে।
২. ফেসবুকে একটা অপশন আছে On this Day নামে। এখানে গেলে ইতিহাসের আজকের দিনে আপনি কী পোস্ট দিয়েছিলেন, কী ছবি আপলোড করেছিলেন তা দেখা যায়। পাশাপাশি কোন কোন ব্যক্তির সাথে ফ্রেন্ড হয়েছিলেন তা-ও দেখা যায়। সেখান থেকে একটা একটা করে যাচাই করে ছাঁকতে থাকুন ফ্রেন্ড।
৩. চেনা লাগছে না এমন কোনো আইডির পোস্ট ভাসতে পারে হোমফিডে। আইডিতে যান, এই আইডির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা যাচাই করে দেখুন। সবকিছুতে না মিললে ছাঁকনিতে ফেলে দিন।
৪. সময় পেলেই মাঝে মাঝে এর ওর আইডিতে ঘুরে আসুন। সেখানে গেলে দেখবেন আপনার সাথে বেশ কিছু ফ্রেন্ড মিউচুয়াল আছে। ঐগুলো যাচাই করুন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিয়ে দেখুন এরা আপনার দরকারি কিনা। না হলে ছাঁকনিতে ধরিয়ে দিন। এই কাজটা অবশ্যই করবেন হেঁসেখেলে। প্রতিটি আইডিতে ঘোরার সময় আপনার যেন মনে হয় আপনি কোনো প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানে ঘুরছেন।
৫. নিজের আইডিওলজির সাথে যায় না, আপনি পছন্দ করেন না এমন কিছু পেজ শনাক্ত করুন। যেমন বাঁশের কেল্লা, প্রথম আলো, নয়া-দিগন্ত, কিংবা কিছু চটি পেজ বা কিছু নোংরা সেলিব্রেটির পেজ। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন আপনার লিস্টের কোন কোন ফ্রেন্ড সেখানে লাইক দিয়ে রেখেছে। সেখান থেকে ধরে ধরে অদরকারীগুলোকে চালান করে দিন ঐপারে। ট্রাস্ট মি, এই পদ্ধতিতে বেড়জালের মতো একসাথে অনেকগুলোকে ‘খায়া দিতে’ পারবেন। তবে খেয়াল রাখুন, এখানে লাইক দিয়েছে বলেই কিন্তু সে এই ভাবধারার নয়। কেউ কেউ থাকতে পারে আপনার পরিচিত। শুধু এখানে কী ঘটছে তা নজরে রাখার জন্য লাইক/জয়েন দিয়ে রেখেছিল। তাদেরকে চালান করে দেবেন না।
৬. আর ক্লাসিক পদ্ধতি তো আছেই। নিজের লিস্টে গিয়ে অক্ষর অনুক্রমিক যেতে থাকবেন এবং কিছু কিছু অদরকারীকে সরিয়ে দেবেন।
৭. কেউ কেউ থাকে একবার যে আইডি খুলেছে দুই বছর তিন বছর পরেও তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। ২/৩ বছরে কোনো পোস্টই দেয়নি। তাদেরকে সরিয়ে দিন।
৮. কিছু কিছু আইডি থাকে যারা পাসওয়ার্ড হারিয়ে ফেলেছে বলে নতুন আইডিতে শিফট করেছে। এক্ষেত্রে সক্রিয় আইডিটা রেখে পুরাতনটা বাদ দিয়ে দিন।
৯. কিছু কিছু আইডি আছে অনেকদিন ধরে ডিএকটিভ করা। বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন, রাখবেন নাকি ছাটাই করবেন।
১০. আনফ্রেন্ড করার আগে দেখুন তার সাথে ইনবক্সে আপনার কথা হয়েছিল কিনা। কথা কখনো হয়ে থাকলে সে লিস্টে থাকার বেলায় একটি প্লাস পয়েন্ট পাবে। তবে কথা হলেই সব শেষ হয়ে যায় না। কথার ধরন দেখে বুঝতে পারবেন তিনি থাকলে ভালো হয় নাকি না থাকলে ভালো হয়।
১১. আপনার নিজেদের এলাকা, নিজের স্কুল/কলেজ/ইউনিভার্সিটি, নিজের কাজের ফিল্ড সংশ্লিষ্ট কাউকে ছেঁকে ফেলে দেবার আগে আরো একবার ভেবে নিন।
১২. নিজের জন্য ভয়ঙ্কর কিছুর দেখা পেতে পারেন মাঝে মাঝে। সেগুলোকে শুধু ছাঁকাই নয়, একদম ব্লক করে দিন।
১৩. আইডিতে গেলে যদি দেখেন মূর্খের মতো পোস্ট দিচ্ছে বা মূর্খতাসুলভ কিছু শেয়ার দিচ্ছে তাহলে লিস্টের ঐপারে পাঠিয়ে দিতে দেরি করবেন না। যেমন নারীর প্রতি ঘৃণা করে কোনো কিছু শেয়ার, মিথ্যা বানোয়াট ফটোশপ করা কোনো কিছু ছড়িয়ে দেয়া কিংবা উস্কানিমূলক কোনোকিছু যাচাই বাছাই না করেই শেয়ার করা পাবলিক আছে অনেক।
১৪. আইডিতে কোনো ছেলে ইডেন কলেজে পড়লে, কিংবা কোনো মেয়ে ঢাকা কলেজে পড়লে অবশ্যই বাদ দিয়ে দেবেন। ইডেন কলেজে কোনো ছেলে পড়ে না, ঢাকা কলেজে কোনো মেয়ে পড়ে না।
১৫. এরকম আরো আরো অনুষঙ্গ তাদের আইডি ঘাঁটলে অল্পতেই পেয়ে যাবেন।
১৬. রাখবেন নাকি ফেলবেন এরকম ধন্দে পড়তে পারেন। সেক্ষেত্রে বলতে হবে- একজন ব্যক্তির কভার ছবি, শর্ট বায়ো, প্রিয় উক্তি প্রভৃতির মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। এদিক থেকে যদি তার সন্তোষজনক কিছু না থাকে তাহলে রাখার দরকার নেই। বাদ দিয়ে দিন।
=======================
ছাটাই করার মাধ্যমে আপনি হবে আগাছামুক্ত। এবার নতুন ফ্রেন্ড নেবার ক্ষেত্রে এবং নতুন রিকোয়েস্ট দেবার ক্ষেত্রে সচেতন হোন। এমন কাউকে নেবার দরকার নেই বা এমন কাউকে রিকোয়েস্ট পাঠানোর দরকার নেই যার কারণে ভবিষ্যতেও আপনাকে ছাঁকনি অভিযান চালাতে হয়। যা ফিল্টার হবার শুরুতেই হয়ে যাক।
নিজের লিস্টে ভালো ভালো ফ্রেন্ড থাকা যেমন অনেক ভালো কিছু তেমনই আজেবাজে ফ্রেন্ড থাকাও বাজে কিছু। নিজের ব্যক্তিত্বকে গুরুত্ব দিন এবং আজেবাজে ফ্রেন্ডগুলোকে সরিয়ে দিন। এখানে আবারো সতর্কতা, এমন কিছু যেন না হয় যার ফলে কেউ আপনার আচরণে কষ্ট পাবে। এমন হলে এত পরিশ্রমের কোনো মানেই থাকবে না। তবে অসতর্কতায় যদি কোনোক্রমে এরকম কিছু হয়ে যায় তাহলে নিজে থেকেই রিকোয়েস্ট পাঠান এবং প্রয়োজনে ভুলের কথা খুলে বলুন। #হ্যাপি_আনফ্রেন্ডিং, নতুন নতুন ভালো ভালো ব্যক্তিকে আপনার ফ্রেন্ড হবার সুযোগ দিন এবং ব্যক্তিত্বকে চমৎকার করে তুলুন।
লেখকঃ Sirajam Munir Shraban