গৃহহীন থেকে কোটিপতি ক্রিস গার্ডনার

0
গৃহহীন থেকে কোটিপতি ক্রিস গার্ডনার

রাতে থাকার মত জায়গা ছিল না। কম বয়সী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রাত কাটিয়েছেন পাবলিক টয়লেটের মেঝে থেকে শুরু করে পার্ক, চার্চের আশ্রয় শিবির কিংবা রাস্তার ধারে। একসময়ের গৃহহীন এই মানুষটিই বর্তমানে আমেরিকার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী ক্রিস গার্ডনার। তার জীবনের গল্পটি নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখাটি

১৯৮০ এর শুরুর দিকে যখন ২৭ বছর বয়সী যুবক ক্রিস গার্ডনার তার একমাত্র ছোট ছেলেকে নিয়ে সান ফ্রান্সিসকো এর পাবলিক টয়লেটের মেঝেতে শুয়ে ছিলেন তখন কে ভেবেছিল যে তিনিই একদিন আমেরিকার অন্যতম সফল ব্যবসায়ী ও কোটিপতি হয়ে উঠবেন! অর্থাভাবে পূরণ করতে পারেননি ছোট ছেলের আহ্লাদ, কোনমতে খেয়ে রাত কাটাতে হয়েছে পাবলিক টয়লেটের মেঝে থেকে শুরু করে পার্ক, চার্চের আশ্রয় শিবির কিংবা রাস্তার ধারে। এমনকি ইন্টার্ন করা অবস্থায় অফিসের কাজ শেষ করে অফিসের ডেস্কেও আশ্রয় নিয়েছেন বেশ কয়েকবার। কঠোর সংগ্রামী এই মানুষটি গৃহহীন অবস্থা থেকে আজ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সফল এক ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হয়ে উঠেছেন লাখো মানুষের উদাহরণ। ক্রিস গার্ডনারের জীবন সংগ্রামী সেই গল্পটি যেনো উপন্যাসের কাহিনীকেও হার মানাতে বাধ্য।

১৯৫৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকন্সিনের মিলওয়াওকিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ক্রিস গার্ডনার। বেড়ে উঠেছেন তার মা বেটিয়ে জিম গার্ডনার ও পালক বাবা ফ্রেডি ট্রিপলেটের পরিবারে। তার আসল বাবা কে সেটি তিনি কোনদিনও জানতে পারেননি। ক্রিস গার্ডনারের জীবনে মা ছিলেন সব। মা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ। গেটিয়ে জিম সবসময় তার ছেলেকে উৎসাহ জুগিয়ে চলতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন একদিন ক্রিস গার্ডনার বড় কিছু হয়ে দেখাবে। এ প্রসঙ্গে ক্রিস গার্ডনার বলেন, “ছোটকালে একবার টিভিতে বাস্কেটবল দেখার সময় মা’কে বলেছিলাম বাস্কেটবল খেলোয়াড়রা নিশ্চয়ই মিলিয়ন ডলার আয় করে? সে সময় মা আমাকে জবাব দেন, আমার বিশ্বাস তুমিও একদিন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করবে। মা’য়ের এই কথাটি সারাজীবন আমার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিল।”

ক্রিস গার্ডনার

ক্রিসের সৎ বাবা ফ্রেডি ট্রিপলেট সবসময় মদ্যপ অবস্থায় থাকতেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের মারতেন। যার কারণে ক্রিসের ছোটবেলাও মোটেই সুখকর ছিল না। একবার এক মিথ্যা অভিযোগে ক্রিসের মা’কে জেলে পাঠিয়ে দেয় ক্রিসের সৎ বাবা। এরপর ক্রিসকে তার তিন বোনের সঙ্গে ডে কেয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক মাস পর ক্রিসের মা’কে মুক্তি দেওয়া হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তাকে আবারো জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এ সময়টিতে সৎ বাবার প্রতি ক্রিসের ঘৃণা জন্মে যায়। ছোটবেলার স্মরণে ক্রিস গার্ডনার জানান, “১৬ বছর বয়সে একবার গোসল করার সময় আমার আচমকা আমার সৎ বাবা বন্দুল হাতে বাথরুমে ঢুকে আমাকে কাপড়বিহীন অবস্থাতেই ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সেদিন থেকেই আমি সৎ বাবাকে আদর্শ মানা থেকে বিরত হয়ে যাই। সেদিনের কথা আমি কোনদিনও ভুলতে পারব না।”

সেকেন্ডারি স্কুল শেষ করেই ক্রিস গার্ডনার তার মামা হেনরীর আদর্শে আমেরিকান নৌবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য উইসকনসিন ত্যাগ করেন। এসময় নর্থ ক্যারোলিনার ক্যাম্প লেজেওনে তে চার বছর ধরে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি। সেখানে তাকে কাজ করতে হতো হাসপাতালে। এসময় তার সানফ্রানসিসকোর ডা. রবার্ট এলিস নামে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ডা. রবার্ট, গার্ডনার কে তার সাথে ক্যালিফোর্নিয়া মেডিকেল সেন্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিকাল রিসার্চার হিসেবে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৭৪ সালে ইউএস নেভি থেকে অবসর গ্রহণ করে গার্ডনার সানফ্রানসিসকো তে চলে আসেন ডা. রবার্টের সঙ্গে কাজ করতে।

১৯৭৭ সালে ক্রিস গার্ডনার ভার্জিনিয়ার শেরি ডাইসন নামের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। ক্রিস গার্ডনারের মেডিকেল ফিল্ড সম্পর্কিত ভালো জ্ঞান থাকায় তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তার হিসেবে নিজের ভবিষ্যৎ তৈরি করবেন। কিন্তু ইতোমধ্যে চলে যাওয়া সময় ও অর্থের দিকটি মাথায় রেখে তিনি আর মেডিকেলে পড়ার দিকে এগুতো পারেননি। এসব বিষয়ে স্ত্রী শেরি ডাইসনের সঙ্গে নিয়মিত খারাফ বোঝাপড়ার কারণে ক্রিস গার্ডনার জ্যাকি মেডিনা নামের আরেক ডেন্টাল ছাত্রীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সব মিলিয়ে ক্রিসের সঙ্গে তার প্রথম স্ত্রীর ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর জ্যাকি মেডিনার গর্ভে ক্রিসের প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। সে সময়টিতে ক্রিস গার্ডনার ল্যাব সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত বেতন না পাওয়ায় পরিবার চালাতে তাকে হিমসিম খেতে হচ্ছিল। তাই তিনি এ চাকরিটি ছেড়ে দেন ও মেডিকেলের যন্ত্র তৈরি করে এমন কোম্পানির বিক্রয়কর্মী হিসেবে যোগদান করেন।

একদিন তিনি রাস্তায় বব ব্রিজেজ নামের একজনকে লাল ফেরারি পার্ক করতে দেখেন। কৌতুহলবশত ক্রিস, ববের সাথে কথা বলে জানতে পারেন তিনি একজন স্টকব্রোকার হিসেবে কাজ করেন। তাকে দেখে ক্রিসেরও স্টকব্রোকার হিসেবে কাজ করার আগ্রহ জন্মে। কয়েকদিন পর বব ব্রিজেজের সঙ্গে তার পুনরায় দেখা হলে ক্রিস তাকে স্টকব্রোকার হিসেবে কাজ করার আগ্রহের কথা বলেন। বব ব্রিজেস একটি নামকরা স্টকব্রোকার ফার্মে তাকে ইন্টারভিউ এর ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু ইন্টারভিউ এর আগের দিন অবৈধভাবে গাড়ী পার্কিং করার অপরাধে পুলিশ তাকে জরিমানা করে। কিন্তু জরিমানা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় তাকে একদিনের জন্য জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ পেলেও তার গায়ে ছিল আটক হওয়ার সময়কার নোংরা পোশাক। তা সত্ত্বেও চাকরির প্রতি তার আবেগ ও উৎসাহ দেখে জন্য তিনি ডিন রাইটার ডেনোল্ডে চাকরির সুযোগটি পেয়ে যান। স্টকব্রোকারের চাকরিটি ছিল স্বল্পবেতনের ট্রেনিং কোর্স। ট্রেনিং এ সফল হলেই চাকরিটি স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল। ফলে অর্থাভাবে ক্রিসকে এসময় বিপর্যস্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এ সময় ক্রিস গার্ডনার প্রচুর পরিশ্রম শুরু করেন যেন তিনি চাকরিটি ভালো বেতনসহ স্থায়ী করতে পারেন। এর কিছুসময় পূর্বে জ্যাকি তার সন্তানকে নিয়ে তাকে ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে ক্রিসের ইচ্ছায় জ্যাকি তার সন্তানকে ক্রিসের হাতে ছেড়ে দিয়ে আবার চলে যান। এ সময়টিতে ক্রিসের নূন্যতম বেতন দিয়ে খাওয়া ও ঘর ভাড়া দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ক্রিস ঘর ছেড়ে অল্প বয়সী ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এসময়টি ছিল তার জীবনের অন্যতম খারাফ সময়ের মধ্যে একটি। মাঝে মাঝে দিনের বেলায় ছেলেকে ডে কেয়ারে রেখে চাকরিতে চলে যেতেন৷ চাকরি শেষে রাত কাটাতেন রাস্তার পাশে, পার্কের বেঞ্চে, অফিসের ডেস্কে এমনকি মাঝে মাঝে পাবলিক টয়লেটের মেঝেতেও। ভাগ্য ভালো থাকলে কোনদিন পেয়ে যেতেন চার্চের আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সুযোগ। পাশাপাশি অতিরিক্ত আয়ের আশায় ঝাড়ুদার, মালির কাজ থেকে শুরু করে নিজের রক্ত পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

১৯৮২ সালে ক্রিস পাকাপোক্তভাবে স্টকব্রোকার হিসেবে চাকরিটি পেয়ে যান। ভালো বেতন পাওয়ায় এরপর তিনি একটি ঘর ভাড়া করে ছেলেকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন। তিনি পুনরায় জ্যাকির সাথে যোগাযোগ করেন ও এসময় তাদের আরেকটি সন্তান জন্ম নেয়। মূলত এ সময় থেকেই তিনি তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করার সুযোগ পান।

১৯৮৫ সালে ক্রিস গার্ডনারের নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করার সুযোগ ঘটে। এর দুইবছর পর ১৯৮৭ সালে ক্রিস গার্ডনার মাত্র ১০০০০ ডলার নিয়ে শিকাগোতে প্রতিষ্ঠা করেন Gardner Rich & Co নামে নিজের একটি ব্রোকারিজ ফার্ম। নিজের আগ্রহ ও অধ্যবসায় এর ফলে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানকে খুব দ্রুত লাভের মুখ দেখাতে সক্ষম হোন। ২০০৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি কয়েক মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে Christopher Gardner International Holdings নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন ও নিউইয়র্ক, শিকাগো এবং সান ফ্রান্সিসকো শহরে এর শাখা স্থাপন করেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তার আয়ের একটি বিশাল অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত দান করেন যারা গৃহহীনদের সমস্যা সমাধানে কাজ করে থাকে। এছাড়াও তিনি চাকরি প্রত্যাশীদের সহজে চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

The Pursuit of Happyness ক্রিস গার্ডনার

নিজ জীবন সংগ্রামের গল্প তুলে ধরতে ক্রিস গার্ডনার ২০০৬ সালে The Pursuit of Happyness শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেন। একই সময়ে বেস্ট সেলারের তালিকায় স্থান পাওয়া এই বইটির আলোকে হলিউডে মুভি তৈরি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক গ্যাব্রিয়েল মুচিনো। মুভিটিতে ক্রিস গার্ডনারের চরিত্রে অভিনয় করেন বিখ্যাত অভিনেতা উইল স্মিথ। মুক্তির পর মুভিটি আয় করে ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি অর্থ। এছাড়াও অসাধারণ অভিনয়ের জন্য উইল স্মিথের সেরা অভিনেতা হিসেবে অস্কার লাভ সহ মুভিটি জিতে নেয় আরো অসংখ্য পুরস্কার।

বর্ণাঢ্য জীবন সমৃদ্ধ ক্রিস গার্ডনারের পুরস্কারের ঝুলিতেও রয়েছে অসংখ্য পুরস্কার। ২০০২ সালে ন্যাশনাল ফাদারহুড ইনিশিয়েটিভের পক্ষ থেকে ফাদার অব ইয়ার অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের পাশাপাশি অর্জন করেন লস এঞ্জেলস কমিশন অন অ্যাসাল্ট এ্যাগেনিস্ট ওমেন এর পক্ষ থেকে ২৫ তম হিউমেরিটিয়ান পদক। এছাড়াও ২০০৬ সালে কন্টিনেন্টাল আফ্রিকা চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে লাভ করেন ফ্রেন্ডস অব আফ্রিকা অ্যাওয়ার্ড। ২০০৮ সালে নিজের মেয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে হ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়েও বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাকে। বর্তমানে নিজের কাজের পাশাপাশি একজন অনুপ্রেরণাদাতা বক্তা হিসেবেও হাজারো তরুণকে স্বপ্ন দেখানোর কাজ করে চলেছেন এককালের গৃহহীন ক্রিস গার্ডনার।