রাত আনুমানিক নয়টা। হিমু আর বাদল মহাখালী ফ্লাইওভারের ঠিক নিচে দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। বাদল একটু পর পরই নড়াচড়া করছে আর ‘উহ…. উরিহ…! আস্তে….. কামড়া রে……!’ এই টাইপের আওয়াজ করছে। বাদল আর হিমু দুজনের শরীরের যত্রতত্র মশা খুব আরাম করেই কামড়াচ্ছে! হিমু নির্বিকার ভাবেই বসে আছে, একটুও নড়ছে না। মশাদেরকে তিন ঘন্টা যাবৎ আরাম করে রক্ত পান করতে দিতে হবে, নড়াচড়া করা যাবেনা, কথাও বলা যাবে না, ধ্যানে থাকতে হবে….. আত্মশুদ্ধির উপায় নিয়ে মনের দ্বিতীয় সত্ত্বার সাথে পর্যালোচনা করতে হবে! এরমধ্যেই মশারা কামড়ে শরীরের সব বিষাক্ত রক্ত শুষে খেয়ে নেবে। মানব রক্ত পরিশুদ্ধ করার এটা একটা প্রাকৃতিক পদ্ধতি।
হিমুকে যারা মহামানব মনে করে… বাদল তাদের মধ্যে অন্যতম। হিমু প্রতি সপ্তাহের রোজ বৃহস্পতিবার মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে এই দশফুট চওড়া ড্রেনের পাড়ে বসে রক্ত পরিশুদ্ধ করার এই প্রাকৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে! এখানকার মশাগুলোর স্বাস্হ্য খুবই ভালো, হুল ফোঁটানো মাত্রই কারেন্টের মতো শক লাগে। বাদল আজই প্রথম এসেছে। হিমু নিষেধ করেছিলো….. শুনেনি। বাদল একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আর বাইং মাছের মতো মোড়াচ্ছে…! আরো প্রায় দুই ঘন্টা বাকী!
হঠাৎ হৈ চৈ এর শব্দে হিমুর ধ্যান ভেঙে গেলো! আনুমানিক ছয় ফুট লম্বা এক ব্যক্তিকে পাবলিক ফ্রীতে ভিটামিন দিচ্ছে, বুস্টার ডোজ! দেড় বছর বয়েসী ছোট্ট একটা মেয়েকে তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে! মেয়েটাকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে রেখেছিলো ঐ ব্যক্তি! বাবা মায়ের সামনেই তাদের ছোট্ট মেয়েটাকে জোর পূর্বক বুকে চেপে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলো ঐ ব্যাটা!
পাবালিক ভালই মেরেছে……, ব্যাটা মার খেয়ে রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে! নাকমুখ ফেটে গেছে।
হিমু ধ্যান ভেঙে উঠে দাঁড়ালো! বাদলের চোখ চকচক করে উঠলো….. আপাতত আজ আর মশার কামড় খেতে হবে না! বাদল তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো ডজন খানেক মশা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে গায়ের সাথেই লেগে আছে।
বাদল পা চুলকাতে চুলকাতে বললো – ‘হিমু দা! এত্তো বড় বড় মশা আমি জীবণে প্রথম দেখলাম। শরীরে তো মনে হয় আর রক্তই নেই আমার। জোঁক ও মনে হয় এতো রক্ত খেতে পারেনা…..একবারে! ইস সি রে! এক একটার পেট ফুলে হাতির পেট হয়ে গেছে…! পায়ের সাথে লেপ্টে আছে টাইগার মশা গুলো! থাবড়া মেরে সবকয়টার পেট ফাটিয়ে দেই হিমু দা!’
–‘ এদের থাবড়া মারা যাবে না বাদল! এরা দূষিত রক্ত শুষে এম্নিতেই পড়ে যায় শরীর থেকে …!’
হিমুর কথা বাদলের মন:পুত হলো না…..! তবুও দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো-
‘নে বাবারা…! তাহলে আরাম করে রক্ত খা…! সব দূষিত রক্ত চুক চুক করে চুষে খেতে থাক।’
হিমু চিন্তিত মনে আহত লোকটার কাছে গেলো….. ! চেহারা দেখে শিক্ষিতই মনে হয়…., চুপ করে রাস্তার কোণায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে! কারো কোনো প্রশ্নের ই উত্তর দিচ্ছে না! বিড়বিড় করে শুধু – ‘মুনিয়া ….! মুনিয়া’ বলছে।
হিমু খুব কাছে গিয়ে লোকটার চোখের দিকে তাকালো! ভয়ার্ত চোখ…..!
ডজন খানেক মানুষ এখনো ভদ্রলোক কে ঘিরে ধরে আছেন। এদের একজনের হাতে একটা কাঠের তক্তা। তক্তাওয়ালা লোকটা চিৎকার করে বললো
—‘ হালার পো….! মাইনষের বাচ্চা চুরি কইরা লইয়া যাইবার চাস? কিডনি কাইটা বেইচা দেস! পিডাইয়া তোরে মাইরাই ফালামু।’
হিমু এগিয়ে গিয়ে সবার উদ্যেশ্যে বললো – ‘উনি আমার পরিচিত! ওনাকে আর মারবেন না…..। উনি ছেলেধরা নন। ওনার মাথায় সমস্যা আছে। প্রায়ই বাসা থেকে বেরিয়ে যান……! আর ঐ মেয়েটার মতোই তার ও একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। ‘মুনিয়া’ নাম মেয়েটার।’
পাবলিক সবাই একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। হিমুর কথা তাদের বিশ্বাস যোগ্য মনে হয়েছে।
লোকজন সরে যাবার পর হিমু ভদ্রলোক কে প্রশ্ন করলো –
‘নাম কি আপনার ভাই?’
-‘শের শাহ শূরী, শের খাঁ। গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড, এই মহাখালী ফ্লাইওভার…… সবই আমার বানানো। আমার ঘোড়াটা কই ভাই? আর মুনিয়া কোথায়?’
বাদলের চোখ চকচক করে উঠলো …..!
–‘বাহ! এই যুগের শের খাঁ…. হিমু দা!’
হিমু কিছুই বললো না….. দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হিমু একটা সমীকরণ মিলিয়ে ফেলেছে। ভদ্রলোকের জন্য হিমুর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
—————
বাদলের রুমের একেবারে কোণায় শের খাঁ চুপ করে এখন গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
শের খাঁর সামনে একটা কাগজ ……. একটু আগেই শের খাঁ মুখে ঘোড়ার আওয়াজ করছিলো – ‘চিঁ হিঁ হিঁ হিঁ’ টাইপের আওয়াজ! আর নিজে নিজে দুলছিলো। ভাবখানা এমন যে…….. ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করছে!
বাদলের বাবাকে দেখেই শের খাঁ ভয়ে একেবারে চুপ।
বাদলের বাবার হাতে বন্দুক…… তবে গুলি নেই। তিনি দশ পেগ ভদকা খেয়ে পাগলের মতো দুলে দুলে চিল্লাচ্ছেন!
‘বাদল! বকের মতো লম্বা, ছাগলা দাঁড়িওয়ালা এই নতুন রামছাগল টাকে কোত্থেকে ধরে এনেছে হিমু হারামী? এই বদমাশটা মুখে এমন শব্দ করে কেন্? গুলিস্তানে ঘোড়া চালাতো নাকি রে?
আর আমার বন্দুকের গুলি কই লুকিয়ে রেখেছিস বাদল? দে….. দে…….! বাবা, তাড়াতাড়ি দে! এই ঘোড়াওয়ালা আর হিমু, দুই বদমাশের বুকে ধাঁই ধাঁই করে গুলি মেরে দুটো বড় বড় ছিদ্র করে দেই।
হিমু হারামজাদা এই রামছাগলটাকে আমার বাসায় রেখে কৈ পালাইছে?’
– ‘হিমু দা শের খাঁর ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য পত্রিকা অফিসে গেছে বাবা।’
-‘ বাহ! এই রামছাগলের নাম বুঝি শের খাঁ! তা ওরে একটা তলোয়ার কিনে দে! এক কোপে হিমু হারামজাদাটার গলা কেটে ফেলুক।
আমার বাসাটারে পাগলা গারদ বানাইয়া ফালাইছস তোরা।
দাঁড়া………!’
বাদলের বাবা পুরো মাতাল…….., পাগলামী শুরু করেছেন। একটু পর বাদলের দিকে তাকিয়ে বললেন –
‘শের খাঁ নামক রামছাগলটার পাছায় দুটো লাথি মেরে কালকেই আমার বাসা থেকে বের করবি হারামজাদা!’
——————
রাত আট টা পঁয়ত্রিশ…..
বাদল বহুদিন পর অংক করতে বসেছে। পীথাগোরাসের সমীকরণ দিয়ে অংক মিলাতে পারছে না!
পীথাগোরাস নামক অদ্ভুত মানুষটাকে এখন বাবার বন্দুক দিয়েই গুলি করতে ইচ্ছে করছে বাদলের। শের খাঁ যথারীতি আগের মতো করেই ঘোড়ার ডাক দিচ্ছে। একটু পরপর জিজ্ঞেস করছে –
‘আমার মুনিয়া কই?’
বাদল চিন্তিত স্বরে বললো
– ‘মুনিয়া কে? আপনার নাম কি? বাড়ি কই আপনার শের খাঁ ভাই?’
– ‘আমার নাম শের খাঁ। আমি মালয়েশিয়া থেকে আসছি। চিঁ হিঁ হিঁ হি………, টগবগ টগবগ।’আবারও ঘোড়ার আওয়াজ আর একই টাইপের ভঙ্গিতে ঘোড়া চালাচ্ছে শের খাঁ।
——————-
হিমু দুইদিন পর ফিরলো বাদলের বাসায়।
হিমুর কথা শুনে বাদলের চোখ ছানাবড়া।
– ‘বল কি হিমু দা!!!! শের খাঁর নাম ওয়াহিদ। মালয়েশিয়ায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন শের খাঁ?’
– ‘হু ……. শের খাঁর কোয়ান্টাম মেকানিক্সে পিএইচ ডি। রংপুরের UNDP র পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ একটা ফ্লাইওভার প্রোজেক্ট এর কো অর্ডিনেটর ছিলো ও। দুইদিন আগে নিজে ড্রাইভ করে রংপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে ওর গাড়ি ছিনতাই হয়েছে! ছিনতাইকারীরা সম্ভবত ধাতুরা খাইয়ে ওকে পাগল করে দিয়েছে।
ওর একটা ছোট্ট মেয়ে আছে রে বাদল…….. মুনিয়া নাম। আমরা কালকে ওয়াহিদকে রংপুর পৌঁছে দেবো! থানায় জানিয়েছি…….. পুলিশ হেল্প করবে বলেছে।’
——————-
পরদিন…….
ওয়াহিদ তার ছোট্ট মেয়ে মুনিয়াকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। পাশে ওয়াহিদের স্ত্রী শেহরিন দাঁড়িয়ে।
আঁতেল টাইপের এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখছেন ওয়াহিদকে। ভদ্রলোক মাইনাস পাওয়ারের চশমা পড়া একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। চশমার পাওয়ার মাইনাস 6 এর উপর………., মনে হচ্ছে সেভেন আপের বোতলের দুইটা তলা এই ডাক্তারের দুই চোখে লাগানো। ডাক্তারও পাগল কিছিমের, একটু পর পর বাম আর
ডান হাত একবার ক্লক ওয়াইজ আবার এন্টিক্লকওয়াইজ ঘুরায়।
– ‘সুস্হ্য হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে ওয়াহিদ সাহেবের। তবে শের খাঁর রহস্যটা ধরতে পারছি না।’
– ‘আমি পেরেছি! ‘ হিমু খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো।
বাদলের চোখ চকচক করে উঠেছে………., মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হা করে হিমুর দিকে তাকিয়ে আছেন। চশমার ফাঁক দিয়ে বিশেষজ্ঞ সাহেবের চোখ দুটোকে রুপচাঁদা মাছের মতো চ্যাপ্টা দেখাচ্ছে।
—————–
(একবছর পর……..)
ওয়াহিদ এখন পুরোপুরি সুস্হ্য l বহু কষ্টে হিমুকে খুঁজে বের করেছে সে। ফার্মগেটের
ফুটপাতে হিমু আর ওয়াহিদের কথোপকথন –
‘আপনাকে ধন্যবাদ…….. আমার জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য।’
– ‘ধন্যবাদ শের খাঁর প্রাপ্য। উনিই আপনাকে হাইওয়ের রাস্তা থেকে রাত তিনটায় তুলে নিয়ে মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে নিরাপদে রেখেছিলো।’
– ‘কি বলছেন এসব? শের খাঁ কে? ওঁনাকে কোথায় পাবো? ‘
হিমু চুপচাপ বিড়বিড়িয়ে বললো –
‘শের খাঁ সুফী মানুষ। মহাখালী ফ্লাই ওভারের ড্রেনের পাশে তিনবছরে একবার বসে নিজের দূষিত রক্ত মশাদের খাওয়ান। ওঁনার শরীরে তিন বছর পরপর রক্ত সামান্য দূষিত হয়!’
ওয়াহিদ হা করে তাকিয়ে আছে হিমুর দিকে l বিড়বিড়িয়ে বললো –
‘আর আপনার রক্ত? ‘
– ‘আমাকে প্রতি সপ্তাহেই মহাখালী ফ্লাইওভারের ড্রেনের পাশে বসতে হয়।’
————————-
( তিন বছর পর ……..)
হিমু আর ওয়াহিদ পাশাপাশি মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে ড্রেনের পাশে বসে আছে। বাদলের ম্যালেরিয়া হয়েছে……. ও আসতে পারেনি।
আজ ভরা পূর্ণিমা……… হিমু হিসেব করে দেখেছে শের খাঁ নামক সুফী সাধকের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা আজ প্রবল!
রাত তিনটা
সোডিয়ামের আলোয় দেখা যাচ্ছে – দূরে এক ব্যক্তি চিঁ হিঁ হিঁ হি ডাক দিয়ে দিয়ে ড্রেণের দিকে এগিয়ে আসছেন!
হিমু খুবই নার্ভাস…………ওয়াহিদের মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
প্রকৃত মহামানবদের সামনে হিমুরাও নার্ভাস হয়ে যায়।।
– Asif Soikot(আসিফ শুভ্র)
(উৎসর্গ : হিমু চরিত্রের প্রয়াত স্রষ্টা কে)