আমাদের চারপাশে কমন একটা বাক্য – ভাল লাগে না, কিছুই ভাল লাগেনা। খুবই সাধারণ একটা লাইন কিন্তু এই কিছু ভাল লাগেনা থেকেই গভীর হতাশার শুরু! শেষ পরিণতি হয় হয়তো আত্মহত্যা নামক ভয়ংকর ব্যাধি…।
হতাশাগ্রস্থতা, বিষণ্ণতা সল্প সময় ভিত্তিক মোটামুটি সাধারণ সমস্যা হলেও আজ যেন তার প্রভাব খুব মহামারি। অসচেতনার কারনে মানসিক ব্যাধি আর ছোট খাটো কারনকে ঘিরে সুইসাইড হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা ট্রেন্ড।
মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে এবং খুব সামান্য কারনকে ঘিরেও আজকাল সুইসাইডের মতো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।ছোটখাটো কারন গুলোই একসময় রোগের কারন হয়ে দাঁড়ায়। সবার অগোচরে আমাদের প্রিয় মানুষটা কাউকে না জানিয়েই নীরবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। একসময় হয়তো তার এই নীরবে আত্মাহুতির কারন ও বেত হয়। কিন্তু ততোদিনে আমরা হারিয়ে ফেলি প্রিয় মানুষটাকে।
তাই আমরা সুইসাইড নিরসনে সবার আগে প্রাধান্য দেই পারিবারিক সচেতনতাবোধকে। পরিবার যদি একটু সচেতন হয় তাহলেই মানসিক রোগ গুলো নির্ণয় করে রোগীকে সুচিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি আত্মহত্যার ঝুকি থেকে মুক্ত রাখা যায়।
যেসকল মানসিক সমস্যার কারনে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিতে পারে – বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিজ অর্ডার, নেশাদ্রব্য গ্রহণ।
এছাড়াও বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক কারন সমূহ। ব্যর্থতা, একাকিত্ব, পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, বেকারত্ব, অভিমান, অপ্রাপ্তি, প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারন।
স্টপ সুইসাইড কেন, কি, কিভাবে কাজ করছে, পূর্বের কার্যক্রম, লক্ষ্য উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করবো এবার।
স্টপ সুইসাইড একটি স্বেচ্চাসেবী সংগঠন। ২০১৪ সালের ১৮ই নভেম্বর থেকে এই সংগঠন নিয়ে কাজ শুরু করি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে, মানবিকতার দৃষ্টিকোন হতে কাজ করা শুরু করি। যেসকল মানুষেরা বিভিন্ন কারনে আত্মহত্যার কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে তারা আমার কেউ না হলেও আমাদের কেউ। তারা এভাবে আমাদের নিরাশ না করে আমাদের দেশের সম্পদ হতে পারতো। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, আইনজীবী, অর্থনীতিবিধ, রাজনীতিবিধ সহ বিভিন্ন খাতে অবদান রাখতে পারতো।
আমরা অনলাইন এবং অফলাইনে সমানভাবে কাজ করে যাচ্ছি। অনলাইনে ভিক্টিমদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি অফলাইনেও সেবা নিশ্চিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকি।
যারা অনলাইনে আমাদের পেইজের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন তাদের ও সাধ্যমতো সঠিক পরামর্শ প্রদান করার চেষ্টা করি। অনলাইনেই আমাদের ভিক্টিমের সংখ্যা বেশী এবং প্রচুর ভিক্টিম ও আসে।
ভিক্টিমদের প্রয়োজনানুসারে সঠিক সাপোর্ট এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার ট্রাই করি। প্রয়োজনে তাদের ফ্যামিলির সাথে যোগাযোগ করি, কোথায় কিভাবে মানসিক সেবা গ্রহণ করতে পারে তার ব্যাপারে পরামর্শ দিতে চেষ্টা করি।
গণমাধ্যম এবং আমাদের ভলান্টিয়ার ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে প্রাপ্ত সুইসাইড এর তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখি আমাদের রিসার্চ এর জন্য। যাতে আমরা সুইসাইড এর প্রকৃত কারন, বয়স, মাধ্যম চিহ্নিত করতে পারি। আর উক্ত বিষয়গুলোকে অতি গুরুত্বের সাথে নিয়ে আত্মহত্যা নিরসনে কাজ করতে পারি।
পূর্বে আমরা আত্মহত্যাপ্রবণ ভিক্টিম শীলাকে নিয়ে কাজ করেছি। কাজ করেছি বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা ঝিনাইদহে। সেখানে আমরা আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেছি। অচিরেই হয়তো সুযোগ পেলে আমরা আবার যেতে চাই।
আরো বেশ কিছু যায়গা থেকে ওয়ার্কশপ পরিচালনার আমন্ত্রণ থাকলেও কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য আমাদের যাওয়া হয়ে উঠছে না। আমরা সাধারণত নিজেরা কয়েকজন মিলেই ওয়ার্কশপের জন্য পরিকল্পনা ও নিজ অর্থায়নে পরিচালনা করে থাকি। তাই অনেক দূরে যাওয়াটা অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় যাওয়া হয়ে উঠছে না। তবে সব কিছুর পরেও আশা রাখি আমরা নিশ্চয় সে সব যায়গায় পৌঁছাবো।
“আমাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু লিখার আগে আমাদের দেশের একটি স্বনামধন্য পত্রিকা (বাংলাদেশ প্রতিদিন) হতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরছি –
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান মতে –
২০১০ সাল হতে ২০১৭ সালের জুন মাস অব্দি গত সাড়ে সাত বছরে আত্মহত্যার ঘটনার সংখ্যা ৮০,১৮৫ জন। গড় হিসেবে প্রতিবছর ১১ হাজার এবং প্রতিদিন ২৯ জন।
এর মাঝে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশী ছিল। ১০১৭ সালে প্রথম ছয় মাসে ২,৯৭৮ জন আত্মহত্যাকারীদের মাঝে ৭৮৯ জনই ছিল নারী।
বিশেষজ্ঞদের মতে আত্মহত্যার পেছনে সবচেয়ে বেশী দায়ী মানসিক রোগ। আর সবচেয়ে বড় অংশ বিষণ্ণতাবোধ। আত্মহত্যার ঘটনাতে ৭০-৮০% বিষণ্ণতায় ভোগছেন! তারপরের কারনটা হল পারিবারিক কলহ।
বাংলাদেশ হেলথ ইঞ্জুরি সার্ভে ২০১৬ অনুসারে – প্রতি ১ লাখ লাখ জনসংখ্যার ৬৬.৮ জন মানুষের মৃত্যু হয় আঘাতজনিত কারনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মৃত্যু হয় আত্মহত্যাজনিত কারনে। প্রতি ১ লাখে ১৪.৭ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
ইদানীং খেয়াল করা যায় কিশোর কিশোরীদের মাঝেও আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবেগ প্রবণতা যার অন্যতম কারন হিসেবে বিবেচ্য। যে কোন মানসিক আঘাতে যুক্তির চেয়ে আবেগের তাড়নায় তারা আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের(বিএসএমইউর) মনোরোগ বিভাগের আরেক গবেষণা থেকে জানা যায় আত্মহত্যাকারী মানুষের ৬১% বয়স ৩০ এর নিচে। এদের ৫৮% নারী, ২৪% শিক্ষার্থী ও ১৭% গৃহিনী। আত্মহত্যাকারীদের ৬১% গ্রামীণ এলাকার এবং ৪৫% বিবাহিত।
বাংলাদেশে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হলো আত্মহত্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে – পিতা মাতার ভালবাসা বঞ্চিত হয়ে, প্রয়োজনীয় বিনোদনের অভাবে, পারিবারিক অশান্তি, পড়ালিখা নিয়ে শাসন, উত্ত্যক্ততা, মা বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, পারিপারিক শৃঙ্খলার অভাব তরুন প্রজন্মের আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও নিরসনে কাজ করে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। আমরা বিশ্বাস করি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতার চেয়ে বড় কোন প্রতিষেধক নেই।
তাই আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে – দেশের প্রতিটি জেলায়, পরবর্তীকালে প্রতিটি থানায় থানায় আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও সচেতনতামূলক ওয়ার্কশপ পরিচালনা করা। পারিবারিক, সামাজিক ও গণমাধ্যমের সহায়তা নিয়ে সমাজের সকল স্তরে সচেতনতাবোধ বৃদ্ধি করা।
যেসকল আত্মহত্যার ঘটনা সমূহ কোন কারনে পরিসংখ্যানে আসে না। যেমন- এমন ও হতে শুনেছি – আত্মহত্যাজনিত ঘটনায় পুলিশের শরণাপন্ন না হয়ে দাফনকাজ করা হয়ে যায়। যার ফলে সে তথ্য হয়তো আড়ালেই থেকে যায়। যে কোন স্থানে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটলে, উক্ত ব্যাক্তির নাম, বয়স, আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারন, আত্মহত্যার মাধ্যম সহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে এবং আপডেট জানাতে আমাদের রয়েছে *স্টপ সুইসাইড ইনফরমেশন সেন্টার” নামে একটি ফেসবুক পেইজ।
সবার সহযোগীতা পেলে এসকল কেস সমূহের তথ্য ও সংগ্রহ করা,পত্রিকা হতে প্রাপ্ত তথ্য ও আমাদের ভলান্টিয়ার কতৃক সংগ্রহীত তথ্য সমূহ রিসার্চ করে আত্মহত্যার অন্যতম কারন সমূহ অনুসন্ধান করে সেগুলোর সমাধান বা নির্মূলে কাজ করে যাওয়া।
মানসিক সেবা গ্রহণে উৎসাহিতকরণ এবং মানসিক সেবা প্রাপ্তির সহজসাধ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাওয়া।
স্টপ সুইসাইড পেইজ লিংকঃ http://www.facebook.com/Stopsuicide.bd
http://www.facebook.com/SSIC.BD