লোকসংষ্কৃতির রাজধানী হিসাবে খ্যাত সুনামগঞ্জ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলা বুকে নিয়ে লুকিয়ে ছিল এতো দিন। যোগাযোগ ব্যাবস্থা অত্যন্ত খারাপ থাকার কারণে এই সৌন্দর্য এতোদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল। কিন্তু এখন একটু একটু করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এই এলাকার পর্যটন। আর এই জল- জ্যোৎস্নার সুনামগঞ্জে আপনাকে স্বাগতম জানাই।
সুনামগঞ্জে ঘুরতে আসা বেশীর ভাগ মানুষেরই মূল বিষয়বস্তু থাকে টাংগুয়ার হাওর; এর পাশাপাশি লাউরেরগড়, বারিক্কা টিলা, জাদুকাটা, কোয়রি লেক, লাকমাছড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। যে ছবিটা এখন দেখছেন সেটি সুনামগঞ্জ শহরের প্রবেশদ্বারে বানানো “হাসন রাজার তোরণ”। এখান থেকেই শহরের শুরু। সুনামগঞ্জ শহরকে বলা হয় জ্যোৎস্নার শহর। এইতো কিছু দিন আগেও জ্যোৎস্না রাতে এই শহরের রাস্তার সকল বাতি বন্ধ করে দেওয়া হতো জ্যোৎস্না উপভোগের জন্য। শহরের বাড়ির ছাদে, খোলা মাঠে তখন আড্ডা জমতো নানান বয়সের মানুষের। হাওর পরিবেষ্টিত হওয়ার কারনেও হয়তোবা চাঁদের আলো হাওরের পানিতে রিফ্লেক্ট করতো। তাই আলোর এতো ঝকমক হয়ে থাকা।
কিভাবে আসবেন সুনামগঞ্জঃ বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সুনামগঞ্জ আসুন। ঢাকা থেকে এনা, হানিফ, শ্যামলী, মামুন সহ বিভিন্ন কম্পানির গাড়ি ছাড়ে। নন এসি ২০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। আর এসি ৮৫০ টাকা সর্বোচ্চ। যাত্রাস্থল মহাখালী, ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ। রাতের গাড়িতে উঠা ভাল। তাহলে সকালে পৌছাবেন। সকাল ৬ টায় আপনি সুনামগঞ্জ পৌছে যাবেন। বাস গিয়ে থামবে পুরাতন বাসস্টেন্ডে।
ট্যুর শুরু করতে পারেন যেভাবেঃ অটোরিক্সাতে করে সুরমা ব্রীজে চলে যান মোটর সাইকেল ভাড়া করার জন্য। যাওয়ার আগে ডিসিশন নিন আপনি টাংগুয়ার হাওরে রাতে থাকবেন কি না। যদি থাকেন তাহলে মোটর সাইকেল ড্রাইভারকে বলুন আপনি বারিক্কাটিলা হয়ে লাকমাছড়া যাবেন আবার লাকমাছড়া থেকে শিমুল বাগান হয়ে তাহিরপুর আসবেন, ভাড়া ১০০০টাকার বেশী অবশ্যই নিবে না। আপনি টাংগুয়ার না থাকতে চাইলেও চলে আসতে পারেন। এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ১২০০ টাকা সর্বোচ্চো ভাড়া পড়বে, আবার ১০০০ টাকায়ো রাজি হতে পারে। শুধু বলবেন এই ব্রীজেই এনে নামিয়ে দিতে । প্রতিটি মোটর সাইকেলে ড্রাইভার সহ চার জন বসা যায়, আপনারা আরামে যেতে চাইলে ড্রাইভার সহ তিনজন বসুন। আপনি কথা বলবেন একজন ড্রাইভারের সাথে, যদি বেশী বাইক দরকার হয় উনিই কথা বলবেন আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আপনার ঘুরার যায়গাগুলো হলো যথাক্রমে লাউরেরগড় বালুর চর, জাদুকাটা নদী, বারিক্কাটিলা, কোয়ারি লেক, লাকমাছড়া ঝিরি, আর তাহিরপুর বাজারে ফিরিতি পথে শিমুল বাগান। এই যায়গাগুলো ড্রাইভারদের বুঝিয়ে বলবেন। ড্রাইভারগুলোর ৯০ ভাগই ভাল আপনাকে গল্প করতে করতে নিয়ে যাবে।
আপনি যাত্রাশুরু করার পরে মনোমুগ্ধকর এরকম অনেক দৃশ্য আপনার চোখ জুড়াবে। দৃশ্য উওভোগ করুন। কোথাও ছবি তুলতে হলে ড্রাইভারকে বলুন। ড্রাইভার থামাবে। আপনি প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে প্রথম যেখানে যাবেন সেটা হলো লাউরের গড়।
এবার আপনি লাউরেরগড় পৌছালে আপনি বিশাল বালুর চর দেখতে পাবেন। আপনার থেকে ৫০০ মিটার দূরেই মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় আপনাকে মুগ্ধ করবেই। নৌকাঘাটে এসে ছবি তুলুন। ফেরী নৌকাতে করে আপনি এবার নদী পাড় হবেন, এই নদীর নাম জাদুকাটা যা আপনি দেখতে এসেছেন। এই নদীর সৌন্দর্য এখানে নয়, নদীর ঐপাড়ে থাকা বারিক্কা টিলার উপরে। এখানে গোসলের কোনো দরকার নেই। অনেকে আবেগে নেমে যান সাতারে। অবশ্য নামলে নামতেও পারেন, কিন্তু সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই না। নদী পাড় হয়ে বারিক্কা টিলায় উঠবেন। উঠেই দেখবেন হাতের ডান দিকে একটি মাটির রাস্থা চলে গেছে। আপনি ড্রাইভারকে বলুন ওইদিকে নিতে। বলুন নদী দেখবেন পাহাড় থেকে। কারন বেশীর ভাগ ড্রাইভার ওইদিকে নিয়ে যাবে না। এইখানে ছবি তুলে আপনি চলতে থাকবেন কোয়ারি লেকের উদ্দেশ্যে।
কোয়ারি লেকে যাওয়ার পথে আপনি আবার চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখতে থাকুন। একটু সামনে এগুলেই দেখবেন বিশাল আকারের কয়লার স্থুপ। এখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন যায়গায় কয়লা সরবরাহ করা হয়। ইচ্ছে করলে এখানে ছবি তুলে নিতে পারেন। এখান থেকে একটু এগুলেই নীলাদ্রী লেক। লেকে এসে আপনি গোসল করতে পারেন প্রান ভরে। কিন্তু সাতার না জানলে নামবেন না ভুলেও। প্রচুর গভির এই লেক। এখান থেকে আপনি যাবেন এবার লাকমাছড়া ঝিরির উদ্দেশ্যে।
লাকমাছড়া ঝিরি যেতে বেশী সময় লাগবে না। আপনি লাকমাছড়া গিয়ে সাবধানে থাকবেন। এখানে বর্ডারে কোনো তারকাটা নেই। বর্ডারের এখন যা অবস্থা তাতে বেশী দূর না যাওয়াই ভাল। এখানে পাথরের উপর বসে থাকা অবস্থায় যাকে দেখছেন সেটা আমি। কোনো এক বিকেলে লুঙ্গি পড়েই চলে গেসিলাম। এখান থেকে আপনি এইবার পেছন ফেরার পালা। যদি থাকতে চান তাইলে থাকলেন আর না থাকতে চাইলে সুনামগঞ্জ বেক করে ফেলুন।
আপনি টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকুন আর না থাকুন আপনার যাত্রা এবার শিমুল বাগানের দিকে। শিমুল ফুল ফোটার সময় বসন্ত কাল। বসন্ত ছাড়া শিমুল বাগান তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে যায়গাটা খারাপ না। এতক্ষনে হয়তো আপনার ক্ষুধা লেগে গেছে কারন আপনি নাশতার পরে কিছুই খাননি। আমিও লিখায় খাওয়ার বিরতি দেই নি কারন খাওয়া দাওয়া করার মতো কোনো দোকানই তো নাই। তাই প্রথমে বলেছিলাম ভালভাবে নাশতা করুন। তবে সামনে বাধাঘাট বাজার আছে। কিছু পেলে পেতেও পারেন। আপনি এবার চলে যাচ্ছেন তাহিরপুর এর উদ্দেশ্যে। আপনি তাহিরপুর থেকে টাংগুয়ার হাওর যাবেন।
তাহিরপুর এসে আপনি নৌকা ঘাটে যান। নৌকা ঘাট থেকে আপনি একটি নৌকার সাথে কথা বলুন। উনাকে যানান যে আপনি রাতে থাকবেন। ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা নিবে যদি রাতে থাকেন। আর না থাকলে ১০০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যাবে। এখান থেকে আপনি আপনার মোটরসাইকেলকে বিদায় করে দিন। আর যদি সুনামগঞ্জ চলে যেতে চান উনার ফোন নাম্বার রেখে বলবেন ওয়েট করার জন্য। এখান থেকে টাংগুয়ার হাওর যেতে সময় লাগবে ১ ঘণ্টা।
০১৭১৩৩৭৪৪২১ এই নাম্বারটি হচ্ছে তাহিরপুর থানার ওসির নাম্বার। আপনি যদি কোন বিপদে পড়েন তাইলে ফোন দিবেন। আপনি রাতে থাকতে চাইলে বর্ষাকালের যেকোনো একটি ভরা পূর্নিমায় আসুন। সাথে পর্যাপ্ত খাবার এবং পানি নিয়ে নিন। টাঙ্গুয়ার হাওরে কিন্তু কিচ্ছু পাবেন না খাওয়ার। আপনি পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠুন। অতঃপর আস্তে আস্তে তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা করুন। বাইকপ্রতি জোড়া ২০০ টাকা করে সর্বোচ্চ রাখবে।
আমার লিখালিখির কোনো অভ্যাস নাই, এই লিখাটি সুনামগঞ্জকে ভালবেসেই লিখা। লিখাটি পড়ে যদি দুই একজন পর্যটক আসেন এতেই সার্থকতা। অনেক কিছু আজান্তেই বাদ পড়ে যেতে পারে। এই ডক এর পরে যদি আরও কিছু জানার থাকে, আমার ফেসবুক আইডিতে মেসেজ দিয়ে দিবেন। তবে মেসেজ পাঠানোর সময় বিস্তারিত কিছু বইলেন যাতে বোঝতে পারি। কিন্তু অঝতা মেসেজ দিবেন না, এটি বিরক্তিকর।
এই ভ্রমনে দরকারী কিছু টিপসঃ
১। প্রত্যেকটা যায়গায় আপনি সময় বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
২। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করবেন কোথায় কতক্ষন লাগবে।
৩। পর্যাপ্ত পানি সঙ্গে রাখুন।
৪। প্রত্যেক যায়গায় দামদর করুন।
৫। এই দেশ আপনার সম্পদ, ময়লা অবর্জনা হাওরে অথবা নদীতে ফেলবেন না।
৬। সাতার না জানলে পানিতে আপনার সাকিব খান অথবা শাবনূর হওয়ার কোনো দরকার নাই।
৭। মোবাইলের ব্যাটারী ব্যাকাপ ব্যাবস্থা সঙ্গে রাখুন।
সবাইকে আমার সুনামগঞ্জে আসার দাওয়াৎ রইলো।
ধন্যবাদ।
লেখকঃ Istiak Alam Pial