জাভেদ হাসানকে কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে কোনো কর্মকান্ডে দেখা গেলোনা একবারও।বরং পুরোটা সময় তাকে উদাসীন, বিষাদগ্রস্থ, গোটা এক পৃথিবী লোকের মধ্যেও একাকীত্বে ভোগা একজন মানুষ মনে হয়েছে।
ডুব নিয়ে সমালোচনা করতে গেলে এই ব্যাপারটাই শুধু বলার মতো। বাকি সম্পূর্ণ ‘ডুব’ ভালোলাগার, অসম্ভব ভালোলাগার।
‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক কিনা? আপনি সেই তর্কে না গিয়ে ‘ডুব’এ একবার ডুব দিয়ে নিজেই যাচাই করুন!
জাভেদ হাসানের প্রথম স্ত্রী মায়ার সাথে তার সম্পর্কের টানাপোড়নে জাভেদ হাসান কিংবা নিতুর চেয়ে মায়াকেই আমার বেশি দায়ী মনে হয়েছে।একধরণের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছিলেন মায়া। জাভেদ হাসানকে সারাক্ষণ পীড়া দিয়েছেন তিনি, নিতুর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করেছেন বলা যায়।
নিতু চরিত্রটি কিন্তু ডুবের প্রধান চরিত্র নয়,এমনকি প্রধান তিন চরিত্র বাছাই করলে সেই তালিকায়ও নিতু থাকবে না। জাভেদ হাসান, সাবেরী এবং মায়া-তিনজন ক্লাসের সেরা তিন ছাত্রের মতো ৯৯,৯৮,৯৭ মার্কস তুলেছেন, এতোই অল্প ব্যবধান ছিলো তাদের।
জাভেদ হাসানের সংলাপগুলো বুঝতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে,সংলাপ ছিলোও হাতেগোণা। তাও “মানুষ মারা যায় তখনই,যখন পৃথিবীর কাছে তার প্রয়োজন ফুরায়, কিংবা তার কাছে পৃথিবীর’ শুনে ধক করে বুকে বিঁধেছে। কি সহজ অথচ নিষ্ঠুর সত্য!
জাভেদ হাসান মায়াকে চাইলেও ফেরাতে পারেন নি,তারপর একসময় আর ফেরাতে চাননি। সন্তানদের ভালোবাসা কিংবা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দিশেহারা হয়েছিলেন, নিতু ছাড়া তার অবলম্বন বলতে কি তখন আর কিছু ছিলো? স্রোতে ভেসে যাওয়া মানুষটি তখন খড়কুটোর মতো নিতুকে জড়িয়ে ধরেছেন।
জাভেদ হাসানের নয়নতারা বাড়িতে যেদিন ঝুম বৃষ্টি নামলো, আমি অপেক্ষা করছিলাম এই বুঝি তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে যাবেন! কই,তা তো হলোনা।
জাভেদ হাসান হুট করে নিতুকে বিয়ে করলেন,হুট করে মরে গেলেন? একটা ৮০মিনিটের সিনেমায় আপনি একটু একটু করে গড়ে উঠা কিংবা তিলে তিলে মরে যাওয়ার সম্পূর্ণটাই দেখতে চান? জাভেদ হাসান তো বলেছেন,’মানুষ মারা যায় তখনই,যখন প্রিয়জনের সাথে তার যোগাযোগহীনতা তৈরী হয়’।
নিতুর সাথে দ্বিতীয় সংসারেও জাভেদ হাসান তার প্রিয় সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন,সেই কষ্টবোধ তাকে নিতুর সংসারে পরিপূর্ণ সুখী হতে দেয়নি।
মায়া চরিত্রটি যেন একটু একটু করে ফুটে বেরোচ্ছিলো। আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে থাকা একজন নারী,যিনি আড়ালে নিভৃতে ছিলেন একজন জনপ্রিয় চলচিত্রকারের স্ত্রী হিসেবে,মমতাময়ী মা হিসেবে।তিনি নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছিলেন, কঠিন সময়ে সন্তান-সংসার আগলেছেন, এবং শেষ মূহুর্তে পাথরের মুখোশটি ভেঙ্গেছেন, ‘তুমি মারা গেছো,আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। তুমি এখন আর কারো অধিকারে নেই।আমি এখন চাইলেই চোখে বন্ধ করে তোমাকে দেখতে পারি’।
আর সাবেরী তো ডুবের প্রাণ ছিলো।বাবার প্রিয় মেয়ে,মায়ের বন্ধু সাবেরী। বাবা মা’কে এক করতে প্রানান্ত চেষ্টা করেছে, কঠিন সময়ে মায়ের পাশে থেকেছে, নিজের সাথে যুদ্ধ করেও বাবাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।যে কয়টা বিষাদ,চাপা কান্না কিংবা কান্নার দৃশ্য ছিলো, প্রত্যেকটিই জীবন্ত মনে হয়েছে, সাবেরীর জন্য।
‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক কিনা,সেটা দর্শক হিসেবে আমার মাথব্যথা ছিলোনা।তবে বায়োপিক হলে নিতু চরিত্রটি আড়ালে পড়ে যেতোনা,অপ্রধান থাকতো না। এমনকি সিনেমায় নিতুর সাথে জাভেদ হাসানের সিন হাতেগোণা কিছু ছিলো, এমনটাও হওয়ার কথা ছিলোনা।
জাভেদ হাসান লাইভ ইন্টারভিউতে যখন ‘জাতি আপনাদের কাছ থেকে কি শিখবে’র জবাবে তার বাড়িতে এসে দাঁত ব্রাশ করা,গোসল করা দেখে যেতে বললেন, তখন হঠাৎ মনে পড়লো হুমায়ূন আহমেদের নাটক সিনেমায় যখন এরকম কিছু অতিশয় শিক্ষানুরাগী শিক্ষামূলক কিছু খুঁজতেন, তাদের জন্য হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “শিক্ষা নিয়ে এতো উদ্বিগ্ন হওয়ার পরেও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমশ মূর্খ হচ্ছি কেন, কে বলবে!’
লেখকঃ আজমিনা এলি