ইসলাম এবং কৃতদাস সম্পর্ক

0
ইসলাম এবং কৃতদাস

ইসলামকে আক্রমণ করার যতগুলো মারাত্মক অস্ত্র ইসলামবিদ্বেষীরা বা নাস্তিকেরা প্রয়োগ করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – ইসলাম ক্রীতদাসী ও যুদ্ধবন্দিনীদের সাথে যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে বরং ক্রীতদাসী ও যুদ্ধবন্দিনীদের যৌনদাসীতে পর্যবসিত করেছে। তাই না? (point should be noted)

আমি যুক্তির আলোকে নাস্তিকদের প্রোপাগান্ডার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি, গায়ের জোরে নয়, একটু কষ্ট করে পড়তে থাকুন, আশা করছি সদুত্তর পাবেন।

নাস্তিকদের এই ভিত্তিহীন, বানোয়াট প্রোপাগাণ্ডায় যে কেউ ভেবে বসতে পারেন, ইসলামই বুঝি ক্রীতদাসী আর যুদ্ধবন্দিনীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রবর্তক! অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ক্রীতদাসী আর যুদ্ধবন্দিনীদের সাথে অতিপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসা যথেচ্ছ, অমানবিক ও অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারকে ইসলাম সীমিত, মানবিক ও নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে আনার পাশাপাশি তাদেরকে সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সুযোগ প্রদান করেছে যার ফলে একদিক দিয়ে কৃতদাসীর সন্তান যেমন জন্মগতভাবে স্বাধীন ও পিতার সম্পদের উত্তারিকারী হয়, অন্যদিক সন্তান গর্ভধারণের মাধ্যমে ক্রীতদাসী মুক্তি লাভ করে।
ইসলাম এবং কৃতদাস
হ্যাঁ জনাব!
ইসলাম ই প্রথম ধর্ম এবং একমাত্র ধর্ম যা বর্বর যুগের কৃতদাস প্রথায় কৃতদাসের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দিয়েছিলো। আর বিদায় হজ্জ্বের ভাষনে (রাসুলুল্লাহ সা:) স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে গেছেন – দাস প্রথা রহিতকরণ বিষয়ে।

মূল আলোচনায় যাবার আগে কয়েকটি বিষয় আমাদের ভালোভাবে মনে রাখতে হবে:
– দাসপ্রথা ইসলামের উদ্ভাবন নয় , বরং দাসপ্রথা অতিপ্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি নিষ্ঠুর সামাজিক প্রথা। ইসলাম প্রথম ধর্ম যা সমাজে প্রচলিত অমানবিক দাসপ্রথাকে মানবিক করতে সচেষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে নানাবিধভাবে দাসমুক্তকরণের পথ উন্মুক্ত করেছে।
– ক্রীতদাসীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের অধিকার দাসপ্রথার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ , ইসলামের কোন অপরিহার্য, অবশ্য করণীয়, অথবা আকাঙ্ক্ষিত বিষয় নয়। ইসলাম নিজ গণ্ডির ভেতরে এই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেছে মাত্র।
– দাসপ্রথার নিয়মকে ইসলামের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
ইসলাম এবং কৃতদাস
মুনিবের সাথে দৈহিক সম্পর্ক অনুমোদনের যৌক্তিকতা :
মনে রাখতে হবে ইসলাম ক্রীতদাসীর সাথে মুনিবের দৈহিক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটায়নি বরং দাসপ্রথায় যেখানে ক্রীতদাসী যৌনপণ্যর মতো যার ইচ্ছে তার উপভোগের সামগ্রী ছিল, ইসলাম সেটাকে একজন মাত্র পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছিলো। সেই পুরুষ হয়তো তার মুনিব অথবা তাকে বিবাহকারী স্বামী। একজন ক্রীতদাসীর জন্য অন্য কোন পুরুষকে বিবাহ করার চেয়ে নিজ মুনিবের সাথে দৈহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুবিধা হচ্ছে:

সন্তানের মুক্তি :
দাসপ্রথা অনুসারে একজন মুনিবের ক্রীসদাসীর সন্তান (যে উক্ত মুনিবের ঔরসজাত নয়, ক্রীতদাসির স্বামীর সন্তান) উক্ত মুনিবের ক্রীতদাস হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু ইসলাম বলছে – ক্রীতদাসীর সন্তান যদি মুনিবের ঔরসজাত হয়, তবে সে উক্ত মুনিবের সন্তান হিসেবে গণ্য হয়। ফলে সে সন্তান স্বাধীন ও পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

ক্রীতদাসীর সামাজিক মর্যাদা ও মুক্তির সুযোগঃ
আমরা আগেই দেখে এসেছি , ইসলামে মুনিবের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনকারি ক্রীতদাসী তথা উপপত্নী অনেকটাই তার স্ত্রী-সদৃশ। ইসলাম মুনিবের সন্তানধারণকারি ক্রীতদাসীর সামাজিক মর্যাদাকে নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে তার মুক্তির একটি পথকেও উন্মুক্ত করেছে:
ক্রীতাদাসী মুনিবের সন্তান গর্ভে ধারণ করার সাথে সাথে মুনিবের জন্য উক্ত ক্রীতদাসীকে বিক্রয় করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ফলে উক্ত ক্রীতদাসী মুনিবের পরিবারের স্থায়ী সদস্যে পরিণত হয়।

ক্রীতদাসী মুনিবের সন্তান প্রসব করলে (জীবিত অথবা মৃত) উক্ত ক্রীতদাসী ‘উম ওয়ালাদ’ বা ‘সন্তানের মা’ হিসেবে অভিহিত হয়। সেই সন্তান মুনিবের বৈধ, স্বাধীন সন্তান হিসেবে পরিগণিত হয় এবং পিতার সম্পত্তির ঠিক সেরকম উত্তরাধিকার পায় যেরকম স্ত্রী’র সন্তানরা পেয়ে থাকে।
ইসলাম এবং কৃতদাস
মুনিবের মুত্যুর পর ‘উম ওয়ালাদ’ ক্রীতদাসী মুক্ত হয়ে যায়।
কাজেই, দেখা যাচ্ছে ক্রীতদাস প্রথায় ক্রীতদাসীর ওপর অনিয়ন্ত্রিত যে যৌনাচারের সুযোগ ছিল, ইসলাম সেটাকে নিয়ন্ত্রিত, মানবিক করে তুলে প্রচলিত উপবৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে স্ত্রীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, বৈধ ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গিয়ে –
একদিকে ক্রীতদাসীর সন্তানকে মুক্ত, বৈধ ও পিতার সম্পত্তির উত্তারিধারী হবার সুযোগ দিয়েছে,
অন্যদিকে ক্রীতদাসীকে দিয়েছে একটি পারবারিক ঠিকানা ও মুক্তির পথ l

ক্রীতদাসী ও যুদ্ধবন্দিনী সংক্রান্ত কিছু কুরআনের আয়াত :-
ক্রীতদাসীদের (ক্রয়কৃত/অধিকারলব্ধ দাসি বা বণ্টনকৃত যুদ্ধবন্দিনী) জন্য কুরআনে ব্যবহৃত সাধারণ পরিভাষা হচ্ছে “ মা- মালাকাত আইমানুকুম ” বা “ তোমাদের ডান হাতের মালিকাধীন/মালিকানাভুক্ত ”। নিচে ক্রীতদাসী ও যুদ্ধবন্দিনী সংক্রান্ত কিছু কুরআনের আয়াত বা

আয়াতের প্রাসঙ্গিক অংশের অনুবাদ তুলে ধরা হলো :

আয়াতসূত্র-১ : কেবল মুনিবের জন্য নিজ ক্রীতদাসির সাথে দৈহিক সম্পর্কের অনুমোদন
তবে তাদের স্ত্রী ও ডান হাতের মালিকানাভুক্তদের ( দাসীদের) ক্ষেত্রে ( যৌনাঙ্গকে ) সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। (২৩:৬)
( Point to be noted – এই অনুমোদন নি:শর্ত নয় , পুরো পোস্টটি পড়ার পর এই অনুমোদনের ক্ষেত্র ও যৌক্তিকতা বুঝা যাবে ।)

আয়াতসূত্র-২ : বিবাহিত যুদ্ধবন্দিনীদের পূর্বেকার বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন ধরা হবে।
এবং ( তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ ) বিবাহিত নারী তারা ব্যতিত যারা তোমাদের ডান হাতের মালিকাধীন। ( ৪:২৪, প্রাসঙ্গিক অংশ )
Point to be noted : (স্বামী ছাড়া যেসব বিবাহিত নারী যুদ্ধবন্দিনী হয় তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজন্য, স্বামীসহ ধৃত হলে বিবাহ অক্ষুন্ন থাকে, দ্রষ্টব্য : সূত্র-৯ )

আয়াতসূত্র-৩ : ” অন্যের ক্রীতদাসিকে মুনিবের অনুমতিক্রমে বিবাহের অনুমোদন
আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বাধীন মুসলমান নারীকে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে তোমাদের অধিকারভুক্ত মুসলিম ক্রীতদাসীদেরকে বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত রয়েছেন । তোমরা পরস্পর এক , অতএব , তাদেরকে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে বিয়ে কর এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর এমতাবস্থায় যে, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে-ব্যভিচারিণী কিংবা উপ-পতি গ্রহণকারিণী হবে না। ” ( প্রাসঙ্গিক অংশ, ৪:২৫ )

আয়াতসূত্র-৪ : দাসীদের বিবাহ প্রদানের নির্দেশ
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। (প্রাসঙ্গিক অংশ, ২৪:৩২ )

আয়াতসূত্র-৫ : দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা –
তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। (প্রাসঙ্গিক অংশ, ২৪:৩৩ )

হাদিস :-
ইয়াহইয়া মালিক হতে তিনি ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ হতে এবং তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব হতে বলেন, “কোন নারীকে তার ফুপু বা খালার সাথে একই সাথে বিবাহাধীনে রাখা নিষিদ্ধ এবং অন্য পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণকারি কোন ক্রীতদাসির সাথে সহবাস করা নিষিদ্ধ। ( সূত্র: মুয়াত্তা মালিক: অধ্যায় ২৮, হাদিস নং-১১১৫)

মালিক (রহ.) বলেন , “ মুনিবের জন্য মালিকানা বলে খ্রিস্টান ও ইহুদি ক্রীতদাসি হালাল , কিন্তু মালিকানা বলে মাজুসি (magian) ক্রীতদাসির সাথে সহবাস হালাল নয় ।” (মুয়াত্তা মালিক, ইংরেজি অনুবাদের বুক নং ২৮, হাদিস নং ৩৮)

নুমান ইবনে বশির হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন যে তার স্ত্রীর ক্রীতদাসির সাথে সহবাস করেছিল: যদি সে (অর্থাৎ স্ত্রী) তাকে (অর্থাৎ ক্রীতদাসীকে) তার (অর্থাৎ তার স্বামীর) জন্য হালাল করে থাকে, তাকে (পুরুষটিকে) একশ বেত্রাঘাত করা হবে; আর যদি সে তাকে তার জন্য হালাল না করে থাকে, আমি তাকে রজম (প্রস্তরাঘাতে হত্যা) করব। (.সূত্র: আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৪৫৯ )

“ When the army takes a woman captive followed by her husband who is also taken captive sooner or later and either the woman does not have menses during that period or has had upto three menses but she is not taken out of the Territory of War before her husband is taken, their marriage shall continue. Whosoever of the two is taken captive and brought to the Territory of Islam before the other, their marriage shall cease to exist ”

( সূত্র: Chapter II : The Army’s Treatment of the Disbelievers, passage 45, The Shorter Book on Muslim International Law, translated by Mahmood Ahmad Ghazi, মূল: কিতাবুস সিয়ার আস সাগির, লেখক: মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ শায়বানী )
সূত্র-১০ (হাদিস)

আবু মুসা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামম বলেন, “ যার কোন ক্রীতদাসী আছে এবং সে তাকে শিক্ষাদীক্ষা দেয় , তার সাথে সদ্ব্যবহার করে, অতঃপর তাকে মুক্তি প্রদান করে বিবাহ করে, সে দ্বিগুন সওয়াব পাবে।” ( সূত্র: বুখারি, অধ্যায় ৪৬, হাদিস নং-৭২০)

ইয়াহইয়া মালিক হতে বর্ণনা করেন, তিনি শুনেছেন যে উমর ইবনুল খাত্তাব(রা.) তাঁর ছেলেকে একজন ক্রীতদাসী দান করে বলেন , “ তাকে স্পর্শ করো না, যেহেতু আমি তাকে উন্মোচণ করেছি ! ” ( সূত্র: মুয়াত্তা মালিক, অধ্যায় ২৮, হাদিস নং ১১৩০ )

উমর (রা.) বলেন, “ তার (ক্রীতদাসির) সন্তানকে মুক্ত করে দিও …. যদি সে মৃতও হয় ” ( সূত্র: মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা, হাদিস নং ২১৮৯৪ )

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “যখন কোন ব্যক্তির ক্রীতদাসী তার সন্তান ধারণ করে, সে তার ( মুনিবের ) মৃত্যুর পর স্বাধীন হয়ে যায় ! ” ( সূত্র: তিরমিযি , হাদিস নং- ৩৩৯৪ )

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তান গর্ভধারিণী ক্রীতদাসীকে বিক্রয় করো না। ” ( তাবারানি’র মু’যাম আল কাবির, হাদিস নং-৪১৪৭ )
ইসলাম এবং কৃতদাস
সমালোচনা করাই যাদের লক্ষ্য তারা সমালোচনা করবেই , কিন্তু চিন্তা ও উপলদ্ধির দ্বার যারা এখনো বন্ধ করেন নাই আশা করি লেখাটি পড়ে স্পর্শকাতর এই বিষয়টি সম্পর্কে তাদের অনেক ভুল ধারণারই অবসান ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে কৃষ্ণাঙ্গরা দাস প্রথা হতে মুক্ত হয়েছে আঠারোশো শতকে। দক্ষিন আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে উনিশ শতকে।
আর ইসলাম!

মুক্তির পথ দেখিয়েছে হাজার বছর আগে, দাসপ্রথা রহিতকরণ হয়েছে বিদায় হজ্বের ভাষণেই। অস্বীকার করতে পারবেন জনাব????

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে