❝অবিচল ইচ্ছে ও বাধা টপকানোর অসীম সাহস ছাড়া আর কিছু ছিলনা❞ – আল ইমরান

0

আল ইমরান ও জুয়েল রানা। ‘SmartB‘ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ব্যাবসায়ী জীবনের নানান অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন নিউজইনসাইড২৪.কমের এর সাথে। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন ইসমাইল উদ্দীন সাকিব।

শুরুর গল্পটা ছোট্ট করে শুনতে চাই

-শুরুর গল্প ছোট করে বলা খুব কষ্টের। ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার সব থেকে কঠিন কাজই হল শুরু করা। একটা শুরুর গল্প জানতে চাইলে অনেক গুলো শেষের গল্প শুনতে হবে। শুরুটা হয়েছিল ২০০৮ সালে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষে। সেসময় আমার বন্ধুর সাথে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ শিখবো বলে অনেক খোঁজাখুঁজি শুরু করি। সেই সুবাদেই এক বিদেশী ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে গিয়ে ই কমার্স ব্যবসায়ের কথা আসে। আমাদের ধারণাটি ছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস মানুষের বাসায় পৌঁছে দেওয়া। এটি এখন শুনলে খুব স্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে সেসময় তথ্য প্রযুক্তির এত উন্নয়ন ছিলনা। তাই আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওয়েবসাইট বা ফেসবুক ভিত্তিক কিছু করতে পারিনি। তাইবলে থেমে ছিলাম না, আমরা পায়ে হেটে মানুষের বাসায় গিয়ে, পোস্টার ছাপিয়ে ও এসএমএস এর মাধ্যমে মার্কেটিং শুরু করলাম। ভালোই সাড়া পাচ্ছিলাম; আগেরদিন কাস্টমাররা ফোন করে কি কি লাগবে আমাদের জানিয়ে দিত, আমরা ভোরে কাওরান বাজার থেকে কেনাকাটা করে ক্রেতাদের বাসায় দুপুরের ভিতর পৌঁছে দিতাম। আমাদের সাথে থাকতো শুধু ভ্যানওয়ালা। এভাবে বছর দুয়েক করার পর আমার পড়াশোনার চাপে আমি আর আগাতে পারিনি। বছর খানিক পর আমি নিউজিল্যান্ড চলে গেলাম।

অবিচল ইচ্ছে ও বাধা টপকানোর অসীম সাহস ছাড়া আর কিছু ছিলনা❞ - SmartB

২০১৪ সালের শুরুর দিকে আমার বর্তমান কোম্পানি ‘SmartB’ এর সহযোগী জুয়েল রানার সাথে ব্যবসায়িক পথচলা শুরু হয়। জুয়েল ও আমার এক পরিচিত ছোট ভাই নাজমুল মিলে ‘পালকি’ নামের একটা অনলাইন গ্রোসারি শপের পরিকল্পনা করে এবং সেখানে আমাকে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে থাকার আমন্ত্রন জানায়। আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাই। কারন বিদেশে থাকার ফলে আমি এমন ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে খুব ভালোভাবেই অবগত ছিলাম। আমরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সাড়া পেয়েছিলাম, কিন্তু একটি সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের সব মূলধন শেষ করে দেয় এবং পুরো দল ছন্নছাড়া হয়ে যায়।

আমি দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরে আরও দুটি উদ্যোগ নিলাম, ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে, ‘ইয়ুথল্যাম্প’ ও ‘হাউজডিটেক’ নামে। এর একটিও তেমন সফল ছিল না। এরপর ২০১৭ সালে আমরা আবার শুরু করি, এবার ‘SmartB’ নামে। তখন অতীতের সব ভুল বিশ্লেষণ করে ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে আগানোর চেষ্টা করেছি বিধায় এখনও আমরা সুনামের সাথে দেশ ও বিদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানির সেবা প্রদান করে যাচ্ছি।

প্রশ্নঃ দেশের পড়াশোনার ধরণের কারণে অধিকাংশের ধারণা চাকরি জীবন নিরাপদ। সেই অর্থে আপনি ব্যাবসায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

-তথাকথিত ব্যবসা বলতে সবাই যেটা বুঝে আমাদের ‘SmartB’ আসলে তেমনটি নয়। আমরা আসলে এটিকে এখনও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসেবেই দেখি, যেটা আমার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল। স্কুল জীবন থেকেই আমার ছিলো পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সামাজিক কাজে ব্যাপক আগ্রহ। সেই সুবাদেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। বেশির ভাগ মানুষের সমস্যার কথা শুনতে শুনতে আমার খুব ইচ্ছে হতো, যদি সব সমস্যা আমি নিজেই সমাধান করে দিতে পারতাম! তখন থেকেই আমার মাথায় সামগ্রিক উন্নয়ন বা সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার বিষয়টি ঢুকে যায়। সেই থেকে স্বপ্ন দেখার শুরু, একদিন আমার প্রতিষ্ঠানে ৫০/১০০ মানুষের রুটি রুজির ব্যবস্থা হবে।

প্রশ্নঃ পারিবারিক সহায়তা কতটা পেয়েছেন? এছাড়া ব্যবসার প্রথম মূলধন পরিবার থেকেই আসে। এক্ষেত্রে পরিবার কতটা ভূমিকা পালন করেছে?

-আমাদের পুরো জীবনটাই তো আমাদের পরিবারের সাথে। আমার পরিবার আমাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে, বলতে শিখিয়েছে, নিজেদের পছন্দ মত ক্যারিয়ার করতে কোন বাধা দেয়নি; এটাই বড় সহায়তা বলে আমি মনে করি। মাঝেমাঝে টাকা পয়সার চেয়ে মানসিক সহায়তা অনেক বেশি জরুরি। চাকরির জন্য তারা কখনোই বেশি চাপ দেয়নি, কারন ছোট থেকেই তারা আমার ইচ্ছে বুঝতে পারায় চাপটা আগেই নাই হয়ে গিয়েছিল। তবে তাদের একটাই আক্ষেপ, আমার পেশাটা তারা ঠিক বোঝে না। মূলধন বলতে আমাদের লক্ষ্যে পৌছোবার অবিচল ইচ্ছে ও বাধা টপকানোর অসীম সাহস ছাড়া আর কিছু ছিলনা।

প্রশ্নঃ শুরুর দিকে কিধরণের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? সংগ্রামের গল্পগুলো জানতে চাই।

-আমরা একবারে বড় কিছু করার জন্য তাড়াহুড়ো করিনি, একটি একটি প্রজেক্ট পেয়েছি। পরবর্তীতে সার্ভিস ও আমাদের ব্যবসার পরিধি বাড়িয়েছি। এছাড়াও কর্মী ব্যবস্থাপনা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ, তার ওপর তখন আমাদের নিজেদের অবস্থাও ভালো ছিলনা। অফিস খরচ, নিজেদের চলাচল বাদ দিয়ে কর্মীদের সন্তুষ্ট রাখা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। এমন বহুদিন গিয়েছে যে সারাদিন অফিস শেষ করে রাতে আবার নিজেদেরই কাজ করতে হয়েছে। পরেরদিন সকালে আবার ক্লায়েন্ট মিটিং এর জন্য শহরের অন্য প্রান্তে ছুটে গিয়েছি। এর ভিতর অবশ্য বেশ কিছু নিবেদিত কর্মী তৈরি হয়ে গিয়েছে এবং ভাললাগার বিষয়, অনেকেই আমাদের কাছে হাতেখড়ি নিয়ে বেশ বড় বড় ফার্মে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে।

প্রশ্নঃ একজন ভালো ব্যবসায়ীর কোন গুণগুলো থাকা দরকার বলে আপনার মনে হয়?

-আমার মনে হয় ব্যবসা একটি সৃজনশীল পেশা। প্রত্যেকটি ব্যবসার আলাদা ধরন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে মোটাদাগে বলতে গেলে, যে যে সেক্টরে কাজ করবে তার খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করা, অন্য যারা কাজ করছে তাদের বিশ্লেষণ করে নিজের ব্যবসার একটি স্বকীয় জায়গা তৈরি করার চেষ্টা করা, গ্রহিতা ও সাপ্লাইয়ার সম্পর্কে পূর্বধারনা নেয়া, সঠিক ক্রেতা চিনতে পারা, মূলধন, আইন কানুন ও সুনির্দিষ্ট বিপননের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে। এছাড়াও দক্ষ কর্মী ও পার্টনার নির্বাচন নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। পাশাপাশি আপনাকে অবশ্যই আপনার কোম্পানির একটা ব্রান্ড ভয়েস কিভাবে তৈরি করা যায় সেটা চিন্তা করতে হবে। যেমন ধরুন আমরা ট্যাগ লাইন সেট করেছি ‘Empowering Digital Business process’। যাতে মানুষকে আলাদা ভাবে বলতে না হয় যে আমরা ব্যবসায়িক ডিজিটাল স্ট্র্যাটেজি নিয়ে কাজ করি, বিক্রিবান্ধব ওয়েবসাইট ও পেপারলেস অফিস তৈরীর সফটওয়্যার টেকনোলজি দিয়ে থাকি। মূলত আমরা যে একটি ডিজিটাল ব্যবসার সব সমাধান দিই এটা যেন ক্রেতারা ওই ট্যাগলাইন দিয়েই বুঝতে পারে।

প্রশ্নঃ ব্যবসা শুরুর আগে একজন মানুষের কোন কোন বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত?

-দেখুন, থিওরিটিক্যালি এখানে অনেক কিছুই বলা যায়। কিন্তু আমি এখানে সব কিছুই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই। তবে আমি নিজেকে এখনো ওরকম আদর্শ ব্যবসায়ী মনে করি না। তাই কিছুটা ভুল ত্রুটি হতে পারে। আমার সীমিত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি একজন ভালো ব্যবসায়ীকে অবশ্যই তার জায়গা থেকে খুবই পরিশ্রমী ও দক্ষ হতে হবে। আপনি যদি বেশিরভাগ সময় অন্যের উপর নির্ভর করে আগাতে চান, তাহলে ব্যবসায় তেমন গতি পাবেন না। সেই সাথে আপনার পরিস্থিতি বিশ্লেষন ক্ষমতা দরকার, যেটার উপর নির্ভর করেই সব সিদ্ধান্তগুলো নেবেন। যেমন ধরুন, টেক-বিজনেস গুলো খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। এখন একজন ভালো ব্যবসায়ীর অবশ্যই বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আগে থেকেই বুঝতে শিখতে হবে এবং সে অনুযায়ী তার প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত আপডেট রাখতে হবে। আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো নেটওয়ার্কিং। প্রতিনিয়ত আপনাকে নতুন নতুন মানুষের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। কারন আপনার পরিচিতি যত বাড়বে, ব্যবসায়ীক সম্ভাবনা তত বাড়বে।

প্রশ্নঃ অনেকেই শুরু করে হারিয়ে যায়। টিকে থাকার মূল মন্ত্র কি?

-হ্যা এটা সত্যি অনেকেই শুরু করে হারিয়ে যায়। তবে এটাও সত্যি যে অনেকে হারিয়ে যাবার জন্যেই শুরু করে। কথাটি বললাম এইজন্য যে, আপনি দেখবেন অনেকেই নিজের ভালো লাগাকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যকে দেখে বা অন্যের সফলতাতে প্রলুব্ধ হয়ে নিজেও তেমন কিছু শুরু করে। কিন্তু যে তার দক্ষতার জায়গায় মার্কেটের সিচুয়েশন অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবসার একটি আলাদা ধরন তৈরি করতে পারবে, সে সহজে হারবে না । কারন, একজন মানুষ যদি তার প্রচন্ড আবেগের জায়গা থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়, সে যেকোনো সমস্যা সমাধানের পথ নিজে থেকেই তৈরি করতে পারবে। নিজের লক্ষ্যটি খুব পরিষ্কার থাকতে হবে। এবং ওই পর্যন্ত যেতে যত সমস্যা আসতে পারে তার একটি তালিকা তৈরি করে সম্ভাব্য সকল সমাধানও প্রস্তুত রাখতে হবে। এরপর প্রয়োজনমাফিক সেগুলোকে কাটছাঁট করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যদিও কথাগুলো যত সহজে আমি বলছি এতটা সহজে ছকবেধে হবে না। কিন্তু ব্যবসা আসলে সহজ কিছু নয়, তাই যারা এ পথে আসবে তাদের জেনেশুনেই কঠিনকে ভালোবাসতে হবে।

প্রশ্নঃ তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কি থাকবে?

কোন পরামর্শ নেই, বরং আমি তরুণ ভাইবোনদের কাছে অনুরোধ করবো তারা যেন নিজের উপর বিশ্বাস করতে শেখে। তারা নিজেরাই বুঝুক এই দুনিয়াতে তারা একটা উদ্দ্যেশ্য নিয়েই এসেছে। সবাইকে ব্যবসা করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। ব্যবসা ছাড়াও অনেক ভালো ক্যারিয়ারের সুযোগ রয়েছে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে। যাই করতে হবে নিজের মন থেকে, ভালো লাগার জায়গা থেকেই করতে হবে। শুধু টাকার জন্যে নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দেয়া ঠিক হবে না বলে আমি মনে করি। নিজেকে ঠিকঠাক প্রস্তুত করতে পারলে টাকা নিজেই এসে ইনবক্সে মেসেজ রিকুয়েস্ট দিবে। আর সর্বশেষ কথা এই যে, কোনো কিছু শুরুর আগে অবশ্যই সেই ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন বা পূর্ণকালীন কাজ করলে সে ব্যাপারে ধারণা অনেকটা স্বচ্ছ হবে। কারন কম জানা মানুষের মনে হয় সুযোগ অনেক বেশি কিন্তু অভিজ্ঞরাই বোঝে যে সুযোগ সীমাবদ্ধ এবং সেগুলো কাজে লাগাতে হয়। এভাবে লেগে থাকার ফলেই ‘SmartB’ আজ অনেকের ক্যারিয়ার তৈরী করেছে ডিজিটাল মার্কেটিং সেক্টরে। শুভকামনা সবার জন্যে।