মোঘল আগ্রাসন প্রতিহতকারী সিংহ বীর – ঈসা খাঁ

2
ঈসা খাঁ

বারো ভুঁইয়া শব্দটি আমি প্রথম দেখি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর “রায়নন্দীনি” বইতে। সেটি ছিল একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। বইটি পড়ার সময়ও আমি জানতাম না উপন্যাসটি কাল্পনিক হলেও উপন্যাসের চরিত্রগুলো সত্যি ছিল একসময়, আমাদের এই বাংলায়। উপন্যাসের নায়ক, বারোভুঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁর চরিত্র পড়ে অসম্ভব মুগ্ধ হয়েছিলাম, কিন্তু জানতাম না বাংলায় সত্যিই একসময় এমন প্রতাপশালী দিগ্বীজয়ী একজন শাসক ছিলেন। আমি মানবিকের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ইতিহাসের এই চরিত্রগুলোর সত্যতা সম্পর্কে জানলাম নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়। ইতিহাস বইয়ে। কিন্তু সেখানেও বারো ভূঁইয়াদের সম্পর্কে লেখা ছিল খুবই স্বল্প পরিসরে, অল্প কথায়।

ইতিহাসের ছাত্রী নই বলে, বারো ভূঁইয়া বা তাদের নেতা ঈসা খাঁ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার তেমন একটা সময়-সুযোগ হয়ে ওঠেনি আর। আজ যখন বারো ভুঁইয়া এবং ঈসা খাঁকে নিয়ে জানব বলে খেয়াল হলো তখন হাতের কাছে গুগলই ভরসা।
ঈসা খাঁ
বারো ভূইয়া- অর্থ বারো জন ভূইয়া বা জমিদার। কারা ছিলেন এই বারো ভূইয়া? কি করেছিলেন তারা? বাংলার ইতিহাসে কেনই বা তাদের এত গুরুত্ব? আমার মত যারা জানেন না বারো ভূঁইয়াদের পরিচয় কিন্তু জানতে আগ্রহী তাদের জন্য এ লেখা।

বারো ভূঁইয়ারা ছিলেন বাংলার স্থানীয় প্রধান ও জমিদার। মুঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর এর রাজত্বকালে বাংলার অনেক অঞ্চল ছিল মুঘলদের শাসনাধীন। সেসময় বাংলার অনেক এলাকার রাজা-জমিদাররা মুঘলদের অধিপত্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বারোভূঁইয়া নামে খ্যাত বাংলার ভাটি অঞ্চলের কিছু জমিদার মুঘলদের অধিপত্য মেনে নিতে চায়নি। তাই তারা গড়ে তুলেছিল মুঘল বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।

প্রকৃতপক্ষে, চতুর্দশ শতকে বাংলায় দু’শত বছরের পুরনো স্বাধীন সালতানাতের পতনের পর আফগান শাসনামল ও মুঘল শক্তির উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হয়। এই বিশৃঙ্খলতার সুযোগে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল বহু সামরিক প্রধান, ভূঁইয়া এবং জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা কখনও যৌথভাবে এবং বেশিরভাগ সময় পৃথকভাবে মুঘল আগ্রাসন প্রতিহত করেছিলেন এবং স্বাধীন বা অর্ধ-স্বাধীন শাসকরূপে তাঁদের নিজ নিজ এলাকা শাসন করেছিলেন। এরাই বারো ভুঁইয়া নামে পরিচিতি পায়।

বারো-ভূঁইয়া শব্দটির অর্থ বারোজন ভূঁইয়া। তবু অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন যে, বারো ভূঁইয়া শব্দটি নির্ভুলভাবে বারোজন ভূঁইয়া বা প্রধানকে বোঝায় না; অনির্দিষ্ট সংখ্যক জমিদারকে বোঝাতেই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কারা ছিলেন এ জমিদার বা ভূঁইয়া তা বহুদিন পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় নি।

বারো ভূঁইয়াদের সংখ্যা এবং সকলের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে কজনের পরিচয় জানা যায় তারা হলেন,
১. ঈসা খাঁ, ২. প্রতাপাদিত্য, ৩. চাঁদ রায়, ৪. কেদার রায়, ৫. কন্দর্প রায় ও রামচন্দ্ররায়, ৫. লক্ষ্মণমাণিক্য, ৬. মুকুন্দরাম রায়, ৭. ফজল গাজী, ৮. হামীর মল্ল বা বীর হাম্বীর, ৯. কংসনারায়ন, ১০. রামকৃষ্ণ, ১১. পীতম্বর ও নীলম্বর, ১২. ঈশা খাঁ লোহানী ও উসমান খাঁ লোহানী।

এসকল বারো ভূঁইয়াগণ কোন রাজপরিবারের বংশধর ছিলেন না বলে জানা যায়। তাঁরা ছিলেন জমিদার বা জমির মালিক এবং দেশপ্রেমিক। অদম্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘ তিন যুগ ধরে বাংলায় মুঘল আগ্রাসন প্রতিহত করেছিলেন। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দের পর বারো ভূঁইয়াদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে যায়। সেসময় সুবাদার ইসলাম খান তাঁদেরকে মুঘলদের বশ্যতাস্বীকার করতে বাধ্য করেন। এরপর বারো ভূঁইয়া নামটি শুধু লোককাহিনী এবং গাঁথায় থেকে যায়।

ঈসা খাঁ এই যে এত সময় ধরে বারোভূঁইয়াদের কথা বললাম, ঈসা খাঁ ছিলেন এই বারোভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম। বারোভূঁইয়াদের নেতা। তিনি ছিলেন প্রবল পরাক্রমশালী। বাংলার এই বীর শাসক বহুদিন যাবত স্বাধীনভাবে বাংলার কিছু অঞ্চল শাসন করেন। মুঘল সম্রাটের সেনাপতি মানসিংহ জীবনে দুব্যক্তিকে পরাজিত করতে পারেননি বলে কথিত আছে- চিতরের রানা প্রতাপ সিং ও সোনারগাঁওয়ের ঈসা খাঁ।

১৫৩৭ সালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার সরাইল পরগণায় ঈসা খাঁর জন্ম।তাঁর পিতা কালিদাস গজদানী ভাগ্যান্বেষণে অযোধ্যা থেকে গৌড়ে এসে স্বীয় প্রতিভা গুণে রাজস্ব মন্ত্রী পদে উন্নীত হন।পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তাঁর নাম হয় সুলাইমান খাঁ।তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৫৩৩-৩৮) মেয়েকে বিয়ে করে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল পরগণা ও পূর্ব মোমেনশাহী অঞ্চলের জায়গীরদারী লাভ করেন।১৫৪৫ সালে শের শাহের পুত্র ইসলাম শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর সুলাইমান খাঁ দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করলে কৌশলে তাঁকে হত্যা করে তাঁর দুই নাবালক পুত্র ঈসা খাঁ এবং ইসমাইল খাঁকে একদল তুরানী বণিকের নিকট বিক্রি করা হয়।

১৫৬৩ সালে ঈসা খাঁর চাচা কুতুব খাঁ রাজকার্যে নিযুক্ত হন। তখন তিনি বহু অনুসন্ধানের পর সুদূর তুরান দেশের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ২ ভ্রাতুস্পুত্রকে উদ্ধার করেন। এ সময় ঈসা খাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। সুলতান তাজ খাঁ কররানী (১৫৬৪-৬৫) সিংহাসনে আরোহণ করে ঈসা খাঁকে তাঁর পিতার জায়গীরদারী ফেরত দেন। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খাঁ কররানীর রাজত্বকালে (১৫৭২-৭৬) ঈসা খাঁ বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন অসাধারণ বীরত্বের জন্যে।

১৫৭৫ সালের অক্টোবর মাসে বাংলার সুবাদার মুনিম খাঁর মৃত্যু হলে আফগান নেতা দাউদ খাঁ কররানী স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজ নামে বাংলা ও বিহারে খুতবা পাঠ করান।স্বাধীন ভূঁইয়ারাও তাঁকে অনুসরণ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন।

এরপর অনেক বীরত্বগাঁথা রচিত হয়। ঈশা খাঁ মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহকে পরাজিত করে ১৫৯৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেছিলেন। তার সাহস, যুদ্ধকৌশল, নেতৃত্বের যোগ্যতা, বীরত্ব, দেশপ্রেম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ষোড়শ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ঈশা খাঁর সফল সংগ্রাম তাকে বাংলার প্রধান ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। ঈশা খাঁকে দীর্ঘ ৫৩ বছর যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছিল। তিনি বাংলায় সর্বপ্রথম নৌবাহিনী গঠন করেছিলেন। তিনিই বাংলায় প্রথম গেরিলা যুদ্ধের প্রচলন করেন এবং নিজেও গেরিলা

যোদ্ধা ছিলেন। তিনি গরিব কৃষকদের কথা চিন্তা করে করমুক্ত রাজ্য গঠন করেছিলেন। তার শাসনকালে বস্ত্র শিল্প, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়।

ঈসা খাঁ তার সোনারগাঁও ও মহেশ্বরদীর জমিদারীকে সাফল্যের সঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত করেন। তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল বৃহত্তর ঢাকার বেশ কিছু অঞ্চল, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং ত্রিপুরা জেলার এক ক্ষুদ্র অংশ ব্যাপী। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের খিজিরপুর এবং কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ী ও এগারসিন্দু ছিল তার শক্তিশালী ঘাঁটি।

ঈসা খাঁ তার রাজধানী স্থাপন করেছিলেন সুবর্ণগ্রামে, যা বর্তমানে সোনারগাঁও নামে পরিচিত। তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা চাঁদরায়ের কন্যা স্বর্ণময়ীকে বিবাহ করেছিলেন। বিয়ের পর স্বর্ণময়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে ঈসা খাঁ তার নাম রাখেন সোনা বিবি। স্ত্রীর নামানুসারেই ঈসা খাঁ তার রাজধানীর নামকরণ করেন সোনারগাঁও।

ঈসা খাঁ রাজ্য শাসনের প্রয়োজনে বিভিন্ন দূর্গে যাতায়াত করতেন। এমনই এক ভ্রমণের সময় ১৫৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে মহেশ্বরী পরগণার অন্তর্গত বক্তারপুর গ্রামে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ থানার অন্তর্গত বক্তারপুর গ্রামে তাকে সমাহিত করা হয়।

ঈসা খাঁর মৃত্যুর পরে তার পুত্র মুসা খাঁ সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন। বৃহত্তর ঢাকা জেলা, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ জেলার অধিকাংশ নিয়ে তার রাজত্ব বিস্তৃত ছিল।১৬৬১ সালের এপ্রিল মাসে মুঘলদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে সোনারগাঁয়ের পতন ঘটে। মুসা খাঁ মুঘলদের আনুগত্য স্বীকার করেন। আর এর ফলেই বাংলায় বারোভুঁইয়াদের পতন অনেকটা নিশ্চিত হয়ে পরে। এভাবেই ইতি ঘটে বারোভুঁইয়াদের প্রায় তিন যুগের শাসনামলের।

লেখকঃ ইতি মল্লিক

2 মন্তব্য

  1. ইসা খান এর যুদ্ধ জয়ের কাহিনী টা বললে আরও ভাল লাগত। তারপর ও লেখাটা ভাল হইসে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে