মানিক বন্দোপাধ্যায়

0
মানিক বন্দোপাধ্যায়

কুচকুচে কালো এক ছেলে। বামুনের ছেলে হওয়াতে ডেকে আনলো গণক। তৈরি করলেন ঠিকুজি-কুষ্ঠী। নাম দেওয়া হলো অধরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু সেই নাম আঁতুড়ঘরেই সমাধিস্থ। বাবা হরিহর সাধ করে নাম দেন প্রবোধকুমার। সেটিও টেকেনি। কালোপানা ছেলেকে সবাই কালোমানিক বলে ডাকতে লাগলো। বয়স বাড়লে কালো কেটে কেবল মানিক থেকে যায়।

কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতশাস্ত্রে স্নাতক শুরু করলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা হচ্ছিলো বন্ধুদের সঙ্গে। মানিক ভিন্নমত দিল! বলল, ‘আলবাৎ ছাপাবে। লেখা ভালো হলেই ছাপাবে।’ বাজি ধরে জানায় বন্ধুদের, ‘তিনমাসের মধ্যে আমার লেখা কোনো নামী পত্রিকায় ছাপবে, মিলিয়ে নিয়ো।’

তিনমাস লাগেনি। তিনদিনেই গল্প লেখা শেষ! তিনদিনের মাথায় গল্প নিয়ে হাজির ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার অফিসে। এমনভাবে লেখা দিয়ে এলেন, যেন ছাপতে হবে তখনি! ছাপা হলো। সম্পাদক নিজে খুঁজে বের করলেন মানিককে। বিশ টাকা সম্মানিসমেত আরও লেখা পাঠাবার দাবি জানিয়ে এলেন। কেননা, পাঠকমহলে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দেয় মানিকের গল্প ‘অতসী মামী!’

মানিক বন্দোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে ছিলেন। চার বছর বয়সে বাড়ির পাশের খালে কাল কাঁকড়া ধরতে গিয়ে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন চোরাবালিতে! কে যেনো বাঁচালো! তবে আশ্চর্যের কথা, বড়ো হতে হতে স্মৃতিটুকু অস্পষ্ট হতে থাকে। অনেক বছর নিজেই বের হন যাছাই করতে। আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বাঁচালেন কেউ একজন! কথায় কথায় মানিক জানতে পারলেন অনেক বছর আগে আর এবার, একই ব্যক্তি তাঁকে বাঁচিয়ে তোলেন। একবার খেলতে গিয়ে বটি দা দিয়ে নিজের পেট প্রায় দুইভাগ করে ফেলেন মানিক। ডাক্তার সেলাই দিয়ে সেই যাত্রায় বাঁচান। ক্লাস সেভেনে থাকতে কালীপূজোর আগে দুই ভাইকে নিয়ে পটকা বানাতে বসে পড়েন। আনাড়িপনার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটিয়ে কাচের শিশি ফেটে তিন ভাইয়ের সারা শরীর এফোড় ওফোড় করে দেয়!

বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনের সঙ্গে নদী আর মাঝি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। কতগুলো রাত যে বাড়ি থেকে পালিয়ে মাঝনদীতে মাঝিদের সাথে গল্প করে কাটান, হিসেব নেই। কাছ থেকে দেখেছেন তাদের। জীবনকে উপলব্ধি করেছেন। বাঁশি ছিল তার সবসময়ের সঙ্গী। যা দেখতেন, ধারণ করতেন নিজের মাঝে। ১৯৩৩ সালে কলকাতায় আসে বিখ্যাত এক পুতুল নাচের দল। সেই উৎসবে নাচ দেখে এত মুগ্ধ হলেন, সেই পুতুলদের সাথে মানুষের জীবনকে মিলিয়ে লিখে ফেললেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা।’

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনের ইতিকথা হৃদয়বিদারক। কলেজে ভর্তি হবার পর খরচ চালাতেন বড়ো দাদা। ভাই রাজনীতি আর সাহিত্যে বুঁদ হয়ে পড়াশোনার বারোটা বাজাচ্ছে জানার পর খরচ পাঠানো বন্ধ করে দেন। মানিক জবাব দিলেন- ‘দেখে নেবেন, একদিন এই সাহিত্যের জোরেই আমার নাম রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে উচ্চারিত হবে।’ মাত্র আটচল্লিশ বছরের জীবনে বাংলা সাহিত্যকে মানিক বন্দোপাধ্যায় দু’হাত ভরে দিলেও বিনিময়ে পেয়েছেন অর্থকষ্ট, দৈন্যতা। যে মানিক একদিন সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি শুধু সাহিত্যিকই হবেন, সেই তিনিই অস্ফুটে বলেন, ‘দুটো ডালভাতের বন্দোবস্ত না করে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়!’

জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যখন হার মানেন মানিক বন্দোপাধ্যায়, স্বভাবতই ঢল নামে মানুষের। শেষ দিকের সঙ্গী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার স্মৃতিকথায় লিখেন- ‘পালঙ্ক ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হলো, তখন এক চোখ খোলা, আরেকটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপর ফুল। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীর ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে। অথচ কাল কেউ ছিল না!’ মানিক বন্দোপাধ্যায় সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন। ভালোবাসার জন্য নিজেকেই বিলিয়ে দিয়েছেন পদ্মানদীর অতল স্রোতে। রেখে গেছেন সৃষ্টিশীল আর শিক্ষনীয় এক জীবন উপাখ্যান।