হরিণদের ছোটাছুটি, পাখিদের কিচিরমিচির ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা পাহাড়ে ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যোগ হয়েছে আরেক রোমাঞ্চকর খ্যাঁত চালন্দা গিরিপথ। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নেমে আসছে পানি, ওপর রোদ, অনুভূতি এনে দেয়। গিরিপথের ভেতরে প্রবেশ করলে শরীরটা কেমন যেন হিমশীতল হয়ে ওঠে। দুই পাহাড়ে মাঝে হাত ও পায়ের সমন্বয়ে এগিয়ে যেতে হয় সামনে অনেকটা পথ। দুপাশে পাহাড়ের কারুকাজ। এই লোমহর্ষকপূর্ণ গিরিপথের ভেতরে ঢুকলে শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির শব্দ। হ্যাঁ, এমনি দেখার মতো দৃশ্য রয়েছে চট্টগ্রাম নগর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাহাড়-অরণ্যে ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

গিরিপথে প্রায় আধকিলোমিটার ঝুঁকিহীনভাবে যাওয়া সম্ভব হলেও এরপর একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই অনুভব হবে কোনো এক ভুতুড়ে পরিবেশ। দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে আরো ভেতরে যাওয়াটা সাথে ঝুঁকির মাত্রাও । একটু অসতর্কতার কারণে পড়তে হতে পারে বড় রকম কোনো বিপদের। তাই ভ্রমণে সতর্ক থাকতে হয় পিচ্ছিল এই গিরিপথ অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়দের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের পেছনে কলা ঝুপড়ির ছড়ার পানি দিয়ে ৫০মিনিট পশ্চিমে হাটার পর ছড়ার বামে বা দক্ষিনে দেখা মেলে এই অপার বিস্ময় চবির চালন্দা গিরিপথ। এখানে দুটি পথ রয়েছে । একটি মূল চালন্দায় যাওয়ার পথ, অন্যটি সীতাকুণ্ড পর্যন্ত যাওয়া পথ। তাই সঠিক পথের ধারণা না থাকলে ভুল পথে হাঁটতে হাঁটতে সীতাকুণ্ড চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে ।
এ গিরিপথের নামকরণকারী ও সকলের কাছে চালন্দা গিরিপথ কে তুলে ধরা চবির ইতিহাস বিভাগের ২০১০-২০১১ সেশনের ছাত্র মইনুল ইসলাম বলেন, ২০১১সালে আমরা ১১জন বন্ধু মিলে ক্যাম্পাস থেকে পাহাড় দিয়ে হেটে গিয়ে অপর প্রান্তের হাইওয়ে রোডে তথা ভাটিয়ারি যাওয়ার পরিকল্পনা করি। যাওয়ার সময় একজন কৃষক আমাদেরকে পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে যান ছড়া দিয়ে। তখন যাওয়ার পথে একটা ছোট সরু জায়গা দিয়ে ঠান্ডা পানি আসে তখন সেই ঠান্ডা পানিরর খোঁজে আমরা ঝোঁপের ভিতর ঢুকে দেখি ঠান্ডা হিম হিম বাতাস এবং অন্ধকরাচ্ছন্ন এই গিরিপথ। প্রথম একটু ভয় পেলাম। পরে সাহসের সাথে আমরা কিছু দূর যাই। ভিতরে যত যাই ততই মুগ্ধ হই। পরে ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যায়ের “চ” যোগ করি “না” এর পরিবর্তে “চালন্দা” নামকরণ করি।
এই নামটা আসার কারণ হল, আমরা ইতিহাসের ছাত্র, তখন আমাদের পরীক্ষা সময় ছিল। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস পড়ার সময় স্যার বার বার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতেন, যার ফলে আমরাও এটা মুখে মুখে বলতে বলতে “চালন্দা “নামকরণ করি। একদিন ভাবলাম একটা ছবি ফেইসবুকে দিই। একি কান্ড! আপলোডের কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবিটি জনপ্রিয় হয়ে গেলো। সবাই এটি নিয়ে জানতে চাইলে প্রথমে ভাবলাম বলব না, পরে সবার চাপে বলে ফেললাম সেদিন। এর পর থেকে সবার কাছে এক জনপ্রিয় স্থান হয়ে ওঠে চবির এই চালন্দা গিরি। রহস্যপ্রেমী শিক্ষার্থীরা নিয়মিত যাচ্ছেন চালন্দার সৌন্দর্যের রহস্য উদঘাটনে। তাদের কাছে এটি এক অ্যাডভেঞ্চারের নাম।
এ গিরিপথ ভ্রমণে রয়েছে অসংখ্য রোমাঞ্চ, উন্মাদনা, অ্যাডভেঞ্চার। শুধু চবির শিক্ষার্থীদের কাছেই জনপ্রিয় নয় চালন্দা গিরিপথ, এ রহস্য উদঘাটনে দেশের নানান প্রান্ত থেকে নিয়মিত আসছেন অসংখ্য ভ্রমণ পিপাসুরা। প্রতিনিয়ত এ গিরি জয় করছেন শিক্ষার্থী বা ভ্রমণ পিপাসুদের দল কিন্তু বর্তমানে বিপর্যয়ের মুখে চালন্দার পরিবেশ। ভ্রমণকারীদের কেউ না কেউ সেখানে ফেলে আসছেন পানির বোতল, প্যাকেটসহ নানা প্লাস্টিক জাতীয় জিনিসপথ। যার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে চালন্দার আগের রূপ। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে মইনুল বলেন, ভ্রমণকারীদের দ্বারা নিয়মিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে চালন্দা গিরিপথ। সেদিন যদি জানতাম আজকে চালন্দায় গিয়ে সবাই নাম লিখে, প্ল্যাস্টিক ফেলে পরিবেশটাকে নংরা করবে তাহলে এটি নিয়ে কোনোদিন বলতাম না।