বিষাক্ত সর্প দংশন এবং জীবন ফিরে পাওয়া ফিরোজা বেগমের গল্প

0
বিষাক্ত সর্প দংশন

(১)

সন্ধ্যে নামতেই ঘরের কাজ শেষ করে ফিরোজা বেগম একটা ব্যাগ হাতে করে গোয়াল ঘরের দিকে গেলেন। উদ্দেশ্য, মাচার উপর ব্যাগটাকে তুলে রাখা যাতে ব্যাগের ভেতরের মুগডালের বীজগুলো সংরক্ষিত থাকে। আচানক হাতের মধ্যে ইলেকট্রিক শকের মতো একটা ঝাঁকি অনুভব করলেন তিনি, সেই সাথে ধারলো কিছু হাতে ঢুকে যাবার ঝাঁঝালো একটা ব্যথা অনুভব করলেন। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলেই দেখলেন কি যেন তার হাত কামড়ে ধরে বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাতের শক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছিলো ফিরোজা বেগমের, এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। হাত টানতে গিয়ে হাতের কিছু অংশে ছিলে গেলো। ফিরোজা বেগম দেখলেন, কালচে প্রকান্ড একটা সাপ তার হাত কামড়ে ধরে টানছে। পুরো সময়টা এক কি দুই মিনিটের। ফিরোজা বেগম ঝটকায় সাপের মুখ থেকে হাত মুক্ত করলেন। হাতের কিছু মাংস যেন সাপের মুখেই রয়ে গেলো। উনার চিৎকারে প্রধান ঘর থেকে উনার ছেলে আর স্বামী বেরিয়ে এলেন, ফিরোজা বেগম সাপের প্রস্থানটা শুধু তাকিয়ে দেখলেন।
সর্প দংশন
ঘর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এসে বললেন, এটা নিশ্চিত ইঁদুরেরর কামড় এত চিন্তার কিছু নেই। ফিরোজা বেগম বললেন, না আমাকে পোকায় কামড় দিছে। সবচেয়ে বাজে কাজ হচ্ছে সাপকে সাপ না বলা। এই কুসংস্কারই রোগীর ক্ষতি হবার প্রথম কারণ। ফিরোজা বেগম ওদেরকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন এটা পোকার কামড়। পোকায় কামড়ালে কি মাংস উঠে যায়? ক্ষত থেকে একটু একটু রক্ত পড়ছে। দুইটা দাঁতের দাগ নাকি স্পষ্ট ছিলো ফিরোজা বেগম তাই বলেন। তিনি বললেন, এইটা খারাপ পোকা। পরে সবাই বুঝলেন উনাকে সাপে কেটেছে। এবার হলো নানান আচার উপাচার। শক্ত করে হাত বেঁধে হাতের দফারফা করা, তেঁতুল, পোড়া মরিচ ইত্যাদি খাওয়ানো কিম্বা হাতের মধ্যে এটা সেটা মাখানো, তেল দিয়ে মালিশ কিম্বা ঝাড় ফুঁক! অত:পর, ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া।
সর্প দংশন
চারদিকে হইচই। মানুষের সমাগম ঘরের পরিবেশকে আরো দমবন্ধ বানিয়ে ফেলে। ফিরোজা বেগমের শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। ওঝা হাতের মধ্যে ব্লেড দিয়ে অনেক গুলো দাগ কেটে রক্ত বের করছেন আর বলছেন, কিরে আরাম লাগে? ফিরোজা বেগম বললেন, জ্বী না! ততক্ষনে ১ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা বেগমের ডান হাতটা ফুলে গেছে, হাতে উল্টাদিকে মানে তালুর বিপরীত ফোস্কা পড়ে গেছে, কালো হয়ে গেছে অনেকটাই। ফিরোজা বেগম এর মাথা ঘুরছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, তিনি কথা বলতে পারছেন না, ঝিঁমুনী আসছে ঢুলে ঢুলে পড়ে যাচ্ছেন, ঘাড় সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে, তিনি হালকা স্বরে দুয়েকটা কথা বলছেন, নাকি সুরে কথা আসছিলো , এক সময় উনি আর কথাই বলতে পারছিলেন না। ওঝা বললেন উনি আর পারবেন না। অগত্যা ফিরোজা বেগম ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। যখন উনাকে ওয়ার্ডে আনা হলো তিন ঘন্টার বেশী পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা বেগমের পরিবারের লোকজনের মনে শংকা, শংকা চিকিৎসকদের মনেও, ফিরোজা বেগম কি বাঁচবেন?

(২)

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওয়ার্ড -১৬ তে স্নেইক বাইটের সব রোগী ভর্তি হয়। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেশীই পাচ্ছিলাম। যদিও এর বেশীর ভাগই নির্বিষ সাপের কামড়ের রোগী। বাংলাদেশে বিষধর সাপের সংখ্যা খুব একটা বেশী নেই। হাতে গোনা ৪-৫ প্রজাতি। সাপ চিনতে পারা গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ। কারন একেক সাপের বিষের একেক সাইন সিম্পটম। বাংলাদেশে যে এন্টিভেনম পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে পলি ভ্যালেন্ট এন্টিভেনম। এটা সাধারণত কোবরা , ক্রেইট, রাসেল ভাইপার এইগুলোর উপর কাজ করে। বাংলাদেশে বিষধর সাপ বলতে এগুলোই। তবে সবুজ রঙ এর গ্রীন পীট ভাইপার আর সি স্নেক নামে আরেকটা প্রজাতিও পাওয়া যায়। গ্রীন পীট ভাইপার হচ্ছে লোকালী ভেনোমাস মানে যেখানে কামড়ায় ওই জায়গার মাংসে ক্ষত করে ওখান থেকে ক্ষত বাড়ে, সারা শরীরে এর প্রভাব পড়ে না। সাপের কামড় দিয়ে ( ফ্যাং মার্ক) সাপ বিষধর না বিষহীন বুঝা অনেক কঠিন। যদিও বলা হয় দুই এর অধিক দাগ মানে নির্বিষ সাপ। ওঝারা ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে অনেক সময় বিষধর সাপের কামড়কেও নির্বিষ বানিয়ে ফেলে। আর আক্রন্ত স্থানে ইনফেকশান এর রিস্ক বাড়ে। সাইন সিম্পটম আর রোগী অবজার্ভ করাটাই আসল। ২৪ ঘন্টা রোগীকে ফলো আপ করা অতি জরুরী সেই সাথে নাথিং বাই মাউথ। অনেক সময় সৌভাগ্যক্রমে বিষধর সাপের কামড়েও বিষক্রিয়া দেখা যায়না যেটা খুবই খুবই রেয়ার। একে বলে ড্রাই বাইট!
সর্প দংশন
যাই হোক সাপে কাটা ফিরোজা বেগমকে শুরুতেই আমরা শুইয়ে দিলাম। মুখের লালা, নাক পরিষ্কার করে অক্সিজেন দিলাম। স্যালাইন চালালাম ( DA 1000+ DNS 1000 + NS 1000 @30 d/min, মুখে খাওয়া বন্ধ করলাম, এন্টিবায়োটিক Inj Cefroxime 750 mg TDS এবং Inj Fluclixacillin 500 mg QDS. সেই সাথে Inj TT and Inj TIG দুইটা দুই আর্মে। উনার ক্যাথেটার করে দেয়া হলো। হাতের কামড়ানোর জায়গায় পরিষ্কার করে উপর দিকে তুলে রাখা হলো। শক্ত বাঁধন হালকা করে দেয়া হলো। বাঁধন পুরো খুলে দিলেও দোষ নেই, এক্ষেত্রে রোগী ও তার লোকজন বেশী ভয় পায় বলেই রেখে দেয়া হয় হালকা করে!

(৩)

সাপে কাটা রোগীর সাধারণত তিনটা কপ্লিকেশান হয়।

১) হেমাটোটক্সিসিটি : এতে রক্ত জমাট বাধে না। আমরা রোগী আসলেই ব্লাড নিয়ে একটা ভায়েল এ জমাই। ২০ মিনিট অপেক্ষা করি। রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে দিতেই রোগীর 20 min Whole blood clot ( 20 WBCT) এর পরীক্ষা হয়ে যায়। যদি রক্ত জমাট বাঁধে ভালো, না বাঁধলে ধরে নিতে হয় বিষাক্ত সাপ। আমাদের রোগীকে অবজারভ করতে হবে। কখনো সন্দেহ হলে টেস্ট আবার করা যায় কারন ডিটার্জেন্ট দিয়ে ওয়াশ করা ভায়েল অনেক সময় রক্ত জমাটে বাঁধা দেয়। বিষধর এর বাইরে লোকালী ভেনোমাস গ্রীন পীট ভাইপারেও হেমাটোটক্সিসিটি দেখা যায়।

২) নিউরোটক্সিসিটি : রোগীর মাথা ঘুরানো, ঘাড় সোজা রাখতে না পারা ( ব্রোকেন নেক সাইন) , চোখের পাতা পড়ে যাওয়া ( টোসিস) , নাকি সুরে কথা বলা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা, লালা ঝরা, কথা বলতে না পারা ইত্যাদি।

ফিরোজা বেগম এর এই গুলো প্রায় সবই ছিলো। তাই সাথে সাথেই আমরা উনাকে দুইটা ঔষধ দিলাম।

– Inj Atropine (0.6 mg/ml)
2.5 amp IV stat and 4 hrly

– Inj Neostigmine (500mcg/ml)
( prostig /neostig/stigmin)
2.5 amp IM/SC Stat and 4 hrly

যতক্ষন পর্যন্ত নিউরোটক্সিসিটি না যায়।

কখনো কখনো রোগীকে কৃত্রিম শ্বাস দিয়ে মানে আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশান দিয়ে আই সি ইউ তে রাখতে হয়।

(৪)

এরপর আমরা চিন্তা করলাম এন্টিভেনম দিতে হবে। এর মাঝেই আমরা দেখলাম রোগীর নিউরোটক্সিসিটি ও হেমাটোটক্সিসিটি আছে (ওনার রক্ত ৩০ মিনিটেও জমাট বাঁধেনি)!

আমাদের ওয়ার্ডে সরকারী ভাবেই পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনম পাওয়া যায়। এগুলো ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিক্যালস তৈরি করে থাকে।

Inj Antivenom – 1 vial dilute with 10 cc Distealled Water. Total 10 vial = 100 ml of antivenom mixed with 100 ml of Normal saline IV @ 60 drops/ min.

এটা দিতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা লাগে।

এন্টিভেনম স্পেশালাইজড হাসপাতাল ছাড়া যেখানে সেখানে দেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ এর ফলে এনাফাইলেক্টিক শক হলে বা এঞ্জিও ইডিমা হলে সেটা ম্যানেজকরা ভীষন চ্যালেঞ্জিং।

আমরা এন্টিভেনম দেয়ার আগেই কিছু জিনিস তৈরী রেখেছিলাম। এন্টি ভেনম দেয়ার সময় বিন্দুমাত্র চুলকানি বা দানা দানা লালচে দাগ হলেই আমরা যা করে থাকি তা হলো –

– O2 inhalation
2-3 li /min

– Inj Hydrocortisone (Cotson 100mg)
1 vial IV stat

– Inj Pheniramine maliate ( Avil )
1 amp IV/ IM stat

– Inj Ranitidine
1 amp + 10 cc D/W IV slowly

এরপরও না হলে,

inj Adrenaline (1:1000) (1 ml =1mg =1 amp)
1/2 ( half) I/M stat
if no response, another half I/M.

কিছু সময় এন্টিভেনম বন্ধ রেখে আবার চালু করতে হবে। এন্টিভেনম দেয়ার পর থেকেই রোগীর অবস্থা উন্নতি হতে থাকে। যদিও ২৪ ঘন্টার মধ্যে আবার সাইন সিম্পটম আগের মত ফিরে আসতে পারে এবং রোগীকে আবার আগের মত এন্টিভেনম দিতে হতে পারে। ফলো আপের এই ২৪ ঘন্টা মুখে খাওয়া দিতে হয় না।

(৫)

ফিরোজা বেগমকে আই সি ইউ সাপোর্টে দেবো ভাবছিলাম। এন্টিভেনম দেবার পর পর আমরা শুধু ভয়ে ভয়ে আছি কি রেসপন্স আসে। দুরুদুরু বক্ষে আমরা চেয়ে আছি! তাকিয়ে আছি কখন যে এন্ড্রেনালিন লাগে!

যাই হোক ঈশ্বর হতাশ করেননি। একটু একটু করে পুরো এন্টিভেনমই দেয়া শেষ হলো। ঘন্টা খানেক পর থেকে দেখলাম আস্তে আস্তে উনার গলার স্বর ঠিক হচ্ছে, চোখ খুলছেন, ঘাড়ের সমস্যা অনেকটাই নেই। শুধু ডান হাতটা ফুলে আছে। এলাকার ওঝা হাতে ব্লেড দিয়ে যে দাগ করে দিয়েছে সেগুলা ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে, হাতের মধ্যে ফোস্কা।

পরের দিন সকালে আমাদের সবারই অবাক হবার পালা। ফিরোজা বেগমের চেহারাই বদলে গেছে। তিনি সবার সাথে খোশ গল্প করছেন। বারবার, তিনি বলছেন, আমি বাঁচমু ভাবি নাই গো স্যার, কেমনে বাঁচলাম, আল্লাহ রে আল্লাহ!

এখন আমাদের শুধু ফিরোজা বেগমের হাতের ইনফেকশান ভালো হবার প্রতীক্ষা। জীবনের অনেক স্মৃতিই একদিন ভুলে যাবো কিন্তু কিছু সুস্থ্য হওয়া রোগীর হাসি অনেকদিন মনের মাঝে গেঁথে থাকবে! ভালোই লাগে এসব অভিজ্ঞতা!

মেডিকেল সায়ন্সই পারে এমন লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স দিতে। সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ্য থাকুক! কোন সাপে কাটা রোগী যেন অপচিকিৎসায় মারা না যান। ফিরোজা বেগমরা আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা হয়েই থাকবেন!

(১)

সন্ধ্যে নামতেই ঘরের কাজ শেষ করে ফিরোজা বেগম একটা ব্যাগ হাতে করে গোয়াল ঘরের দিকে গেলেন। উদ্দেশ্য, মাচার উপর ব্যাগটাকে তুলে রাখা যাতে ব্যাগের ভেতরের মুগডালের বীজগুলো সংরক্ষিত থাকে। আচানক হাতের মধ্যে ইলেকট্রিক শকের মতো একটা ঝাঁকি অনুভব করলেন তিনি, সেই সাথে ধারলো কিছু হাতে ঢুকে যাবার ঝাঁঝালো একটা ব্যথা অনুভব করলেন। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলেই দেখলেন কি যেন তার হাত কামড়ে ধরে বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাতের শক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছিলো ফিরোজা বেগমের, এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। হাত টানতে গিয়ে হাতের কিছু অংশে ছিলে গেলো। ফিরোজা বেগম দেখলেন, কালচে প্রকান্ড একটা সাপ তার হাত কামড়ে ধরে টানছে। পুরো সময়টা এক কি দুই মিনিটের। ফিরোজা বেগম ঝটকায় সাপের মুখ থেকে হাত মুক্ত করলেন। হাতের কিছু মাংস যেন সাপের মুখেই রয়ে গেলো। উনার চিৎকারে প্রধান ঘর থেকে উনার ছেলে আর স্বামী বেরিয়ে এলেন, ফিরোজা বেগম সাপের প্রস্থানটা শুধু তাকিয়ে দেখলেন।

ঘর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এসে বললেন, এটা নিশ্চিত ইঁদুরেরর কামড় এত চিন্তার কিছু নেই। ফিরোজা বেগম বললেন, না আমাকে পোকায় কামড় দিছে। সবচেয়ে বাজে কাজ হচ্ছে সাপকে সাপ না বলা। এই কুসংস্কারই রোগীর ক্ষতি হবার প্রথম কারণ। ফিরোজা বেগম ওদেরকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন এটা পোকার কামড়। পোকায় কামড়ালে কি মাংস উঠে যায়? ক্ষত থেকে একটু একটু রক্ত পড়ছে। দুইটা দাঁতের দাগ নাকি স্পষ্ট ছিলো ফিরোজা বেগম তাই বলেন। তিনি বললেন, এইটা খারাপ পোকা। পরে সবাই বুঝলেন উনাকে সাপে কেটেছে। এবার হলো নানান আচার উপাচার। শক্ত করে হাত বেঁধে হাতের দফারফা করা, তেঁতুল, পোড়া মরিচ ইত্যাদি খাওয়ানো কিম্বা হাতের মধ্যে এটা সেটা মাখানো, তেল দিয়ে মালিশ কিম্বা ঝাড় ফুঁক! অত:পর, ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া।

চারদিকে হইচই। মানুষের সমাগম ঘরের পরিবেশকে আরো দমবন্ধ বানিয়ে ফেলে। ফিরোজা বেগমের শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। ওঝা হাতের মধ্যে ব্লেড দিয়ে অনেক গুলো দাগ কেটে রক্ত বের করছেন আর বলছেন, কিরে আরাম লাগে? ফিরোজা বেগম বললেন, জ্বী না! ততক্ষনে ১ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা বেগমের ডান হাতটা ফুলে গেছে, হাতে উল্টাদিকে মানে তালুর বিপরীত ফোস্কা পড়ে গেছে, কালো হয়ে গেছে অনেকটাই। ফিরোজা বেগম এর মাথা ঘুরছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, তিনি কথা বলতে পারছেন না, ঝিঁমুনী আসছে ঢুলে ঢুলে পড়ে যাচ্ছেন, ঘাড় সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে, তিনি হালকা স্বরে দুয়েকটা কথা বলছেন, নাকি সুরে কথা আসছিলো , এক সময় উনি আর কথাই বলতে পারছিলেন না। ওঝা বললেন উনি আর পারবেন না। অগত্যা ফিরোজা বেগম ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। যখন উনাকে ওয়ার্ডে আনা হলো তিন ঘন্টার বেশী পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা বেগমের পরিবারের লোকজনের মনে শংকা, শংকা চিকিৎসকদের মনেও, ফিরোজা বেগম কি বাঁচবেন?

(২)

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওয়ার্ড -১৬ তে স্নেইক বাইটের সব রোগী ভর্তি হয়। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেশীই পাচ্ছিলাম। যদিও এর বেশীর ভাগই নির্বিষ সাপের কামড়ের রোগী। বাংলাদেশে বিষধর সাপের সংখ্যা খুব একটা বেশী নেই। হাতে গোনা ৪-৫ প্রজাতি। সাপ চিনতে পারা গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ। কারন একেক সাপের বিষের একেক সাইন সিম্পটম। বাংলাদেশে যে এন্টিভেনম পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে পলি ভ্যালেন্ট এন্টিভেনম। এটা সাধারণত কোবরা , ক্রেইট, রাসেল ভাইপার এইগুলোর উপর কাজ করে। বাংলাদেশে বিষধর সাপ বলতে এগুলোই। তবে সবুজ রঙ এর গ্রীন পীট ভাইপার আর সি স্নেক নামে আরেকটা প্রজাতিও পাওয়া যায়। গ্রীন পীট ভাইপার হচ্ছে লোকালী ভেনোমাস মানে যেখানে কামড়ায় ওই জায়গার মাংসে ক্ষত করে ওখান থেকে ক্ষত বাড়ে, সারা শরীরে এর প্রভাব পড়ে না। সাপের কামড় দিয়ে ( ফ্যাং মার্ক) সাপ বিষধর না বিষহীন বুঝা অনেক কঠিন। যদিও বলা হয় দুই এর অধিক দাগ মানে নির্বিষ সাপ। ওঝারা ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে অনেক সময় বিষধর সাপের কামড়কেও নির্বিষ বানিয়ে ফেলে। আর আক্রন্ত স্থানে ইনফেকশান এর রিস্ক বাড়ে। সাইন সিম্পটম আর রোগী অবজার্ভ করাটাই আসল। ২৪ ঘন্টা রোগীকে ফলো আপ করা অতি জরুরী সেই সাথে নাথিং বাই মাউথ। অনেক সময় সৌভাগ্যক্রমে বিষধর সাপের কামড়েও বিষক্রিয়া দেখা যায়না যেটা খুবই খুবই রেয়ার। একে বলে ড্রাই বাইট!

যাই হোক সাপে কাটা ফিরোজা বেগমকে শুরুতেই আমরা শুইয়ে দিলাম। মুখের লালা, নাক পরিষ্কার করে অক্সিজেন দিলাম। স্যালাইন চালালাম ( DA 1000+ DNS 1000 + NS 1000 @30 d/min, মুখে খাওয়া বন্ধ করলাম, এন্টিবায়োটিক Inj Cefroxime 750 mg TDS এবং Inj Fluclixacillin 500 mg QDS. সেই সাথে Inj TT and Inj TIG দুইটা দুই আর্মে। উনার ক্যাথেটার করে দেয়া হলো। হাতের কামড়ানোর জায়গায় পরিষ্কার করে উপর দিকে তুলে রাখা হলো। শক্ত বাঁধন হালকা করে দেয়া হলো। বাঁধন পুরো খুলে দিলেও দোষ নেই, এক্ষেত্রে রোগী ও তার লোকজন বেশী ভয় পায় বলেই রেখে দেয়া হয় হালকা করে!

(৩)

সাপে কাটা রোগীর সাধারণত তিনটা কপ্লিকেশান হয়।

১) হেমাটোটক্সিসিটি : এতে রক্ত জমাট বাধে না। আমরা রোগী আসলেই ব্লাড নিয়ে একটা ভায়েল এ জমাই। ২০ মিনিট অপেক্ষা করি। রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে দিতেই রোগীর 20 min Whole blood clot ( 20 WBCT) এর পরীক্ষা হয়ে যায়। যদি রক্ত জমাট বাঁধে ভালো, না বাঁধলে ধরে নিতে হয় বিষাক্ত সাপ। আমাদের রোগীকে অবজারভ করতে হবে। কখনো সন্দেহ হলে টেস্ট আবার করা যায় কারন ডিটার্জেন্ট দিয়ে ওয়াশ করা ভায়েল অনেক সময় রক্ত জমাটে বাঁধা দেয়। বিষধর এর বাইরে লোকালী ভেনোমাস গ্রীন পীট ভাইপারেও হেমাটোটক্সিসিটি দেখা যায়।

২) নিউরোটক্সিসিটি : রোগীর মাথা ঘুরানো, ঘাড় সোজা রাখতে না পারা ( ব্রোকেন নেক সাইন) , চোখের পাতা পড়ে যাওয়া ( টোসিস) , নাকি সুরে কথা বলা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা, লালা ঝরা, কথা বলতে না পারা ইত্যাদি।

ফিরোজা বেগম এর এই গুলো প্রায় সবই ছিলো। তাই সাথে সাথেই আমরা উনাকে দুইটা ঔষধ দিলাম।

– Inj Atropine (0.6 mg/ml)
2.5 amp IV stat and 4 hrly

– Inj Neostigmine (500mcg/ml)
( prostig /neostig/stigmin)
2.5 amp IM/SC Stat and 4 hrly

যতক্ষন পর্যন্ত নিউরোটক্সিসিটি না যায়।

কখনো কখনো রোগীকে কৃত্রিম শ্বাস দিয়ে মানে আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশান দিয়ে আই সি ইউ তে রাখতে হয়।

(৪)

এরপর আমরা চিন্তা করলাম এন্টিভেনম দিতে হবে। এর মাঝেই আমরা দেখলাম রোগীর নিউরোটক্সিসিটি ও হেমাটোটক্সিসিটি আছে (ওনার রক্ত ৩০ মিনিটেও জমাট বাঁধেনি)!

আমাদের ওয়ার্ডে সরকারী ভাবেই পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনম পাওয়া যায়। এগুলো ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিক্যালস তৈরি করে থাকে।
পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনম
Inj Antivenom – 1 vial dilute with 10 cc Distealled Water. Total 10 vial = 100 ml of antivenom mixed with 100 ml of Normal saline IV @ 60 drops/ min.
এন্টিভেনম
এটা দিতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা লাগে।

এন্টিভেনম স্পেশালাইজড হাসপাতাল ছাড়া যেখানে সেখানে দেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ এর ফলে এনাফাইলেক্টিক শক হলে বা এঞ্জিও ইডিমা হলে সেটা ম্যানেজকরা ভীষন চ্যালেঞ্জিং।

আমরা এন্টিভেনম দেয়ার আগেই কিছু জিনিস তৈরী রেখেছিলাম। এন্টি ভেনম দেয়ার সময় বিন্দুমাত্র চুলকানি বা দানা দানা লালচে দাগ হলেই আমরা যা করে থাকি তা হলো –

– O2 inhalation
2-3 li /min

– Inj Hydrocortisone (Cotson 100mg)
1 vial IV stat

– Inj Pheniramine maliate ( Avil )
1 amp IV/ IM stat

– Inj Ranitidine
1 amp + 10 cc D/W IV slowly

এরপরও না হলে,

inj Adrenaline (1:1000) (1 ml =1mg =1 amp)
1/2 ( half) I/M stat
if no response, another half I/M.

কিছু সময় এন্টিভেনম বন্ধ রেখে আবার চালু করতে হবে। এন্টিভেনম দেয়ার পর থেকেই রোগীর অবস্থা উন্নতি হতে থাকে। যদিও ২৪ ঘন্টার মধ্যে আবার সাইন সিম্পটম আগের মত ফিরে আসতে পারে এবং রোগীকে আবার আগের মত এন্টিভেনম দিতে হতে পারে। ফলো আপের এই ২৪ ঘন্টা মুখে খাওয়া দিতে হয় না।

(৫)

ফিরোজা বেগমকে আই সি ইউ সাপোর্টে দেবো ভাবছিলাম। এন্টিভেনম দেবার পর পর আমরা শুধু ভয়ে ভয়ে আছি কি রেসপন্স আসে। দুরুদুরু বক্ষে আমরা চেয়ে আছি! তাকিয়ে আছি কখন যে এন্ড্রেনালিন লাগে!

যাই হোক ঈশ্বর হতাশ করেননি। একটু একটু করে পুরো এন্টিভেনমই দেয়া শেষ হলো। ঘন্টা খানেক পর থেকে দেখলাম আস্তে আস্তে উনার গলার স্বর ঠিক হচ্ছে, চোখ খুলছেন, ঘাড়ের সমস্যা অনেকটাই নেই। শুধু ডান হাতটা ফুলে আছে। এলাকার ওঝা হাতে ব্লেড দিয়ে যে দাগ করে দিয়েছে সেগুলা ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে, হাতের মধ্যে ফোস্কা।

পরের দিন সকালে আমাদের সবারই অবাক হবার পালা। ফিরোজা বেগমের চেহারাই বদলে গেছে। তিনি সবার সাথে খোশ গল্প করছেন। বারবার, তিনি বলছেন, আমি বাঁচমু ভাবি নাই গো স্যার, কেমনে বাঁচলাম, আল্লাহ রে আল্লাহ!

এখন আমাদের শুধু ফিরোজা বেগমের হাতের ইনফেকশান ভালো হবার প্রতীক্ষা। জীবনের অনেক স্মৃতিই একদিন ভুলে যাবো কিন্তু কিছু সুস্থ্য হওয়া রোগীর হাসি অনেকদিন মনের মাঝে গেঁথে থাকবে! ভালোই লাগে এসব অভিজ্ঞতা!

মেডিকেল সায়ন্সই পারে এমন লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স দিতে। সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ্য থাকুক! কোন সাপে কাটা রোগী যেন অপচিকিৎসায় মারা না যান। ফিরোজা বেগমরা আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা হয়েই থাকবেন!

(১)

সন্ধ্যে নামতেই ঘরের কাজ শেষ করে ফিরোজা বেগম একটা ব্যাগ হাতে করে গোয়াল ঘরের দিকে গেলেন। উদ্দেশ্য, মাচার উপর ব্যাগটাকে তুলে রাখা যাতে ব্যাগের ভেতরের মুগডালের বীজগুলো সংরক্ষিত থাকে। আচানক হাতের মধ্যে ইলেকট্রিক শকের মতো একটা ঝাঁকি অনুভব করলেন তিনি, সেই সাথে ধারলো কিছু হাতে ঢুকে যাবার ঝাঁঝালো একটা ব্যথা অনুভব করলেন। হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলেই দেখলেন কি যেন তার হাত কামড়ে ধরে বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাতের শক্তি ক্রমশ কমে যাচ্ছিলো ফিরোজা বেগমের, এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। হাত টানতে গিয়ে হাতের কিছু অংশে ছিলে গেলো। ফিরোজা বেগম দেখলেন, কালচে প্রকান্ড একটা সাপ তার হাত কামড়ে ধরে টানছে। পুরো সময়টা এক কি দুই মিনিটের। ফিরোজা বেগম ঝটকায় সাপের মুখ থেকে হাত মুক্ত করলেন। হাতের কিছু মাংস যেন সাপের মুখেই রয়ে গেলো। উনার চিৎকারে প্রধান ঘর থেকে উনার ছেলে আর স্বামী বেরিয়ে এলেন, ফিরোজা বেগম সাপের প্রস্থানটা শুধু তাকিয়ে দেখলেন।

ঘর থেকে মানুষজন বেরিয়ে এসে বললেন, এটা নিশ্চিত ইঁদুরেরর কামড় এত চিন্তার কিছু নেই। ফিরোজা বেগম বললেন, না আমাকে পোকায় কামড় দিছে। সবচেয়ে বাজে কাজ হচ্ছে সাপকে সাপ না বলা। এই কুসংস্কারই রোগীর ক্ষতি হবার প্রথম কারণ। ফিরোজা বেগম ওদেরকে বোঝাতে ব্যর্থ হলেন এটা পোকার কামড়। পোকায় কামড়ালে কি মাংস উঠে যায়? ক্ষত থেকে একটু একটু রক্ত পড়ছে। দুইটা দাঁতের দাগ নাকি স্পষ্ট ছিলো ফিরোজা বেগম তাই বলেন। তিনি বললেন, এইটা খারাপ পোকা। পরে সবাই বুঝলেন উনাকে সাপে কেটেছে। এবার হলো নানান আচার উপাচার। শক্ত করে হাত বেঁধে হাতের দফারফা করা, তেঁতুল, পোড়া মরিচ ইত্যাদি খাওয়ানো কিম্বা হাতের মধ্যে এটা সেটা মাখানো, তেল দিয়ে মালিশ কিম্বা ঝাড় ফুঁক! অত:পর, ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া।

চারদিকে হইচই। মানুষের সমাগম ঘরের পরিবেশকে আরো দমবন্ধ বানিয়ে ফেলে। ফিরোজা বেগমের শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে। ওঝা হাতের মধ্যে ব্লেড দিয়ে অনেক গুলো দাগ কেটে রক্ত বের করছেন আর বলছেন, কিরে আরাম লাগে? ফিরোজা বেগম বললেন, জ্বী না! ততক্ষনে ১ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা বেগমের ডান হাতটা ফুলে গেছে, হাতে উল্টাদিকে মানে তালুর বিপরীত ফোস্কা পড়ে গেছে, কালো হয়ে গেছে অনেকটাই। ফিরোজা বেগম এর মাথা ঘুরছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, তিনি কথা বলতে পারছেন না, ঝিঁমুনী আসছে ঢুলে ঢুলে পড়ে যাচ্ছেন, ঘাড় সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে, তিনি হালকা স্বরে দুয়েকটা কথা বলছেন, নাকি সুরে কথা আসছিলো , এক সময় উনি আর কথাই বলতে পারছিলেন না। ওঝা বললেন উনি আর পারবেন না। অগত্যা ফিরোজা বেগম ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। যখন উনাকে ওয়ার্ডে আনা হলো তিন ঘন্টার বেশী পেরিয়ে গেছে। ফিরোজা বেগমের পরিবারের লোকজনের মনে শংকা, শংকা চিকিৎসকদের মনেও, ফিরোজা বেগম কি বাঁচবেন?

(২)

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ওয়ার্ড -১৬ তে স্নেইক বাইটের সব রোগী ভর্তি হয়। গত কয়েক সপ্তাহ যাবত সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বেশীই পাচ্ছিলাম। যদিও এর বেশীর ভাগই নির্বিষ সাপের কামড়ের রোগী। বাংলাদেশে বিষধর সাপের সংখ্যা খুব একটা বেশী নেই। হাতে গোনা ৪-৫ প্রজাতি। সাপ চিনতে পারা গুরুত্বপূর্ন একটা কাজ। কারন একেক সাপের বিষের একেক সাইন সিম্পটম। বাংলাদেশে যে এন্টিভেনম পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে পলি ভ্যালেন্ট এন্টিভেনম। এটা সাধারণত কোবরা , ক্রেইট, রাসেল ভাইপার এইগুলোর উপর কাজ করে। বাংলাদেশে বিষধর সাপ বলতে এগুলোই। তবে সবুজ রঙ এর গ্রীন পীট ভাইপার আর সি স্নেক নামে আরেকটা প্রজাতিও পাওয়া যায়। গ্রীন পীট ভাইপার হচ্ছে লোকালী ভেনোমাস মানে যেখানে কামড়ায় ওই জায়গার মাংসে ক্ষত করে ওখান থেকে ক্ষত বাড়ে, সারা শরীরে এর প্রভাব পড়ে না। সাপের কামড় দিয়ে ( ফ্যাং মার্ক) সাপ বিষধর না বিষহীন বুঝা অনেক কঠিন। যদিও বলা হয় দুই এর অধিক দাগ মানে নির্বিষ সাপ। ওঝারা ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে অনেক সময় বিষধর সাপের কামড়কেও নির্বিষ বানিয়ে ফেলে। আর আক্রন্ত স্থানে ইনফেকশান এর রিস্ক বাড়ে। সাইন সিম্পটম আর রোগী অবজার্ভ করাটাই আসল। ২৪ ঘন্টা রোগীকে ফলো আপ করা অতি জরুরী সেই সাথে নাথিং বাই মাউথ। অনেক সময় সৌভাগ্যক্রমে বিষধর সাপের কামড়েও বিষক্রিয়া দেখা যায়না যেটা খুবই খুবই রেয়ার। একে বলে ড্রাই বাইট!

যাই হোক সাপে কাটা ফিরোজা বেগমকে শুরুতেই আমরা শুইয়ে দিলাম। মুখের লালা, নাক পরিষ্কার করে অক্সিজেন দিলাম। স্যালাইন চালালাম ( DA 1000+ DNS 1000 + NS 1000 @30 d/min, মুখে খাওয়া বন্ধ করলাম, এন্টিবায়োটিক Inj Cefroxime 750 mg TDS এবং Inj Fluclixacillin 500 mg QDS. সেই সাথে Inj TT and Inj TIG দুইটা দুই আর্মে। উনার ক্যাথেটার করে দেয়া হলো। হাতের কামড়ানোর জায়গায় পরিষ্কার করে উপর দিকে তুলে রাখা হলো। শক্ত বাঁধন হালকা করে দেয়া হলো। বাঁধন পুরো খুলে দিলেও দোষ নেই, এক্ষেত্রে রোগী ও তার লোকজন বেশী ভয় পায় বলেই রেখে দেয়া হয় হালকা করে!

(৩)

সাপে কাটা রোগীর সাধারণত তিনটা কপ্লিকেশান হয়।

১) হেমাটোটক্সিসিটি : এতে রক্ত জমাট বাধে না। আমরা রোগী আসলেই ব্লাড নিয়ে একটা ভায়েল এ জমাই। ২০ মিনিট অপেক্ষা করি। রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে দিতেই রোগীর 20 min Whole blood clot ( 20 WBCT) এর পরীক্ষা হয়ে যায়। যদি রক্ত জমাট বাঁধে ভালো, না বাঁধলে ধরে নিতে হয় বিষাক্ত সাপ। আমাদের রোগীকে অবজারভ করতে হবে। কখনো সন্দেহ হলে টেস্ট আবার করা যায় কারন ডিটার্জেন্ট দিয়ে ওয়াশ করা ভায়েল অনেক সময় রক্ত জমাটে বাঁধা দেয়। বিষধর এর বাইরে লোকালী ভেনোমাস গ্রীন পীট ভাইপারেও হেমাটোটক্সিসিটি দেখা যায়।

২) নিউরোটক্সিসিটি : রোগীর মাথা ঘুরানো, ঘাড় সোজা রাখতে না পারা ( ব্রোকেন নেক সাইন) , চোখের পাতা পড়ে যাওয়া ( টোসিস) , নাকি সুরে কথা বলা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা, লালা ঝরা, কথা বলতে না পারা ইত্যাদি।

ফিরোজা বেগম এর এই গুলো প্রায় সবই ছিলো। তাই সাথে সাথেই আমরা উনাকে দুইটা ঔষধ দিলাম।

– Inj Atropine (0.6 mg/ml)
2.5 amp IV stat and 4 hrly

– Inj Neostigmine (500mcg/ml)
( prostig /neostig/stigmin)
2.5 amp IM/SC Stat and 4 hrly

যতক্ষন পর্যন্ত নিউরোটক্সিসিটি না যায়।

কখনো কখনো রোগীকে কৃত্রিম শ্বাস দিয়ে মানে আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশান দিয়ে আই সি ইউ তে রাখতে হয়।

(৪)

এরপর আমরা চিন্তা করলাম এন্টিভেনম দিতে হবে। এর মাঝেই আমরা দেখলাম রোগীর নিউরোটক্সিসিটি ও হেমাটোটক্সিসিটি আছে (ওনার রক্ত ৩০ মিনিটেও জমাট বাঁধেনি)!

আমাদের ওয়ার্ডে সরকারী ভাবেই পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনম পাওয়া যায়। এগুলো ইনসেপ্টা ফার্মাসিটিক্যালস তৈরি করে থাকে।

Inj Antivenom – 1 vial dilute with 10 cc Distealled Water. Total 10 vial = 100 ml of antivenom mixed with 100 ml of Normal saline IV @ 60 drops/ min.

এটা দিতে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা লাগে।

এন্টিভেনম স্পেশালাইজড হাসপাতাল ছাড়া যেখানে সেখানে দেয়া মোটেও নিরাপদ নয়। কারণ এর ফলে এনাফাইলেক্টিক শক হলে বা এঞ্জিও ইডিমা হলে সেটা ম্যানেজকরা ভীষন চ্যালেঞ্জিং।

আমরা এন্টিভেনম দেয়ার আগেই কিছু জিনিস তৈরী রেখেছিলাম। এন্টি ভেনম দেয়ার সময় বিন্দুমাত্র চুলকানি বা দানা দানা লালচে দাগ হলেই আমরা যা করে থাকি তা হলো –

– O2 inhalation
2-3 li /min

– Inj Hydrocortisone (Cotson 100mg)
1 vial IV stat

– Inj Pheniramine maliate ( Avil )
1 amp IV/ IM stat

– Inj Ranitidine
1 amp + 10 cc D/W IV slowly

এরপরও না হলে,

inj Adrenaline (1:1000) (1 ml =1mg =1 amp)
1/2 ( half) I/M stat
if no response, another half I/M.

কিছু সময় এন্টিভেনম বন্ধ রেখে আবার চালু করতে হবে। এন্টিভেনম দেয়ার পর থেকেই রোগীর অবস্থা উন্নতি হতে থাকে। যদিও ২৪ ঘন্টার মধ্যে আবার সাইন সিম্পটম আগের মত ফিরে আসতে পারে এবং রোগীকে আবার আগের মত এন্টিভেনম দিতে হতে পারে। ফলো আপের এই ২৪ ঘন্টা মুখে খাওয়া দিতে হয় না।

(৫)

ফিরোজা বেগমকে আই সি ইউ সাপোর্টে দেবো ভাবছিলাম। এন্টিভেনম দেবার পর পর আমরা শুধু ভয়ে ভয়ে আছি কি রেসপন্স আসে। দুরুদুরু বক্ষে আমরা চেয়ে আছি! তাকিয়ে আছি কখন যে এন্ড্রেনালিন লাগে!

যাই হোক ঈশ্বর হতাশ করেননি। একটু একটু করে পুরো এন্টিভেনমই দেয়া শেষ হলো। ঘন্টা খানেক পর থেকে দেখলাম আস্তে আস্তে উনার গলার স্বর ঠিক হচ্ছে, চোখ খুলছেন, ঘাড়ের সমস্যা অনেকটাই নেই। শুধু ডান হাতটা ফুলে আছে। এলাকার ওঝা হাতে ব্লেড দিয়ে যে দাগ করে দিয়েছে সেগুলা ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে, হাতের মধ্যে ফোস্কা।

পরের দিন সকালে আমাদের সবারই অবাক হবার পালা। ফিরোজা বেগমের চেহারাই বদলে গেছে। তিনি সবার সাথে খোশ গল্প করছেন। বারবার, তিনি বলছেন, আমি বাঁচমু ভাবি নাই গো স্যার, কেমনে বাঁচলাম, আল্লাহ রে আল্লাহ!

এখন আমাদের শুধু ফিরোজা বেগমের হাতের ইনফেকশান ভালো হবার প্রতীক্ষা। জীবনের অনেক স্মৃতিই একদিন ভুলে যাবো কিন্তু কিছু সুস্থ্য হওয়া রোগীর হাসি অনেকদিন মনের মাঝে গেঁথে থাকবে! ভালোই লাগে এসব অভিজ্ঞতা!

মেডিকেল সায়ন্সই পারে এমন লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স দিতে। সবাই ভালো থাকুক, সুস্থ্য থাকুক! কোন সাপে কাটা রোগী যেন অপচিকিৎসায় মারা না যান। ফিরোজা বেগমরা আমাদের সামনে অনুপ্রেরণা হয়েই থাকবেন!

লেখক : ডা: মৃণাল সাহা