মহাকাশের অজানা রহস্য কে নিজের জ্ঞানের সীমার মাঝে আবদ্ধ করার ইচ্ছা থেকেই গুটি গুটি পায়ে হাটতে শিখেছে মানুষ তথা মানব সভ্যতা। আকাশ নিয়ে অতীতে মানুষের ধারণাগুলো ঠিক আজকের মত কিন্তু ছিল না । আজ আমরা জানি চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে আর পৃথিবী সূর্যের চারদিকে। এই ধারণাও মানবসভ্যতার একরাতের অর্জন নয়, এতে সময় লেগেছে অনেক, দিতে হয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর শ্রম । যারা বিজ্ঞানী নন, তাদেরও তো আছে আকাশ দেখার সাধ। আর তাই তাদের জন্যেও আছে কিছু যন্ত্রপাতি। শখ করে জ্যোতির্বিদ হতে চাইলে প্রথমেই চাই একটা টেলিস্কোপ, বাংলায় যার অর্থ দূরবীক্ষণযন্ত্র।
বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয়েছিল টেলিস্কোপের। গ্যালিলিও টেলিস্কোপের সাহায্যে বিভিন্ন গ্রহের পরিভ্রমণ পথ পরীক্ষা করে ঘোষণা দিয়েছিলেন সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। বর্তমানে আধুনিক অনেক টেলিস্কোপ তৈরি হচ্ছে।গ্যালিলিওর মৃত্যুর পর আইজ্যাক নিউটন টেলিস্কোপ নিয়ে কাজ শুরু করেন।
বর্তমানে মূলত দুই ধরণের টেলিস্কোপ পাওয়া যায়- প্রতিসরণ টেলিস্কোপ আর প্রতিফলন টেলিস্কোপ। প্রতিসরণ টেলিস্কোপের উদ্ভাবক গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং প্রতিফলন টেলিস্কোপের আইজ্যাক নিউটন। প্রতিসরণ টেলিস্কোপ – এই নাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে এখানে মূলত প্রতিসরণ কে কাজে লাগানো হয়। এতে দুইটি লেন্স ব্যবহার হয়, একটি হয় বড় যা নলের শেষে থাকে একে বলে অভিলক্ষ্য লেন্স, আরেকটি ছোট লেন্স যা নলের শুরুতে থাকে যাকে অভিনেত্র লেন্স বলে। আর প্রতিফলন টেলিস্কোপ নামেই বুঝিয়ে দেয় এই টেলিস্কোপে প্রতিফলনের সূত্র কে কাজে লাগানো হয়। এতে দুইটি লেন্স এর পরিবর্তে দুটি আয়না(প্রতিফলক) ব্যবহাতিকরা হয়। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত অপটিক্যাল দুরবিন, এটি হল গ্রেগরিয়ান বাইনোকুলার দুরবিন। এটি একটি প্রতিফলন টেলিস্কোপ, এটি পৃথিবীর অন্য যে কোনো টেলিস্কোপ চেয়ে বেশি আলো সংগ্রহ করে। এই টেলিস্কোপে তোলা ছবি হাবল মহাকাশ দুরবিনের তোলা ছবি থেকেও দশ গুণ বেশি পরিষ্কার।
এখন সৌখিন জ্যোতির্বিদ যারা হতে চান তাদের জন্যে টেলিস্কোপ নিয়ে কিছু তথ্য। ধরুন আপনি টেলিস্কোপ কিনতে যাবেন। টেলিস্কোপ ক্রয় করার পূর্বে আপনার কয়েকটি বিষয় জানা থাকা দরকার । টেলিস্কোপে কি কি থাকা আবশ্যক কি কি পরিহার করা উচিত তা ঠিকভাবে না জেনে টেলিস্কোপ ক্রয় করলে আপনি ঠিক ভাবে সব কাজ করতে পারবেন না। তাই টেলিস্কোপ ক্রয় করার পূর্বে কয়েকটা বিষয় জানাটা জরুরিঃ
১। ক্ষমতাঃ একটি ভাল টেলিস্কোপ এর ক্ষমতা দ্বারা বিচার করা যাবে না। টেলিস্কোপের উচ্চ ক্ষমতা শুনতে ভাল লাগলেও এর একটি সমস্যা আছে। যখন উচ্চ বিবর্ধন এর মাধ্যমে একটি বস্তুকে বিবর্ধিত করা হয়, তখন টেলিস্কোপের দ্বারা জমাকৃত আলোকরশ্মি বিশাল জায়গা দখল করে যা একটি অস্পষ্ট বিম্ব সৃষ্টি করে।এছাড়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপের আই-পীস (অভিনেত্র) এর নকশার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, যার মাধ্যমে বড় আকারের বিম্ব দেখতে সমস্যা হয়। অনেক সময় কম ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপই ভাল পর্যবেক্ষণ এর অভিজ্ঞতা দেয়। টেলিস্কোপ এর বিবর্ধন ক্ষমতা ৫০ গুন হলে ভাল হয়।
২। উণ্মেষঃ একটি দূরবীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তার উণ্মেষ। উণ্মেষ হল একটি রন্ধ্র যার মধ্য দিয়ে আলো গমন করে। আলোক বিজ্ঞানে উণ্মেষ হল আলোকরশ্মি একত্রকারী লেন্স এর ব্যাস যাকে অভিনেত্র(objective) বলে। উণ্মেষ এর ব্যাস কে সাধারণত মিলিমিটার ও মাঝে মাঝে ইঞ্চিতে প্রকাশ করা হয়( ১ ইঞ্চি = ২৫.৪ মিলিমিটার )। টেলিস্কোপের উণ্মেষ সাধারণত ২.৮ ইঞ্চি (৭০ মিলি) বা এর চেয়ে বেশি হয়। ছোট উণ্মেষ এর তুলনায় বড় উণ্মেষ অনেক ভাল স্পষ্ট বিম্ব সৃষ্টি করে । টেলিস্কোপের লেন্সের ক্ষমতা উণ্মেষ এর আকারের উপর নির্ভর করে। টেলিস্কোপের লেন্সের আলোকরশ্মি কে একত্রিত করার ক্ষমতা ঊণ্মেষ একারের সমানুপাতিক হয় আর টেলিস্কোপ যত আলোকরশ্মি একত্রিত করতে পারে তার মাধ্যমে তত সুস্পষ্ট বিম্ব গঠিত হয় ।
৩। ফোকাস অনুপাতঃ ফোকাস অনুপাত হল ফোকাস দূরত্ব ও টেলিস্কোপের উণ্মেষ এর অনুপাত । ফোকাস দূরত্ব হল আলোক কেন্দ্র থেকে প্রধান ফোকাস বা দ্বিতীয় ফোকাসের দূরত্ব। আর ফোকাস অনুপাত যত ছোট হবে বিম্ব তো উজ্জ্বল হবে।
৪।টেলিস্কোপ ধারক(mount)- সাধারণত টেলিস্কোপ ক্রয় করার সময় কেউই খেয়াল করে ধারক বা আরোহণ ক্রয় করে না কিন্তু এটি খুবই একটি জরুরি বিষয়, কারণ লক্ষ্যবস্তু কত কোণে আছে তা জেনে ঠিক ভাবে টেলিস্কোপ কে বসানোর জন্য ধারক অবশ্যই লাগবে। বাজারে দুই ধরনের ধারক পাওয়া যায়। একটি হল আল্টাজিমাথ(Altazimuth) ধারক- এটি ক্যমেরা ট্রাইপড এর চেয়ে ছোট । এটিতে টেলিস্কোপকে উপর নিচ করা যায় এবং সামনে পিছনে নেয়া যায় । আরেকটি হল ইকুয়াটেরিয়াল(Equatorial ) ধারক- এটিতে সাধারণত মোটর যুক্ত থাকে যার ফলে আকাশে কোন লক্ষ্যবস্তুকে তাক করা যায় । কিছু কিছু ইকুয়াটেরিয়াল এ ছোট কম্পিউটার যুক্ত থাকে । এই টেলিস্কোপ ধারকটি সাধারণত আকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহার করা হয় ।
৫। আই-পীস (অভিনেত্র) : আপনার টেলিস্কোপে কমপক্ষে ১টি আই-পীস থাকবে । অভিনেত্র কে সাধারণত মিলিমিটারে প্রকাশ করা হয়। যারা নতুন টেলিস্কোপ কিনছেন তাদের জন্য ২৫মিলিমিটারের অভিনেত্রই সবচেয়ে উপযুক্ত হবে।
টেলিস্কোপের দাম-দর ও কোথায় পাবেনঃ এখন বাজারে নানা ধরনের টেলিস্কোপ পাওয়া যায়। এই গুলোর মধ্যে অরিয়ন, তাকাহাসি, সেলেস্ট্রন, মীড প্রভৃতি বিশ্ব বিখ্যাত। টেলিস্কোপ ধরণ অনুযায়ী নানা দামের হয়ে থাকে।মূলত আপনি ১০,০০০ হতে কয়েক লক্ষ টাকা দামের টেলিস্কোপ ঢাকা হতে কিনতে পারেন। কিছু টেলিস্কোপ আছে যেগুলোর দিয়ে পৃথিবীর ভেতরেই বিভিন্ন জিনিস দেখা যায়। ঊঁচু পর্বতের তলায় দাড়িয়ে এক টানে চূড়াটাকে কাছে টেনে আনা যায় এমন টেলিস্কোপও আছে। এই টেলিস্কোপগুলো পাওয়া যাবে ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেটে। চাঁদ ভালভাবে দেখতে পারবেন এমন টেলিস্কোপ পাওয়া যাবে ৩৫০০০টাকা থেকে শুরু করে ৪,০০,০০০টাকার মধ্যে। আর সাধারণ দূরত্বে দেখতে চাইলে ১৮,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা দামের টেলিস্কোপই যথেষ্ট। সৌখিন জোতির্বিদদের জন্য বাজারে আছে নানান রকম টেলিস্কোপ। কোনটা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় চাঁদ। কোনটা দিয়ে আবার একলাফে চলে যাওয়া যায় আলোকবর্ষ দূরের গ্রহনক্ষত্রে ।
একটি টেলিস্কোপ খুব সহজেই পারে আপনাকে নিয়ে যেতে মহাকাশের অজানা রাজ্যে, যার শেষ এখনও মানুষ করতে পারেনি। একটি টেলিস্কোপ আপনার সামনে খুলে দিতে পারে এমন ও এক অজানা জগত যেখানে হয়তো বাস করছে কোন এক বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী ।