মমিফিকেশন বা মমিকরণঃ লাশের মমি করার প্রক্রিয়া

0
মমিফিকেশন

প্রাচীন মিশরীয়রা যেন অসভ্য হয়েও নানাবিধ সভ্যতার জন্ম দিয়ে গিয়েছে। এমনিতে মিশরীয়দের আমার খুব আকর্ষনীয় মনে হয়। তার জন্য হয়ত যৌক্তিক কারণও রেখে গেছে তারা। প্রাচীন মিশরীয়দের সবচেয়ে আলোচিত ব্যাপারটা হচ্ছে ‘মমি,’ বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিংও। তবে মমিফিকেশন ব্যাপারটা একদিনে আসে নি প্রাচীন মিশরীয়দের মাঝে । হাজার বছরের একটা পরিক্রমা ছিলো এটা । মমিফিকেশন ‌এর‌ প্রধান কারণ হলো প্রাচীন মিশরীয়দের এক অদ্ভুত বিশ্বাস ।

মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো -যখন একটা মানুষ‌ মারা যায় তখন তার আত্মা শুধুমাত্র তার দেহকে ত্যাগ করে এবং সেই আত্মা পরবর্তীতে আবার তাদের দেহের সাথে মিলিত হবে যখন মৃতের দেহকে সমাধিস্ত করা হবে । কিন্তু সেই আত্মাকে দেহের সাথে মিলিত হবার আগে নিজের দেহকে চিনতে হবে । যাতে তারা দেবতাদের কাছে নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে পারে এবং পরবর্তী জীবনে প্রবেশ করতে পারে ।- এই কারনে প্রয়োজন মৃতদেহকে অবিকৃত রাখা যাতে আত্নারা নিজের দেহকে চিনতে পারে । সেই ধারণার সাথে জন্ম নেয় দেহকে অবিকৃত রাখার ফর্মুলা যা যুগে যুগে আরো আধুনিক হয়েছে ।

মমিফিকেশন
৩ হাজার বছর পরেও সংরক্ষিত আছে মমিকৃত ফেরাউনের লাশ

Pre dynastic period (5000BC – 3000BC) এর সময়কার কিছু জাতি (যেমন: বাদারিয়ান ও নাকাদান) যাদের মিশরীয় আদি পুরুষ বলা হতো তখনকার সময় থেকেই মমিফিকেশন প্রক্রিয়া চলছে । যদিও তখন তা এতো আধুনিক ছিলো না । তারা মায়ের পেটের ভ্রূন যেভাবে থাকে সেইভাবে মৃতদেহকে মরুভুমিতে সমাহিত করতো । মরুভুমির শুষ্ক আবহাওয়া আর উত্তাপ সমস্ত মৃতদেহ থেকে আর্দ্রতা শুষে নিয়ে প্রাকৃতিকভাবে মমি তৈরী করে ফেলতো । পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়া আরো আধুনিক হয় । সেই আধুনিক মিশরীয় রীতিটাই আজ আমরা জানতে চলেছি!

পুরো মমিফিকেশন প্রক্রিয়াকে দুইভাগে ভাগ করা যায় ।

১. Embalming  বা যত্নসহকারে ও সুগন্ধীর দ্বারা দেহকে পরিষ্কার করা

২. Wrapping & Burial বা দেহকে দামী কাপড়‌ দিয়ে মুড়িয়ে সমাধিস্ত করা

এ পর্বে আমরা শুধু Embalming ধাপ নিয়ে আলোচনা করবো । এই প্রক্রিয়ারও অনেকগুলো ধাপ আছে ।

১. প্রথমত মৃতদেহকে একটা তাবুতে নিয়ে যাওয়া হয় যার নাম “ইবু” (Ibu) যার অর্থ “পরিষ্কার পরিছন্ন হবার স্থান” । সেখানে গিয়ে Embalmers বা যারা এই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত তারা নিজেদের হাত সুগন্ধীযুক্ত তালের ওয়াইন এ ডুবিয়ে নেয় এবং তা নীলের পরিষ্কার পানি দ্বারা ধৌত করে নেয় ।

২. একজন Embalmers দেহের বামদিকের অংশ কেটে ফেলে বেশ‌কিছু গুরুত্বপুর্ন অঙ্গ বের করে আনে । এটা খুবই গুরুত্বপুর্ন কাজ । এতে দেহ পঁচে যাওয়া থেকে রক্ষা পায় । কারন এই অঙ্গগুলোই‌ সর্বপ্রথম পঁচা শুরু করে একটি মৃতদেহে। পাকস্থলী, যকৃত, ফুসফুস এবং নাড়ীভুড়ি বের করে একজন এসব ধৌত করে এবং Natron নামক একধরনের প্রাকৃতিক লবন দ্বারা এগুলোকে বেঁধে রেখে শুষ্ক করে ফেলা হয়। কিন্তু তারা হার্ট বা হৃদপিন্ডকে দেহেই রেখে দিতো । কারন তারা বিশ্বাস করতো-এই হৃদপিন্ড হচ্ছে সকল জ্ঞান আর অনুভুতির আধার যা মৃতদেহকে পরবর্তী জীবনের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করাবে।

৩. এক ধরনের লম্বা হুকের মতো চামচ দ্বারা ঘিলু ফাটিয়ে মগজ নাক দিয়ে বের করে নিয়ে আসা হতো।

৪. পুরো দেহ Natron নামক একধরনের লবনে ৪০ দিন অব্দি ডুবিয়ে রাখা হয় যা দেহের আর্দ্রতা শুষে‌ নিয়ে যাবে, সেই সাথে দেহকে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য জীবাণু মেরে ফেলবে এবং এই প্রক্রিয়ার ব্যাবহৃত সব তরল ও নেকড়াও সংরক্ষন করে রাখা হয় যা পরবর্তীতে মৃত দেহের সাথে তার সমাধিস্ত করা হবে ।

মমিকরন
পুরো দেহ Natron নামক একধরনের লবনে ৪০ দিন অব্দি ডুবিয়ে রাখা হয়

৫. ৪০‌দিন পর দেহকে লবনের ভেতর থেকে বের করে ধৌত করা হয় । এবং পুরো দেহে বিশেষ ধরনের তেল মাখিয়ে দেয়া হয় যাতে দেহের মসৃনতা ফিরে পায় এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি পায় ।

মমিকরন
দেহকে লবনের ভেতর থেকে বের করে ধৌত করা হয়

৬. পুরো শুষ্ক দেহের ভেতর এবার আগেই শুকিয়ে রাখা কিছু অঙ্গপ্রতঙ্গ লিনেন কাপড়ে মুড়িয়ে দেহের যে স্থানে ছিলো সেই‌ স্থানে রেখে দেয়া হয় (৪টা বাদে)। তারপর দেহের ভেতর কাঠের গুড়ো, শুকনা পাতা আর লিনেন কাপড় ভরে মৃতদেহের বাস্তবের জীবনের চেহারা ফিরিয়ে দেয়া হয় ।

৭. আরেকবার সুগন্ধী তেল সম্পুর্ন ‌দেহে মাখিয়ে দেয়া হয় । দেহের চাকচিক্য ফিরিয়ে আনা হয় । পুরো অংশের পুরো প্রক্রিয়ায় আনুমানিক সময় ৪৫-৫৫ দিন যায় । এবার দেহ Wrapping বা মুড়িয়ে দেয়ার জন্য সম্পুর্ন রূপে‌ প্রস্তুত কিন্তু সেই অংশে যাবার আগে আরো কিছু ব্যাপার জানিয়ে দেই। মমিফিকেশন প্রক্রিয়ায় সব অঙ্গ Natron এ শুকিয়ে দেহে ফেরত পাঠানো হলেও ৪ টা ভেতরের অঙ্গপ্রতঙ্গ দেহে ফেরত পাঠানো হয় না । এই‌ ৪ টা গুরুত্বপুর্ন অঙ্গ, মিশরীয়দের প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা হোরাসের ৪ ছেলে রক্ষা করে। এই ৪ টা অঙ্গ যে কাঠের বা পাথরের পাত্রে রাখা হয় তাকে বলে “Canopic Jar”; এই‌ জারগুলো মমির সাথেই সমাধিস্ত করা হয়!

মিশরীয়দের প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতা হোরাসের ছেলেদের নাম এবং অঙ্গগুলো দেখে নেয়া যাক-

১. Imsety বা মানুষের মাথারূপী দেবতা “যকৃত” পাহারা দেন এবং রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ।  ২. Hapy বা বেবুনের মাথাওয়ালা দেবতা ফুসফুস পাহারা ও রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন। ৩.Duamutef বা শেয়াল এর মাথাওয়ালা দেবতা পাকস্থলী রক্ষা করেন ।

৪.Qebehsanuef বা বাজপাখির মাথাওয়ালা দেবতা নাড়ীভুড়ি দেখাশোনা করে।

(চলবে……. পরবর্তী পর্বে Wrapping & Burial বা দেহকে দামী কাপড়‌ দিয়ে মুড়িয়ে সমাধিস্ত করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানবো )

লেখকঃ এ এস এম মিজানুর রহমান
মমিফিকেশন বা মমিকরণঃ লাশের মমি করার প্রক্রিয়া (শেষ পর্ব)
[পরবর্তী পর্ব ও আরো দারুণ সব বিষয় জানতে নিউজ ইনসাইড ২৪ এর সাথেই থাকুন]

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে