পাক-ভারতের স্বাধীনতাকাল পর্যন্ত বেশ কিছু আপাত স্বাধীন রাজ্য ছিল। সংখ্যায় ৫৬৫ টি। এদের বলা হত প্রিন্সলি স্টেট। যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর আর অন্য রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি না করার শর্তে ব্রিটিশ ভারতে আংশিক স্বাধিকার ভোগ করত। এরমধ্যে প্রভাবশালী রাজ্যগুলোর শাসকদের ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে প্রবেশ কালে গান স্যালুট দিয়ে সম্মান জানান হোত।
এদের বলা হত স্যালুট স্টেট। সর্বোচ্চ একুশটি আর সর্বনিম্ন তিনটি গান স্যালুট (তোপধ্বনি) তে তাদের মর্যাদা নির্ধারিত হত। যেমন হায়দ্রাবাদের মুসলিম নিজাম ২১ টি স্যালুট পেতেন। জুম্মু ও কাশ্মীর, গোয়ালিয়র ও বারোদা এবং মাইসোরের মহারাজাগণও এই সম্মান পেতেন।
তবে শীর্ষ সম্মানের ছিলেন হায়দ্রাবাদের মহামান্য নিজাম। মুঘল আমলে হায়দ্রাবাদ ছিল একটা স্বতন্ত্র সুবাহ। হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম ছিল মীর ওসমান আলী খান আসফ জাহ। টাইম ম্যাগাজিনের মতে সেসময় বিশ্বের শীর্ষ এ ধনী শাসক ওসমান আলী খানের রাজ্যের ছিল নিজস্ব এয়ারলাইন্স, রেল ও নৌ যোগাযোগ। টাইমে ম্যাগাজিনে নিজাম ওসমান আলী খান কে ‘His Exalted Highness’ বলে সম্বোধন করা হয় যেখানে অন্যদের সম্বোধন করা হয় ‘His Excellency’ বলে।
হায়দ্রাবাদ অভ্যন্তরীণ দিক থেকে পূর্ণ স্বাধীন ছিল। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে গেলে তারা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করেন। তারা ভারতের অধীনে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ক্ষুব্ধ হয় তৎকালীন ভারত সরকার।

১৯৪৮ সালে জহরলাল নেহেরুর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণহত্যা চালিয়ে ২ লাখ ১৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার আর দেড় কোটি জনতার রাজ্যটি পরে দখল করেছিল। কমপক্ষে দুই লাখ জনতাকে হত্যার ইতিহাস সেটি- এই অভিমত টেইলর ও এজি খানের মত বিশ্লেষকদের। যেহেতু মুসলিমরাই মূল প্রতিরোধ শক্তি ছিল, তাই হত্যাকাণ্ডের শিকারও তারাই ছিল।
সেসময়ের নেহেরুর পাঠানো কংগ্রেস কমিটিও ২৭ থেকে ৪০ হাজার মানুষ নিহতের কথা উল্লেখ করেছে। বিধায়ক-সুন্দরলালের নেতৃত্বে সেই রিপোর্ট তৈরি হয়েছিল। যা ষাট বছরের বেশি সময় পর ২০১৩ সালে প্রথম জনসম্মুখে আনে ভারত সরকার। সুন্দরলাল রিপোর্টে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি, ধর্ষণের মত যুদ্ধপরাধের উল্লেখ ছিল।
হায়দ্রাবাদে দীর্ঘকাল মুসলিম শাসন থাকলেও এর ৮৫ শতাংশই ছিল হিন্দু নাগরিক। উগ্রপন্থী বাম কর্মীরা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে গুপ্ত হত্যা শুরু করে। টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয় মুসলিম রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, রাজকর্মকর্তা, জায়গির আর ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ।
পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি হায়দ্রাবাদের মহামান্য নেজাম মুসলিম যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ এর অনুকরণে ‘রাজাকার’ বাহিনী গঠন করেন। যার অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী’। যেহেতু রাজাকার বাহিনী মুসলিম যুবকদের নিয়ে ছিল। আর তারা বাম উগ্রপন্থীদের মোকাবেলা করছিলো, আর সেই বামপন্থীরা ছিল হিন্দু তাই ভারত সরকার প্রচারনা চালায় হায়দ্রাবাদে হিন্দু নিধন হচ্ছে।
অভিযোগের ভিত্তিতে হায়দ্রাবাদে ‘অপারেশন পোলো’ পরিচালনা করে ভারত। নিজাম বাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে পুলিশ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা প্রচার করা হলেও আসলে পাঠানো হয় সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় দুর্বল বাহিনী নিয়ে নিজাম ব্যর্থ হন। শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘ ও আমেরিকার সাহায্য প্রার্থনা করেও ব্যর্থ হন। ক্ষয়ক্ষতি আর দীর্ঘস্থায়ী অসম যুদ্ধ এড়াতে বাধ্য হয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ নিজাম তার বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। হায়দ্রাবাদ হয়ে যায় ভারতের রাজ্য। হত্যা করা অসংখ্য বেসামরিক নাগরিককে।

অনেক ঐতিহাসিকের মতে ভারতের এই সামরিক অভিযানে হায়দ্রাবাদে নিহত হয় প্রায় ২ লাখ মানুষ। যদিও ভারতের সরকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ থেকে ৪০ হাজার মানুষ নিহতের কথা।
অথচ এই গণহত্যার কথা উপমহাদেশের অনেকে তো বটেই, ভারতেরও খুব কম সংখ্যক লোক জানে , এমনিকি হায়দ্রাবাদেরো অনেকে এ বিষয়ে কিছু জানেনা। ভারত সরকার এই গণহত্যা বিষয়ে সবসবময়ই গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছে।
তথ্য সুত্রঃ
- Dalrymple, Willam. The Age of Kali.
2. Noorani, A. G. The Destruction of Hyderabad.
3. Thomson, Mike (24 September 2013). “Hyderabad 1948: India’s hidden massacre”.
4. Pandit Sundar Lal Committee Report.
5. Statement of Indian Army.
লেখকঃ আরজু আহমাদ