নেপোলিয়নের সংক্ষিপ্ত জীবন এবং প্রেম

2
নেপোলিয়ন

“বিশ্বে দুটি শক্তি রয়েছে – এগুলো হচ্ছে অসি ও মন। কিন্তু পরিনামে এ দুয়ের দ্বন্দ্বে মনের কাছে অসি শেষ পর্যন্ত পর্যদুস্ত হয়।”
“কল্পনা শক্তি পৃথিবীকে শাসন করে”
“তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দিবো”
“আমার অভিধানে “অসম্ভব” নামে কোন শব্দ নেই”
নেপোলিয়ন

নেপোলিয়নের অনেক উক্তিই তাকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। আবার অনেক উক্তিই তার ব্যক্তিত্ব-প্রজ্ঞা আর মানসিকতাকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। তবু দিগ্বিজয়ী বীরের কথাগুলোকে ইতিহাস আলাদাভাবে স্মরণ করে সব সময়। মেয়েদের নিয়ে নেপোলিয়ন একটা কথা বলেছিলেন- Women are nothing but machines for producing children. অর্থাৎ নারীরা কেবলই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র! আশ্চর্য! অথচ, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ে নেপোলিয়নের ধারণা যুগের তুলনায় কত অগ্রসর। অথচ নারী ভাবনায় তিনি এমন কেন? আসলেই কী নারীদের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন তিনি? না, নেপোলিয়নের বর্ণাঢ্য জীবন কিন্তু সে কথা বলে না। তিনি হয়তো সন্তানের জীবনে মায়েদের ভূমিকার কথা স্বীকার করতে গিয়ে অথবা কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন। এটা মেনে নিতেই হবে।

নেপোলিয়ন দ্য বোনাপার্ট ১৭৬৯ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রান্সের করসিকার এজাক্সিউশ হরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের মাত্র একবছর আগে দ্বীপটি জেনোয়া প্রজাতন্ত্র কর্তৃক ফ্রান্সকে দেওয়া হয়।

মহাবীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৭৯৮ সালে কায়রোর জামে আজহার মসজিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহন উপলক্ষে তিনি যে বানী প্রচার করেন তার দলিল কায়রোর কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে এখোনো রক্ষিত আছে। তৎকালীন বিশেষ ব্যাক্তিদের ডায়েরীতে তার ইসলাম ধর্ম গ্রহনের সত্যতা পাওয়া যায়।

La cases নামক একজন নেপোলিয়নের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তার ডায়েরীতে নেপোলিয়নের ইসলাম ধর্ম গ্রহনের নিশ্চত প্রমান পাওয়া যায়। তাঁর পিতা, কার্লো বোনাপার্ট ১৭৪৬ সালে জেনোয়া প্রজাতন্ত্রে জন্মগ্রহণ করেন। নেপোলিয়নের মা, মারিয়া লেটিজিয়া রামোলিনো তাঁর বাল্যকালে গভীর প্রভাব ফেলেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ঘোড়ার চুল দিয়ে টুথব্রাশ করতেন।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের সময়কার একজন জেনারেল। নেপোলিয়ন ১ নামে ১১ নভেম্বর, ১৭৯৯ থেকে ৬ এপ্রিল ১৮১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন এবং পুনরায় ১৮১৫ সালের ২০ মার্চ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন। তিনি ইতালির রাজাও ছিলেন। এছাড়া তিনি সুইস কনফেডারেশনের মধ্যস্থাকারী এবং কনফেডারেশন অফ রাইনের রক্ষকও ছিলেন।

নেপোলিয়ন ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটারলুতে পরাজিত হন। নেপোলিয়ন তাঁর জীবনের বাকী ছয় বছর ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ সেন্ট হেলেনাতে কাটান। তিনি সারা বিশ্বে সর্বকালের অন্যতম সেরা সেনাপতি হিসেবে সুপরিচিত। নেপোলিয়ন কোড প্রতিষ্ঠাও তাঁর অন্যতম সেরা কীর্তি। তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং বন্ধুদের তাঁর অর্জিত বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসক এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করেন।

যদিও তাদের শাসন নেপোলিয়নের পতন ঠেকাতে পারেনি, নেপোলিয়নের এক ভাতিজা, নেপোলিয়ন ৩ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্স শাসন করেন। তিনি বলতেন- আমি ষাটটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, কিন্তু আমি এমন কিছু শিখিনি যা আমি শুরুতে জানতাম না। ১৭৮৫ সালে স্নাতক করার সময় নেপোলিয়ন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট কমিশন লাভ করেন। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপল্গব প্রকাশ হওয়ার পর পর্যন্ত তিনি নানা জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

নেপোলিয়নের বড়ভাই ছিলেন জোসেফ বোনাপার্ট। নেপোলিয়ন ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর অনুজরা ছিলেন- লুসিয়েন বোনাপার্ট, এলিসা বোনাপার্ট, লুই বোনাপার্ট, পউলিন বোনাপার্ট, ক্যারোলিন বোনাপার্ট এবং জেরোমি বোনাপার্ট। নেপোলিয়নের প্রথম দেখা হয় শ্যাম্পেন প্রস্তুতকারক Jean-Remy Moët-এর সাথে। এই দুজনের বন্ধুত্ব শ্যাম্পেন এবং শ্যাম্পেন প্রস্তুতকারক এলাকার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ব্রিয়েনের ডিগ্রী পাওয়ার পর নেপোলিয়ন ১৭৮৪ সালে প্যারিসের এলিট École Royale Militaire-এ ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাত্র এক বছরেই দুই বছরের কোর্স সমাপ্ত করেন।

একজন পরীক্ষক তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন- “বিমূর্ত বিজ্ঞানের জন্য নিবেদিত প্রাণ, অন্যান্য বিষয়ে কিছুটা আগ্রহশীল; গণিত এবং ভূগোলে ভালো জ্ঞান রয়েছে। তিনি প্রথমে ন্যাভাল বিশয়ে আগ্রহশীল থাকলেও École Militaire-তে আর্টিলারী নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৭৯৬ সালের ২৭ মার্চ নেপোলিয়ন ফরাসি আর্মি অফ ইতালির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সফলতার সাথে ইতালি আক্রমণ করেন।

১৭৯৭ সালেই নেপোলিয়ন ইতালির ফ্রান্স শাসিত রাজ্যসমূহ নিয়ে সিজালপাইন রিপাবলিক (Cisalpine Republic) গড়ে তুলেন। সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত থাকার সময়ও ব্রিটেনজয়ের স্বপ্ন দেখতেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট । ময়নাতদন্তে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পাকস্থলির ক্যান্সারের কথা; যদিও আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় ঘটেছিল এ মৃত্যু_ এমন অনুমান করেছেন বেশকিছু বিজ্ঞানী।

১৮১৫ সালটি ছিল নেপোলিয়নের জন্য একটি ক্রিটিক্যাল বছর। ইউরোপের সব রাষ্ট্রের সম্মিলিত বাহিনীর সঙ্গে তাঁর যুদ্ধের প্রস্তুতিতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। এই সময় জ্যোতিষী দরবারে ঢুকতে না পেরে তাঁর মিত্র এক অমাত্যের মারফত নেপোলিয়নের কাছে একটি ছোট্ট নোট পাঠালেন। তাতে লেখা, ১৮ জুন তারিখটি তোমার জন্য ভয়ানক খারাপ লক্ষণযুক্ত। এদিন কোনো কারণেই যুদ্ধযাত্রা করবে না কিংবা যুদ্ধরত থাকলেও ওই দিন যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে। নেপোলিয়ন নোটটি পেলেন। কিন্তু যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পরে নোটটির কথা ভুলে গেলেন।

জুন মাসের ১৮ তারিখের কদিন আগেই জ্যোতিষী একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্যারিসের পথে যুদ্ধের বাজনা শুনতে পেলেন। তিনি শঙ্কিত হয়ে নেপোলিয়নকে সতর্ক করার জন্য রাজদরবারে ছুটে গেলেন। রক্ষীরা তাঁকে দরবারে ঢুকতে দেয়নি। কিছুক্ষণ পর জ্যোতিষী জানতে পারলেন, সম্রাট যুদ্ধযাত্রা করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীর পিছু পিছু ছুটতে শুরু করলেন।

সম্রাট হওয়ার পর নেপোলিয়ন ফরাসি সাম্রাজ্য আরও বাড়িয়ে নিতে এবং ফ্রান্সকে পরম প্রভাবশালী রাজ্যে পরিণত করতে গিয়ে অনেক যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় ঘটালেন। এর মধ্যে ফোর্থ কোয়ালিশন যুদ্ধ, পেনিনসুলার যুদ্ধ, ফিফথ কোয়ালিশন যুদ্ধ, রাশিয়া আক্রমণ অন্যতম। পেনিনসুলার যুদ্ধে অনেক শহর ধ্বংস এবং পঞ্চাশ হাজারেরও অধিক মানুষকে হত্যা করা হলো। ১৮১২ সালে রাশিয়া আক্রমণকালে সাড়ে চার লাখেরও বেশি ‘গ্র্যান্ড আর্মি’কে ছড়িয়ে দিলেন তিনি। ১৮২১ সালের এ দিনটিতে ফরাসি বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বন্দি অবস্থায় পরলোকগমন করেন।

‘ক্লিসন অ্যান্ড এগুইনি’ নামে একটা উপন্যাসিকা লেখেন তিনি । জনৈক সৈনিক ও তার প্রেমিকাকে নিয়ে এগিয়েছে এর গল্প। এটা আসলে ডিজেরির প্রতি নেপোলিয়নের ভালোবাসারই প্রতিরূপ । সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে ডিজেরি ক্ল্যারির সঙ্গে তরুণ নেপোলিয়নের পরিচয় ঘটেছিল পারিবারিকভাবে। ডিজেরির বোনকে বিয়ে করেছিলেন নেপোলিয়নের ভাই। পৃথিবীজয়ের নেশা তার মাথার ভেতর সারাক্ষণ ছটফট করে, তিনি কীভাবে স্থির থাকেন। স্থির কিছুটা হলেন অবশ্য, তা চিন্তায় । ডিপার্টমেন্টস, উচ্চশিক্ষা, ট্যাক্স কোড, সড়ক ও পয়ঃনিষ্কাশনের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে রিফর্ম করে কেন্দ্রীভূত করলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

রাজ্যে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে সমঝোতা করলেন । এরই মধ্যে পেলেন ফ্রেঞ্চ সায়েন্স একাডেমীর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার। সারা বিশ্বের যতগুলো যুদ্ধের ময়দানের নাম মানুষের মুখে প্রত্যহ উচ্চারিত হয় (যেমন- পলাশী, পানিপথ) তার মধ্যে নিঃসন্দেহে ওয়াটার লু সবচেয়ে বিখ্যাত। ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ন আর ডিউক অফ ওয়েলিংটনের ঐতিহাসিক যুদ্ধ আর নেপোলিয়নের পরাজয়, সেই সঙ্গে তার সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত, সবকিছু মিলিয়েই ওয়াটার লুকে পরিচিত করেছে এক বিশ্ববিদিত নামে।

১৭৯৫ সালের ফ্রান্সের নেপলিয়ান বোনাপার্টের সেনাবাহিনীর এক ভদ্রলোক- নিকোলাস জ্যাকুয়াস কন্ট, আধুনিক পেনসিল আবিষ্কার করেন। তিনি প্রথমে গ্রাফাইটগুলোকে পুড়িয়ে গুঁড়ো করতেন। সেই গুঁড়োর সঙ্গে কাদা মিশিয়ে কাঠির আকৃতি দিতেন।
জোসেফাইনকে লেখা নেপোলিয়নের চিঠি-
সিটিজেনেস জোসেফাইন বোনাপার্ট এপ্রিল 3, 1796
নেপোলিয়নের প্রেম
_________________________________________________
প্রিয়,
আমি তোমার সমস্ত চিঠিই পেয়েছি৷ কিন্তু কোনওটাই শেষ চিঠির মতো এতটা আমার মনে ছাপ ফেলতে পারেনি৷ প্রিয়তমা, কেমন করে তুমি এরকম একটা চিঠি আমাকে লিখতে পারলে! তুমি কি জানো না আমার দুঃখ-বেদনাকে বাদ দিয়েই আমি কতটা সঙ্কটের মুখে আছি৷ কী স্টাইলে, কী অনুভূতি তুমি আমাকে দেখাতে চাইছ! সেগুলো পুড়ে গেছে, এবং আমার হূদয় কেউ ছারখার করে দিয়ে গেছে৷

আমার এক এবং একমাত্র জোসেফাইন, তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোনও আনন্দই নেই়, তুমি ছাড়া গোটা বিশ্বই যেন মরুভূমি, যেখানে মরূদ্যান বলতে কেবল মাত্র আমিই, যেখানে আমি মনের কথা বলতে পারি না৷ তুমি আত্মার থেকেও আরও বড় কিছু আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছ৷ তুমিই আমার জীবনের একমাত্র চিন্তামণি৷

যখন আমি কাজের ভারে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে যাই, যখন আমি সেটা থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজতে চাই, যখন লোকেরা আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে, বিরক্ত করে, যখন বেঁচে থাকতেও আমার ঘৃণা হয়, আমি বুকের উপর হাত রাখ়ি, তোমার ছবি সেখানে টাঙানো থাকে, আমি সেটার দিকে তাকাই৷ ভালোবাসাই আমাকে প্রকৃত আনন্দ এনে দেয়৷ সমস্ত কিছুই দূর হয়ে যায়, শুধু যে সময়টা আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে কাটিয়েছি৷ কী জাদুতে তুমি আমার সমস্ত কিছুই বন্দি করে নিয়েছ? জোসেফাইনের জন্য বেঁচে থাকা আমার কাছে ইতিহাস হয়ে থাকবে৷

আমি তোমার কাছে আসতে চেষ্টা করছি৷ কিন্তু আমি কী বোকা! খেয়ালই করিনি যে তুমি আর আমি ক্রমে সরে যাচিছ৷ কতগুলি দেশ আমাদের আলাদা করে রাখবে! আমার প্রিয়তমা ! আমি জানি না আমার ভাগ্যে কী আছে, কিন্তু যদি তা এখনও আমার থেকে তোমাকে দূরে রাখতে চায়, তাহলে সেটা অসহ্য হয়ে উঠবে! আর তখন এই অদম্য সাহসও আমার কাছে কম মনে হবে৷

একসময় আমি আমার সাহস নিয়ে ভীষণ গর্ব বোধ করতাম৷ আবার কখনও ভাবতাম যে মৃত্যু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তা কেড়ে নিয়ে চলে যাবে৷ কিন্তু, আজকে জোসেফাইন বিপদের মধ্যে দিন কাটাচেছ বা সে অসুস্হ়, এই সমস্ত চিন্তাধারাতেই জোসেফাইন যে আমাকে ভালোবাসে তা আমাকে স্বস্তি দিচেছ না, প্রতিহিংসার সাহস এবং রাগ থাকা সত্ত্বেও আমার রক্ত চলাচল শিথিল করে দিচেছ এবং আমাকে আরও বেশি দুঃখিত ও বিষন্ন করে তুলছে৷

তোমাকে না ভালোবাসতে পেরে মারা যাওয়া, তোমাকে না জানতে পেরে মারা যাওয়া নরক যন্ত্রণার সমান, যেন চূড়ান্ত শূন্যতার জীবন্ত প্রতিবিম্ব৷ আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ আমার একমাত্র সঙ্গিনী যাকে ভাগ্য জীবনের দুঃখসম পথে হঁাটতে বাধ্য করেছে, যেদিন আমি তোমাকে হারাব, সেদিনই প্রকৃতি তার উষ্ণতা হারাবে, আর আমার জীবন বলে কিছু থাকবে না৷ আমি এখন থামছি প্রিয়তমা়, আমার হূদয় দুঃখে ভরে গেছে, শরীর পরিশ্রান্ত, আমার উদ্যম নিঃশেষ ৷ এখন আমার উপর মানুষ ভর করেছে ৷ আমি তাদের ঘৃণা করি৷ তারা আমাকে হূদয় থেকে আলাদা করতে চাইছে৷ অজনেলিয়ার কাছে পোর্ট মরিসে আছি ৷ আগামীকাল আলবেনজা যাব৷

আমি বুয়েলিউকে নিয়ে সন্তুষ্ট়, সে তার পূর্বসূরীর থেকেও বেশি ক্ষমতাবান৷ আশা করি, আমি তাকে অজান্তেই পরাজিত করব ৷ ভয় পেয়ো না ৷ তোমার চোখের মতোই আমাকে ভালোবাসো়, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয় ৷ তোমার মতো, তোমার থেকেও বেশি, তোমার চিন্তাধারার থেকেও বেশি, তোমার জীবনের চেয়েও, তোমার সবকিছুর থেকেও ৷

আমাকে ক্ষমা করো, প্রিয়া, আমি উন্মাদ়, কেউ যখন গভীরভাবে ভাবে, তখন তার কাছে প্রকৃতিও শূন্য মনে হয়, যখন তুমি কাউকে ভালোবাসো তখনও তার একই মনে হয়৷
ইতি
বোনাপার্ট
_______________________________________________

যুদ্ধ-বিগ্রহে ঠাসা এই ফরাসি বীরের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়েই আছেন তার প্রেমিকারা। আর অন্যান্য প্রেমিকা স্ত্রী ও রক্ষিতাদের তালিকা ছাপিয়ে ইতিহাসে একটা নামই এসেছে বারবার। তিনি মেরি জোসেফ রোজ টাচার।

এই জোসেফাইন আবার নেপোলিয়নের স্ত্রী হওয়ার আগে আরেকজনের স্ত্রী ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা রোজের দিন কাটছিল সাদামাটা। আর সে জীবনেই নেপোলিয়নের বর্ণিল ছোঁয়া লাগে অনেকটা নাটকীয়ভাবে।

এই নাটকের সূত্রপাত হয় যখন ডাইরেক্টরি শাসনকর্তারা প্যারির নাগরিকদের বাড়ি তল্লাশি করার ভার দেয় নেপোলিয়নের হাতে। উদ্দেশ্য ছিল বাড়ি তল্লাশি করে সেখান থেকে অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা। নির্দেশ মতো কাজ শুরু হয়ে গেল। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে নেপোলিয়নের অধীনস্থ সেনারা সব অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করছে। এর মধ্যেই ঘটল সেই নাটকীয় ঘটনা। ইউজিন নামের এক কিশোর বালক এসে হাজির নেপোলিয়নের কাছে। ইউজিনের আবেদন তার বাবা আলেকজান্ডারের তরবারিটি ফেরত দিতে হবে। কারণ এটাই তার বাবার স্মৃতিচিহ্ন। ইউজিনের পিতৃপ্রেম আর সাহস দেখে অবাক হলেন নেপোলিয়ন। জানলেন ইউজিনের বাবা রোবসপিয়রের সন্ত্রাসের যুগে গিলোটিনে প্রাণ দিয়েছেন। ১২ বছরের বালকের দৃঢ়তা দেখে মৃদু হাসলেন নেপোলিয়ন। অধীনস্থদের নির্দেশ দিলেন ইউজিনকে তার বাবার তরবারি ফেরত দিতে। নেপোলিয়নের কাছ থেকে ছেলে ইউজিন যে অনুকম্পা পেয়েছে তা গিয়ে পৌঁছাল মা রোজের কানে। রোজ ছুটে এলেন কৃতজ্ঞতা জানাতে। সুন্দরী রোজের সৌজন্যবোধ ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। আর এই মুগ্ধতা এতটাই তীব্র ছিল যে এই রোজই শেষ পর্যন্ত পরিণত হন নেপোলিয়নের প্রিয়তমা স্ত্রীতে। পরে অবশ্য তার নাম বদলে হয়ে যায় জোসেফাইন বোনাপার্ট। তবে জোসেফাইনের সঙ্গে নেপোলিয়নের দেখা হওয়ার এ ঘটনাটি নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আরেকটি মত অনুসারে জোসেফাইনের সঙ্গে নেপোলিয়নের দেখা হয়েছিল একটি পার্টিতে। নেপোলিয়ন তখন তুখোড় সেনাপতি। চতুর্দিকে তখন নেপোলিয়নের অনেক নাম-ডাক। পল বারাস নামক একজন রাজনৈতিক নেতার নজরে পড়লেন নেপোলিয়ন। বারাস তার বাসায় নেপোলিয়নের সম্মানে একটি পার্টি আয়োজন করলেন। শহরের সব গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত পার্টিতে। এর মধ্যেই এক অচেনা রমণীর ওপর চোখ পড়ল বীর সম্রাট নেপোলিনের। অপূর্ব সুন্দরী এই নারীকে দেখেই দারুণ ভালো লেগে যায় নেপোলিয়নের। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এ নিশ্চয়ই কারও না কারও ঘরনী। নেপোলিয়ন তখন গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলছেন। এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে টের পাননি তিনি। হঠাৎ করে তিনি তার কাঁধে পেছন থেকে কারও স্পর্শ অনুভব করলেন। নেপোলিয়ন পেছন ঘুরে দেখেন সেই রমণী।

এ রমণীর ছোটবেলার নাম ছিল মেীি জোসেফ রোজ টাচার। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই কিশোরী রোজের বিয়ে হয় হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ বছর বয়সী ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য বোহারনিজের সঙ্গে। ১৭৮০ সালে এই দম্পতির কোল আলো করে জন্মায় তার প্রথম পুত্র ইউজিন এবং ১৭৮৩ সালে কন্যা হরতেনস। গিলোটিনে স্বামীর প্রাণ গেলেও বেঁচে যান জোসেফাইন।

এই দুই সন্তানের জননী বিধবা রমণীকে দেখে নেপোলিয়নের এমন পাগল হয়ে যাওয়াটা ছিল বিস্ময়কর। কারণ জোসেফাইন ছিলেন নেপোলিয়নের চেয়েও ছয় বছরের বড়। তাহলে কিসের এত মুগ্ধতা?

পেছনের কারণ ঘাঁটতে গেলে দেখা যায়, নেপোলিয়ন খুব অল্প বয়সেই ফরাসি সেনাবাহিনীতে জেনারেল হন। তার ঘাড়ে তখন বিশাল দায়িত্ব। নেপোলিয়নের অধীনে যারা ছিলেন তারা প্রায় সবাই তার থেকে বয়সে অনেক বড়। অসীম সাহসী আর বীরত্ব দেখিয়ে নিজের স্থান অর্জন করলেও বয়স্ক অধীনস্থদের নিয়ে বিব্রত হতেন তিনি। আর এই বিব্রত অবস্থা কাটাতেই নেপোলিয়ন বিয়ের কথা ভাবছিলেন। আর যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে এমন কাউকে করবেন যে হবে তার চেয়েও বয়সে বড়। তাও শুধু বড় হলে হবে না, ধনীও হতে হবে। এতে তার অধীনস্থরা আর যাই হোক তাকে আর পুঁচকে ভাবতে পারবে না। আর এ কারণেই দুই সন্তানের জননী জোসেফাইনের প্রেমে হাবুডুবু খেলেন নেপোলিয়ন। মনের কথাটা জোসেফাইনের কান পর্যন্ত পৌঁছেও দিলেন। কিন্তু প্রথমদিকে বিষয়টিকে একদমই পাত্তা দিলেন না জোসেফাইন। অন্যদিকে পল বারাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার। বারাস নিয়মিত জোসেফাইনের বাসায় যাতায়াত করতেন। বিষয়টি নেপোলিয়নেরও অজানা ছিল না। একদলের মতে নেপোলিয়ন নিজেই বারাসের কাছে জোসেফাইনের কথা বলেছিলেন। আবার আরেক দলের মতে বারাসের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলেন নেপোলিয়ন। সে মতানুসারে বারাসের ইচ্ছাতেই আসলে নেপোলিয়ন আর জোসেফাইনের বিয়েটা হয়েছিল। তখন ফ্রান্সে বিয়ে তেমন কোনো ব্যাপারই না। দুজনে রাজি হলেই বিয়ে হয়ে যেত। দ্বিধা এড়িয়ে জোসেফাইন যখন হ্যাঁ বললেন তখনই ১৭৯৬ সালের ৯ মার্চ তাদের বিয়ে হয়। মজার ব্যাপার হলো নেপোলিয়নের বয়স তখন ২৬ আর জোসেফাইনের ৩২।

নেপোলিয়নের সঙ্গে জোসেফাইনের ডিভোর্স হয় ১৮০৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এ নিয়েও দ্বিধা রয়েছে। একপক্ষের মতানুসারে জোসেফাইন আসলে বারাসের রক্ষিতা ছিলেন। বারাসের চাপেই নেপোলিয়নকে বিয়ে করেন তিনি। এই পক্ষের মতানুসারে জোসেফাইন বহুগামিতায় আসক্ত ছিলেন। ফলে নেপোলিয়ন যখন যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ইতালিতে ব্যস্ত ছিলেন, জোসেফাইন তখন ফিরে যান পুরনো অভ্যাসে। তবে এর মধ্যে জোসেফাইন আর নেপোলিয়নের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান হতো ঠিকই। এরপরও নেপোলিয়ন শেষ পর্যন্ত সব সত্য জেনে যান এবং ডিভোর্সে বাধ্য হন। আবার আরেকটি মতানুসারে কেবলই সিংহাসন রক্ষা ও উত্তরাধিকারের জন্য তিনি জোসেফাইনকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। কারণ নেপোলিয়ন জানতে পেরেছিলেন জোসেফাইন কখনো মা হতে পারবেন না। তবে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও আমৃত্যু দুজনকে দুজন প্রচণ্ড ভালোবেসে গেছেন।

এর বাইরেও নেপোলিয়নের জীবনে নারী ছিল। তবুও ইতিহাসের পুরোটাজুড়ে আছেন কেবলই জোসেফাইন।

লেখকঃ সাইফুল ইসলাম

2 মন্তব্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে