করোনার ভয়াল থাবায় পুরো বাংলাদেশ যখন বিপর্যস্ত সে সময় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে দেখা যায় বিলকিস বেগম নামের এক মা তার উপার্জনক্ষম ছেলে অনিককে হারিয়ে বিলাপ করছেন আর বলছেন,
‘বাপ-মা হারাইছি, হারাইছি তোর বাবারে। তোর দিকে তাকিয়ে সারাটি জীবন কাটিয়ে দিলাম। আব্বা রে—বাবা রে, তুই আমারে ফালাইয়া কেমনে চলে গেলি রে। আমি তোরে ছাড়া কেমনে থাকুম রে বাবা।’
আজ শনিবার দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের বায়েক গ্রামে সেপটিক ট্যাংকের গ্যাসে দুজন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। তাঁদের একজন হলেন এই অনিক হোসেন। আরেক শ্রমিকের অবস্থাও ভালো না। তাঁকে ওই সময়ই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র মতে, নিহত অনিক হোসেন (২২) কসবা উপজেলার খাড়েরা ইউনিয়নের বুগির গ্রামের মনির হোসেনের একমাত্র ছেলে এবং অপর নিহত জহির মিয়া (২৫) কাইমপুর ইউনিয়নের কাইমপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। আর গুরুতর আহত শ্রমিক জাকির হোসেন (৪০) উপজেলার বায়েক গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে।
পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের বায়েক গ্রামের কামাল হোসেন নামক এক ব্যক্তি একটি ভবন নির্মাণ করছেন। ওই ভবনের জন্য একটি শৌচাগারের সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করেন এবং ২০-২৫ দিন আগে ঐ সেপটিক ট্যাংকের ছাদ দেন। আজ দুপুরে সেপটিক ট্যাংকটি পরিষ্কার এবং শাটারিংয়ের কাঠ-বাঁশ সরিয়ে নিতে নির্মাণ শ্রমিকেরা কাজ শুরু করেন। সেপটিক ট্যাংকে প্রথমে একজন শ্রমিক প্রবেশ করার পর তিনি কোনো কথা না বলায় এ সময় অন্য একজন শ্রমিকও ভেতরে ঢুকেন। কিন্তু তিনিও আর কথা বলছিলেন না। এ সময় সন্দেহ হলে জাকির হোসেন ট্যাংকে নেমে তাঁদের অবস্থা দেখে চিৎকার করতে থাকেন এবং একপর্যায়ে তিনিও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
সেপটিক ট্যাংকে প্রথমে একজন শ্রমিক প্রবেশ করে তিনি কোনো কথা বলছিলেন না। এ সময় অন্য একজন শ্রমিকও ভেতরে ঢুকে তিনিও আর কথা বলছিলেন না। এ সময় তৃতীয়জন ট্যাংকে নেমে তাঁদের অবস্থা দেখে চিৎকার করতে থাকেন।
খবর পেয়ে কসবা থানা-পুলিশ, কুটি চৌমুহনী থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাঁদের তিনজনকে সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করে কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। এ সময় অনিক হোসেন ও জহির মিয়াকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া ও কর্তব্যরত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আনিকা বাশারাত সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে আনার অনেক আগেই দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত জাকির হোসেনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তাঁরা আরো বলেন, “সেপটিক ট্যাংকে অনেক দিনের বিষাক্ত গ্যাস জমা ছিল। বিষাক্ত ওসকল গ্যাস মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ধারণা করা হচ্ছে, ওই গ্যাসের কারণেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।”
খবর পেয়েই নির্মাণ শ্রমিক অনিক হোসেনের মা বিলকিছ বেগম, স্ত্রী রিমা আক্তারসহ পরিবারের অন্যরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। মা বিলকিছ বেগম ও স্ত্রী রিমা আক্তার চিৎকার করতে করতে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। অনিক হোসেনের বাবা নেই অনেক ছোটবেলা থেকে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে অনিক সবার বড় এবং তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই বছর আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তাঁর দুটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানও রয়েছে। অপরদিকে নিহত জহির মিয়ার চাচাতো ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেই চলত জহিরের সংসার।
কসবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আলমগীর ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন,”নিহত দুজনের লাশ আপাতত কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে। এরপর তাঁদের ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে এবংপরবর্তীকালে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”