মাতা হারিঃ এক দুর্ধর্ষ স্পাই, আবেদনময়ী নৃত্যশিল্পী, পতিতা নাকি এক হতভাগ্য নারী, স্ত্রী ও মা?

0

ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে ৪১ বছর বয়সী লাস্যময়ী এক নারী। যে বিগত প্রায় দুই যুগ রূপের মায়ায়, শারীরিক সৌন্দর্যে, যৌন আবেদনময় নৃত্য কলায় মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলো পুরো দুনিয়া। নিয়মমতো  কাপড় দিয়ে চোখ ঢাকতে গেলে নারীটি বাঁধা দিয়ে বললো – “প্রয়োজন নেই”। সে জানে এখনই তার দিকে ছুটে আসবে এক ঝাঁক বুলেট, নিভে যাবে তার সাধের জীবন প্রদীপ যে জীবনকে সুন্দর করতে, আনন্দময় করতে কত চেষ্টাই না করছে কিশোরী বয়স থেকে। জীবনের একেবারে শেষ মুহুর্তে তবুও কোন ভয় নেই চোখে, মজা করে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়ারিং স্কোয়াডের সদস্যদের দিকে ছুড়ে দিলো ফ্লায়িং কিস! কিছুক্ষণ পরেই এক ঝাঁক বুলেট উড়ে এসে ঝাঁঝরা করে দিলো তার শরীর।

না কোন সিনেমার দৃশ্যের বর্ণনা করছি না। এটা ১০০ বছর আগের, ১৯১৭ সালের ১৫ই অক্টোবরের একটি সত্য ঘটনা। গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগ এনে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীকে তথ্য দিয়ে ফ্রান্সের ৫০ হাজার সেনাসদস্যকে হত্যা করতে সহায়তা করার অভিযোগে ফ্রান্স বাহিনী ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে মাতা হারি নামের এই নারীর। কিন্তু কতটুকু সত্য ছিল এই অভিযোগ? আসলেই কি এতবড় দুর্ধর্ষ স্পাই ছিল এই নারী? সে বিচার পাঠক আপনাদের, আমি শুধু সেই নারীর সম্পর্কে ও যেভাবে, যে কারনে অভিযোগ এনে এই দন্ড দেয়া হয় সেটা জানাবো। এরপর আপনারাই সিদ্ধান্ত নিবেন আসলেই এই নারী এক দুর্ধর্ষ স্পাই ছিল নাকি ভাগ্যের পরিহাসে, যুদ্ধের রাজনীতির মারপ্যাঁচে করুন পরিনতি মেনে নিতে হয়েছে!

মাতা হারি, যার আসল নাম মার্গারেটা গের্ট্রুডা জেলে। ১৮৭৬ এর ৭ আগস্ট নেদারল্যান্ডসে জন্ম। ধনী বাবার চার সন্তানের মাঝে বড় ও একমাত্র মেয়ে মার্গারেটা ছোটবেলা থেকেই বিলাসবহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কিছুটা বেপোরোয়াও ছিল সে। হঠাৎ বিপর্যয় নেমে এল পরিবারে। দেউলিয়া হয়ে গেল বাবা। ঋণ শোধ করতে না পারায় সকল সম্পত্তি হারায় সে। অশান্তির মাঝে ডিভোর্স হয়ে যায় বাবা-মা এর। তখন মার্গারেটার বয়স ১৩ বছর। এরমাত্র দুইবছর এর মধ্যে অর্থাৎ মার্গারেটার ১৫ বছর বয়সে মারা যায় মা। মা মারা যাওয়ার দুই বছরের মাঝে ২য় বিয়ে করে বাবা। মার্গারেটা চলে যায় দাদার কাছে, স্নিক শহরে। সেখানে সে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক হওয়ার উদ্দেশ্যে পড়ালেখা ও প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করে। সে লক্ষ্য করলো পুরুষেরা তার শারীরিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হচ্ছে, আশেপাশে অনেকে তাকে কাছে পেতে আকুল। এরমাঝে ছিল তার প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকও! মার্গারেটার প্রশ্রয়ে প্রধান শিক্ষক ফ্লার্ট করতে থাকে তার সাথে। ব্যাপারটা চোখে পড়তে সময় লাগে না আশেপাশের লোকদের, এমনকি দাদারও। ক্ষুব্ধ দাদা মার্গারেটাকে সে প্রতিষ্ঠান এ লেখাপড়া বন্ধ করিয়ে দেয়। মার্গারেটা চলে যায় হেগ নগরীতে থাকা চাচার কাছে। কিন্তু সেখানে বাঁধাধরা গতানুগতিক জীবন যাপনে বিরক্ত হয়ে ওঠে বিলাসবহুল, আনন্দময়, বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত মার্গারেটা।

১৮৯৫ সালে একটি পত্রিকায় ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। পাত্র ডাচ আর্মির একজন ক্যাপ্টেন। যার পোস্টিং ছিল ডাচ নিয়ন্ত্রিত ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে (বর্তমানে যে এলাকার নাম ইন্দোনেশিয়া)। মার্গারেটা দেখেছে তার চেনাজানা যারা ডাচ ইস্ট ইণ্ডিজে ডাচ আর্মির কর্মকর্তা তাদের সবাই সচ্ছ্বল, বিলাসী জীবন যাপন করে।

তাই পাত্রের সাথে ২১ বছরের বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও উচ্চাকাঙ্খী মার্গারেটা আনন্দময় জীবনের আশায় নিজের আকর্ষনীয় ছবি সহ নিজের আগ্রহের কথা জানিয়ে পত্র পাঠায় পাত্রের কাছে। ছবি দেখে পাত্রী পছন্দ হয়ে যায় পাত্রের। কিছুদিনের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ১৯ বছর বয়সী পাত্রী মার্গারেটা জেলে ও ৪০ বছর বয়সী পাত্র ক্যাপ্টেন রুডলফ জন ম্যাকলিওড।

লাস্যময়ী, আবেদনময়ী মাতা হারি

বিয়ের পর মার্গারেটা স্বামীর সাথে চলে যায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিজে। তাদের দুই সন্তান হয়। এর মাঝে পুত্র সন্তানটি মারা যায়। কিন্তু দ্রুতই দাম্পত্য জীবন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় মার্গারেটার। স্বামী সিফিলিস এর মত মারাত্নক যৌনরোগে আক্রান্ত, প্রতিরাতে মদ্যপান করে মাতাল হয়ে আসে, প্রায়ই স্ত্রীকে মারধর করে। আবার একজন বাঁধা রক্ষিতাও আছে। এদিকে মার্গারেটাও একাধিক আর্মি অফিসারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে থাকে। বিয়ের ৯ বছর পর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে যায়। নিজের আয়ের কোন পথ না থাকায় অর্থহীন মার্গারেটা বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তানকে পিতার কাছে রেখে আসতে বাধ্য হলো। সে চলে আসলো প্যারিস। কি করবে, কিভাবে জীবিকা অর্জন করবে এমন চিন্তা থেকে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, তার একমাত্র সম্বল তার শরীর। অতীতে অনেক পুরুষ তার শরীরের সৌন্দর্যে, লাস্যময়ী আচরণে পাগল হয়েছে। তাই এখন সেই শরীরকে ব্যবহার করেই সে জীবিকা আয়ের ফন্দি করে ফেললো। এদিকে ইন্দোনেশিয়ায় (ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ) থাকার সময় কিছুদিন সেখানকার স্থানীয় নাচ শিখেছিল সে। নিজেকে ইন্দোনেশিয়ার নারী হিসেবে পরিচয় দিতে থাকলো সে। নিজের নাম পালটে রাখলো মাতা হারি, ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় যার অর্থ ভোরের চোখ বা ভোরের আলো।

নাচ পারে বলে সার্কাস দলে কাজ জুটিয়ে নিল। সার্কাসের অনুষ্ঠানে নাচতে নাচতে মোহনীয় ভঙ্গিতে একে একে সব কাপড় খুলে ফেলতো সে। এক পর্যায়ে শুধু বক্ষ বন্ধনী থাকতো শরীরের। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত দর্শকরা! দ্রুতই নাচের কাজ পেয়ে গেল বিভিন্ন অভিজাত হোটেলে, ক্লাবে। পাতলা ওড়না শরীরে জড়িয়ে মঞ্চে এসে, নাচতে নাচতে ছুড়ে ফেলে দিত সেটাও। সবকিছু খুলে ফেললেও বক্ষবন্ধনীর ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতো মাতা হারি। মনে করা হয় তার স্তনযুগলের ছোট আকৃতির কারনেই সে সতর্ক থাকতো। কখনোই সেটা উন্মোচন করতো না। নগ্নতাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেলো সে! তার ইরোটিক নাচ দেখতে ভীড় জমাতো পুরুষেরা। ইউরোপ জুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো তার। অর্থের অভাব রইলো না মাতা হারির । শারীরিক আনন্দ দিয়ে তার পরিচয় হল ফ্রান্স, জার্মানি , রাশিয়ার নানা উচ্চপদের সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তার সাথে। এতে যেমন অর্থের অভাব রইলো না তেমনি দুর্নামও ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। বেশ্যা, বেহায়া নানা শব্দে ছিঃ ছিঃ করতে থাকলো লোকে। কিন্তু বেপরোয়া মাতা হারির সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেয়। সে তার মত জীবন যাপন অব্যহত রাখলো।

শরীরকে ব্যবহার করেই উপার্জনের পথ বের করলো মাতাহারি

১৯১৪ সালে মাতা হারি শো করতে গেল জার্মানির বার্লিন শহরে। কিন্তু সে বছর শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানরা তাকে প্যারিস ছেড়ে হল্যান্ডে ফিরে যেতে বললে সে জার্মান বাহিনীর নির্দেশ অমান্য করে প্যারিসেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জার্মানরা মাতা হারির সকল টাকা পয়সা, গহণা সব সিজ করে নিল।

কার্ল ক্রোমার নামে এক জার্মান কর্মকর্তা মাতা হারিকে জার্মানির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাব দিলো, বিনিময়ে ২০ হাজার ফ্রাঁ (মুদ্রা) দেয়া হবে। মাতা হারির হয়ত ধারনা ছিলনা এইসব গুপ্তচর সংস্থা গুলোর নেটওয়ার্ক ও ভয়াবহতা সম্পর্কে। তাই ভাবলো, জার্মান বাহিনী তার জিনিসপত্র নিয়ে নিয়েছে, ২০ হাজার ফ্রাঁ তার প্রাপ্য। এই ২০ হাজার ফ্রাঁ সে নিবে কিন্তু তাদের কোন কাজ করে দিবে না। প্যারিসে গিয়ে সে তার মত থাকবে। একবার প্যারিসে চলে গেলে তো জার্মানরা আর কিছু করতে পারবে না। এসব ভেবে সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। মাতা হারিকে দেয়া হলো কোড নেম, H-21. ২০ হাজার ফ্রাঁ নিয়ে মাতা হারি ফিরে এল প্যারিসে। কিছুদিন পর বেড়াতে গেল ইংল্যান্ডে। মাতা হারির মত এত বিখ্যাত একজনের চলাফেরা নজর এড়ায় না কারো। বার্লিন থেকে প্যারিস, প্যারিস থেকে লণ্ডন এই চরম যুদ্ধ বিগ্রহের মাঝেও মাতাহারির এসব যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ নিয়ে সন্দেহ জন্মায় ইংল্যান্ডের গোয়েন্দাদের। মাতা হারির জন্মভূমি হল্যান্ড ছিল নিরাপদ দেশ, যুদ্ধে কোন পক্ষ না নেয়ায় সেখানকার পরিস্থিতি ছিল শান্ত। অন্যদিকে একদিকে জার্মানরা অন্যদিকে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, রাশিয়া। আর মাতা হারি নিরাপদ হল্যান্ড এ না থেকে জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছে! সন্দেহ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সেই সাথে তথ্যও পেয়ে গেল বার্লিনে জার্মান কর্মকর্তার সাথে দেখা করার। ইংল্যান্ড ফ্রান্সকে জানিয়ে দিল মাতা হারি সম্ভবত জার্মান গুপ্তচর। কিন্তু ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সেখানে তেমন কোন কাজের প্রমাণ পায় না তারা, প্যারিসে ফিরে এলে গোপন নজরদারিতে রাখা হয় মাতা হারি কে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহেও গুপ্তচরবৃত্তির কোন আলামত পায় না ফ্রান্স। প্রমাণ না পাওয়া না গেলেও ব্যাপারটা সন্দেহের কাতারে ঠিকই রইলো, এবং যার পরিনাম পরে একসময় ঠিকই ভোগ করতে হয়।

১৯১৬ সাল, মাতা হারির বয়স যখন ৪০, জীবনে আসলো অনন্য এক ঘটনা! অগণিত পুরুষের আনন্দসঙ্গী প্রথমবারের মত প্রেমে পড়লো এক পুরুষের ! যে প্রেমই যেন কাল হল তার। প্রেমিক তার চেয়ে অর্ধেক বয়সী , ২১ বছর বয়সী রাশিয়ান ক্যাপ্টেন ভ্লাদিমির মাসলভ। দুজন যখন প্রেমে মাতোয়ারা তখনই সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়ার ডাক পড়লো ভ্লাদিমিরের। যুদ্ধে আহত হয় ও এক চোখ হারায় ভ্লাদিমির। আহত ভ্লাদিমিরকে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয় যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই একটি সামরিক হাসপাতালে। প্রেমিককে দেখতে উতলা হয়ে ওঠে মাতা হারি। কিন্তু সেখানে পাস ছাড়া যাওয়ার অনুমতি পেল না সে। অনুমতি পেতে যোগাযোগ করলো  ফ্রান্সের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জর্জ লুডক্সের (ল্যাঁদু) সাথে। লুডক্স জানতো অনেক জার্মান সামরিক কর্মকর্তা  এই লাস্যময়ী নারীর যৌনসঙ্গী। আবার অনেকেই তাকে পেতে চায়। সে চাইলে তাদের কাছে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যোগাড় করতে পারবে। এসব ভেবে প্রস্তাব দেয়া হয়- দেখা করার ব্যবস্থা করা যাবে তবে এক শর্তে, আর শর্ত হল – ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে হবে। প্রেমে মাতাল নারী রাজি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে আর্থিক সুবিধাও আদায় করে নিতে চায়। প্রেমিক আহত, তার পক্ষে উপার্জন করা কঠিন, আবার চিকিৎসারও টাকা দরকার। সেইসাথে প্রেমিককে বিয়ে করে সুন্দর সংসারও শুরু করতে চায়, সেজন্যও বড় অংকের টাকা হলে দারুন হয়। মাতা হারি প্রস্তাব দেয়- সে রাজি তবে বিনিময়ে ১০ লক্ষ ফ্রাঁ দিতে হবে। মাতা হারি হয়ে যায় ফ্রান্সের গুপ্তচর।

‘মিশন’- শুরু হয় তার। এক জার্মান গোয়েন্দাকর্মকর্তার শয্যাসঙ্গীনী হয়ে ফ্রান্সের কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর দেওয়ার ভান করে জার্মান রণকৌশল এর কিছু তথ্য জেনে নেয়। মাতা হারি তথ্যগুলো ফ্রান্সের গোয়েন্দাদের জানিয়ে দাবীকৃত অর্থের অপেক্ষায় রইলো সে। কিন্তু জার্মান কর্মকর্তার সন্দেহ হয় মাতা হারি হয়ত ফ্রান্সের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করছে। ফলে সে একটা কৌশল নেয়। ইতিমধ্যে ফ্রান্স কর্তৃক উদ্ধার করে ফেলা কোড দিয়ে আবারো বার্লিনে একটি রেডিও বার্তা পাঠায় সে, জানায় গুপ্তচর H-21 এর কাছে থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। উদ্ধারকৃত কোড দিয়ে বার্তা পাঠানোর একটা বড় কারণ ছিল— সেই সময় জার্মানির আসল যেসব গুপ্তচর ফ্রান্সে কাজ করছিল, তাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে ফ্রান্সকে বিভ্রান্ত করা। ফ্রান্স যেন মাতা হারিকেই গুপ্তচর ভেবে অন্যদের নিয়ে মাথা না ঘামায়।

পরিকল্পনা মত বার্তাটি ফ্রান্সের হাতে এসে পড়ল এবং আগের উদ্ধারকৃত কোডের বার্তা হওয়ার খুব সহজেই বুঝে গেল। তারা বুঝে গেল  H-21 আসলে আর কেউ নয়, মাতা হারি।

গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের এক হোটেল থেকে মাতা হারিকে গ্রেফতার করা হল। শুরু হল বিচারকাজ। মাতা হারি বারবার বলেছে সে কোন তথ্য দেয় জার্মানদের। ফ্রান্সেও  মাতা হারির বিরুদ্ধে সেই জার্মান গোয়েন্দাকর্তার পাঠানো রেডিয়ো-বার্তা ছাড়া আর কোনও তথ্য-প্রমাণ পায় নি। কিন্তু তখন মাতা হারিকে ছেড়ে দেয়াও সম্ভব ছিলনা তাদের পক্ষে।

যুদ্ধে ফ্রান্সের ৫০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। জার্মান কৌশলের কাছে নাজেহার হয়ে যাচ্ছে ফ্রান্স। এর পিছনে কারন হিসেবে একটা কিছু দেখাতে হবে জনগণকে। নইলে জনগণের কাছে সেনাবাহিনীর ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যাবে, অফিসারদের কৌশলের প্রতি আস্থা হারিয়ে যাবে। তাই মাতা  হারিকেই বলি বানানোর সিদ্ধান্ত হয়। প্রচার করে দেয়া হয় মাতা হারি এতদিন প্যারিসে থেকে ফ্রান্সের সাথে প্রতারণা করেছে। জার্মানদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করে ফ্রান্সের অনেক তথ্য তাদের কাছে পাচার করেছে। মাতাহারির এত টাকা পয়স জার্মানদের পক্ষে কাজ করার বিনিময়ে পাওয়া বলে জানানো হয়।

মাতা হারি বারবার বলছে এসব তার উপার্জন, বিভিন্ন সামরিক কর্মকর্তাদের আনন্দ দিয়ে পাওয়া, হল্যান্ডের এক ধনাঢ্য ব্যারন যে মাতা হারিকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছিল কিছুদিন তার থেকে পাওয়া। আমি পতিতা হতে পারি কিন্তু বিশ্বাসঘাতক নই- দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছে মাতা হারি।  কিন্তু কোন কথাই শোনার প্রয়োজন মনে করে নি আদালত। এমনকি মাতা হারির পক্ষে কোন সাক্ষীকেও হাজির হতে দেয় নি আদালত। জীবনের এই চরম সংকটকালে পাশে পায় নি কোন শুভাকাঙ্খীকে, প্রিয়জনকে। প্রেমিক মাসলভ জানিয়ে দেয় তাদের মাঝে আর কোন সম্পর্ক নেই। কোনকিছুতেই কোন লাভ হচ্ছে না দেখে মাতা হারি একবার জার্মান গোয়েন্দা কর্মকর্তা কার্ল ক্রেমারের কাছ থেকে ২০ হাজার ফ্রা নেয়ার কথা স্বীকার করে ফেলে, এবং জানায় সে টাকাটা নিয়েছিল তার মালপত্র আটক করার ক্ষতিপূরন হিসেবে। কিন্তু টাকার বিনিময়ে সে কোন তথ্যই দেয় নি তাদের। সে ফ্রান্সের প্রতি সৎ ছিল প্রতিক্ষণ। কিন্তু মাতা হারির এই স্বীকারোক্তিকেই কাজে লাগালো আদালত। মাতা হারিকে দুর্ধর্ষ জার্মান স্পাই, প্রতারক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গোপন তথ্য ফাঁস করে ফ্রান্সের ব্যাপক ক্ষতি করার দায়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেয়া হলো।

১৯১৭ সালের ১৫ই অক্টোবর ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে কার্যকর করা হয় মাতা হারির মৃত্যুদণ্ড

রায়ের ১০০ বছর পর ফ্রান্স মামলার নথিপত্র উন্মুক্ত করেছে। সেখানে ছিল মাতা হারির লেখা চিঠিও।  সেসব চিঠি থেকে বুঝা যায় জীবনে যে আনন্দের আশা ছিল তা পায় নি সে। স্বামী সন্তান নিয়ে একটি সুন্দর আনন্দময় জীবন মরীচিকা হয়েই থেকেছে আজীবন। অগণিত পুরুষের আনন্দসঙ্গী হয়ে এক পর্যায়ে ক্লান্ত মাতা হারি ফ্রান্সের দেয়া গুপ্তচরবৃত্তির প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল নিজের প্রেমিককে নিয়ে সংসার জীবন গড়ার স্বপ্নে।

একমাত্র কন্যাকে কাছে পাওয়ার জন্যেও ব্যাকুল হয়েছিল সে। এক সময় উপার্জন না থাকায় আদালতের নির্দেশে সাবেক স্বামীর কাছেই রেখে আসতে হয়েছে মেয়েকে। পরে উপার্জন শুরু করলেও পতিতা হিসেবে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে সেই স্বামী। চরিত্রহীন, বাজে নারীর কাছে মেয়েকে দেয়া যাবে না। মেয়েকে লেখা অজস্র চিঠি সব ফেরত এসেছে, একটাও দেয়া হয়নি মেয়েকে। একবার তো ব্যাকুল মা মেয়েকে স্কুল থেকে অপহরণও করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। মৃত্যুর আগেও প্রেমিক মাসলভ আর মেয়েকে চিঠি লিখেছিল মাতা হারি জেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিল, তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা, এই চিঠি দু’টো তাদের পাঠিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু দেয়া হয়নি।

মাতা হারি কি আসলেই দুর্ধর্ষ স্পাই ছিল? নাকি সুখময়, আনন্দময় এক জীবনের স্বপ্ন দেখা উচ্চাকাঙ্খী এক নারী ছিল যাকে যুদ্ধের রাজনীতির মারপ্যাঁচের বলি হতে হয়? এ নিয়ে নানা বিতর্ক, মতভেদ আর গল্পের শেষ নেই। মাতা হারিকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই, আর্টিকেল আর তৈরী হয়েছে চলচ্চিত্র।

শারীরিক সৌন্দর্য, আবেদনময় নৃত্য, শৈল্পিক যৌনতার খ্যাতি বলুন আর কুখ্যাতিই বলুন এসবের সাথে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ নিয়ে মাতাহারি ইতিহাসে হয়ে আছে এক কিংবদন্তি!

লেখকঃ আসিফ আল রাজীব