নদী আর নদী পাড়ের মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে এর আগে গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝি দেখেছিলাম। মানিকের উপন্যাসের মত করে নয়, গৌতম নিজের মত করে পদ্মা পাড়ের জেলেদের জীবনের বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাই তৌকির যখন হালদার ঘোষণা দিলেন তখন ভাবছিলাম হালদার মাঝিদের তিনি কিভাবে দেখাবেন?
গল্পটা শুরু হয় মনু মিয়ারে নিয়ে। সাগরে মাছ ধরার ধরার কালে জলদস্যুরা তার নৌকায় হামলা চালিয়ে জাল কেড়ে নেয়। কোনমতে পানিতে লাফিয়ে পড়ে মনু তার প্রাণ বাঁচায়। এদিকে মাছের প্রজনন মরসুম শুরু হওয়ায় হালদা নদীতে মা মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু হালদার পাড়ে অপরিকল্পিত ইটকল আর রাসায়নিক কারখানার কারণে বিষাক্ত বিষ মিশে গিয়ে হালদায় মাছের প্রজনন রহিত হয়। কারখানার প্রভাবশালী মালিক নাদের চৌধুরী মনু মিয়ার ঝি হাসুরে বিবাহ করে বাড়িতে নিয়ে যায়। নাদেরের কোন সন্তান হয়না তাই প্রথম স্ত্রীকে ঘরে রেখেই এটি তার দ্বিতীয় বিবাহ। কিন্তু হাসুর প্রণয় বদিউজ্জামানের সাথে। জোর পূর্বক বিবাহ হলেও মনে মনে হাসু বদিউজ্জামানকে চায়।
তৌকিরের অজ্ঞাতনামা, দারুচিনি দ্বীপ অথবা জয়যাত্রা সিনেমার বৈশিষ্ট ছিল তার গল্প বলার ঢং। বেশ গুছিয়ে তিনি তার গল্প উপস্থাপন করেন। কিন্তু হালদা অন্যরকম। তৌকির হয়ত হালদাকে প্রতিবাদ স্বরূপ বানিয়েছেন। দূষণের থেকে হালদাকে বাঁচাতে হয়ত এটি তৌকিরের প্রতিবাদ উপস্থাপন। তাই গল্পের দিকে তার আগ্রহ কম ছিল লেগেছে। একটা প্রেডিক্টেড গল্প দিয়ে তৌকির তার চরিত্রদের সাজিয়েছেন। কিন্তু তার চরিত্ররা ছিলেন অসাধারণ। মনু মিয়া চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু আর তার কন্যা হাসু চরিত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা ভীষণ চমৎকার ছিলেন। বদিউজ্জামান চরিত্রে মোশারফ করিমকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। নাদের চৌধুরী ওরফে জাহিদ হাসান ভাল অভিনয় করেছেন কিন্তু অত সাবলিল ভাবে কথা বলতে পারছিলেন না লেগেছে। নাদেরের মা দিলারা জামানকে বেশ ভাল লেগেছে।
পুরো সিনেমার ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক হওয়াতে বুঝতে অসুবিধা হলেও এই চ্যালেঞ্জ নেবার জন্য তৌকিরকে সাধুবাদ। সকল আঞ্চলিক ভাষায় সিনেমা হোক। তবে সব থেকে ভাল লেগেছে সিনেমার দৃশ্যায়ন। তৌকির যেন মুগ্ধতার ডালি খুলে দিয়েছেন আর আমরা অভিভূত হয়ে তা দর্শন করেছি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝিলিক কিংবা নদীর পানিতে ঝুম বর্ষা, আহারে দৃশ্য।
হালদা শুধু নদীকেই দেখায়নি, এ অঞ্চলের নারীদের সাথে যে ভীষণ অন্যায় করা হয়, নারীদেরকে যে ভোগের পণ্য ভাবা হয় তাও দেখিয়েছে। নারীকে দিয়ে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করিয়েছে। হালদার ভেতরে গল্প নাহয়ে গল্পের ভেতরে হালদা হলে হয়ত আরো ভাল করে উপভোগ করতে পারতাম কিন্তু এটি বলতেই হবে যে, হালদা হলো একটি পুরোপুরি বাংলা সংস্কৃতির সিনেমা যা দেখে আপন আপন অনুভূত হচ্ছিল। হালদা সিনেমার জন্য শুভ কামনা রইল।
লেখকঃ ফায়েজুর রহমান সৈকত