অদৃশ্য আশ্রয়

0
অদৃশ্য আশ্রয়

#অদৃশ্য আশ্রয়#
“অাশরাফ শাকিল” নামের একটি আই ডি থেকে বেশ কিছুদিন থেকেই নিয়মিত মেসেজ আসছে। মালিহা কোন রিপ্লাই দেয় না। রিপ্লে দিলেই এরা পেয়ে বসে। খাতির জমাতে চেষ্টা করে। একটু ফ্রী হলেই পিক চায়।
অনেক রাত পর্যন্ত অনলাইনে থাকা মালিহার অভ্যাস। বিয়ের পর থেকেই পাভেল চাকুরীর প্রয়োজনে বাইরে থাকে। ওর সাথে গভীর রাত পর্যন্ত মেসেঞ্জারে সময় কাটাতে কাটাতে এই অভ্যাস গড়ে উঠেছে। পাভেল এখন অনেক বদলে গেছে। কিন্তু মালিহার বদ অভ্যাসটা বদলায় নি। ইদানিং মালিহাকে অনলাইনে দেখলেই পাভেল রেগে যায়। মালিহা “নীলাম্বরী নিশিতা” নামে নতুন আইডি খুলেছে। ভার্চুয়াল জগতটাই এখন তার নিঃসঙ্গতার সঙ্গি।
‘আশরাফ শাকিল’ আইডি থেকে আজ আবারও মেসেজ এলো-
– Hlw…একটু বেশি ভাব নিচ্ছেন আপনি। আমার টেক্সটগুলো কিন্তু মোটেও ডিস্টার্বিং কিছু নয়।
– হুম। তো?
– ভদ্রতা করেও তো জবাব দেতে পারেন।
– দেখুন,আমি অপরিচিত কারো সাথে চ্যাটিং করি না।
-আপনার পরিচিতজনরাও কিন্তু একসময় আপনার অপরিচিত ছিল। রাইট?
লোকটির কথায় যুক্তি আছে।পাভেলও বেশ যুক্তি দিয়ে কথা বলতো। কথায় কথায় যুক্তির জালে তাকে বোকা বানিয়ে মজা নিত। মালিহা কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়। কোথায় যেনো শুনেছিল- যুক্তি দিয়ে যারা কথা বলে, তারা নিষ্ঠুর হবার যথেষ্ট ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কথাটি সত্যি, নইলে বিয়ের পরপরই কেন পাভেল এতোটা বদলে গেল। মালিহার বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে আসে।
ও প্রান্ত থেকে অাশরাফ শাকিলের টেক্সট আসে আবার ও-
– নিজেকে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন কেন?
মালিহা বিরক্তবোধ করে।
– আপনিই বা আমাকে এতোটা গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন ভাই? নিজের কাজ করুন। আমি বিরক্ত হচ্ছি।
– আপনাকে গুরুত্ব দিচ্ছি বলে ভাববেন না আমি গুরুত্বহীন কেউ।
– আচ্ছা আচ্ছা, আপনি অনেক Important মানুষ, হলো? বাই।
– শুনুন মিসেস অহমিকা, আপনি কাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তার চাইতে আপনাকে কে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটাই বোধ হয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আপনার শুভাকাঙ্খি কেউ তো হতে পারি। আপনার মতো অহংকারি মেয়েরা বোকাই হয়। ভালো থাকুন। never again..sorry. Bye…
মালিহা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
অনলাইনের বিভিন্ন লিংক ঘুরে ঘুরে রাত গভীর হয়। কিন্তু মালিহার ঘুম আসছে না মোটেও।
মালিহা পাভেলকে ফোন দেয়। ‘বিজি আছি, এখন কথা বলতে পারব না’- বলে পাভেল ফোন কেটে দেয়। কাউকে এভোয়েট করার সবচাইতে আপডেট পদ্ধতি হলো- “ব্যস্ত আছি।” মালিহা সেটা বোঝে। কিন্তু সে ভাবতে পারে না- বিয়ের আগে এই মানুষটাই তার সাথে একদিন কথা বলে থাকতো পারতো না। একদিন দেখা না হলেই এই মানুষটিই পাগলের মতো আচরন করতো। কি করে মানুষ এতোটা বদলে যায়? মালিহার চোখ ভিজে ওঠে।
মেসেঞ্জারের নটিফিকেশনে টুং করে একটা আওয়াজ হয়।
“অাশরাফ শাকিল” আইডি থেকে আজ আবারও মেসেজ এলো।
– আপনার হাজবেন্ডের গোপন একটা বিষয়ে কিছু বলার জন্যই এতোদিন ধরে আপনাকে নক করেছি। মিসেস অহমিকা। প্রয়োজনটা আমার চাইতে আপনারই বেশি ছিল। কিন্তু আপনি আমাকে বরাবরই এড়িয়ে গেছেন।
লোকটা কি বলতে চাইছে? পাভেল কি তাহলে অন্য কোন মেয়ের সাথে সাথে জড়িয়ে পরেছে!
নতুন কোন ভালোবসার সৃষ্টি না হলে পুরোনো ভালোবাসা কখনোই মরে না। তার প্রতি পাভেলের ভালোবাসা কি সত্যি মরে গেছে?
মালিহা রিপ্লে দেয়-
– কি বলতে চাচ্ছেন আপনি? ক্লিয়ার করুন প্লিজ..
– মিসেস অহমিকা,আপনার হাসবেন্ডকে সামলান। Tke care…..
– what??
এর পর আর কোন রিপ্লে আসে না। মালিহা বার বার নক করতে থাকে কিন্তু শাকিল নিরুত্তর। মালিহা বেশ অসহায় বোধ করে।
এর পর প্রতিদিন মালিহা শাকিলকে নক করতে থাকে। কিন্তু কোন জবাব আসে না। এক রাশ কৌতুহল নিয়ে মালিহা আজও তাকে টেক্সট করে।
– Hi….কিছুতো বলুন।
কিন্তু শাকিল বরাবরের মতো নিরুত্তর। মালিহার মেজাজ খারাপ হয়।
– আপনি কেমন মানুষ বলুন তো? মানুষকে টেনশনে রাখতে খুব ভালো লাগে আপনার,তাই না?রিপ্লে দেন না কেন?
– আপনি প্রয়োজন মনে করেন না তাই।
– আপনার পরিচয়টা আমার জানা দরকার। প্লিজ…
– আমাকে আপনি চিনবেন না।
– ও… তা আপনি আমার হাজবেন্ড সম্পর্কে কি যেনো বলতে চেয়েছিলেন?
– হা হা হা….
– হাসছেন কেন?
– মিসেস অহমিকা,আপনি একটা বোকা মেয়ে।
– দেখুন মি: শাকিল, আমার একটা নাম আছে। আর আমি মোটেও বোকা নই
– নামটা বলবেন,প্লিজ?
: আমার আইডিতে আমার নামটা দেখুন।
– ” নীলাম্বরী নিশিতা” আপনার নামটা কিন্তু সুন্দর।
– Thnx
– মি: শাকিল, এবার দয়া করে বলবেন কি আপনি আসলে কি বলতে চেয়েছিলেন?
– মিসেস নিশিতা। আমি জাস্ট আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম।
– মানে?
– আপনি যখন দিনের পর দিন আমার মেসেজের রিপ্লে দিচ্ছিলেন না তখন আমার ভীষণ খারাপ লাগতো। আমার প্রতি আপনার কৌতুহল তৈরী করতেই আপনার হাজবেন্ডের কথাটা বলেছি। আপনি যখন কৌতুহলি হয়ে আমাকে বার বার টেক্সট করেছেন আমি রিপ্লে দেই নি। রিপ্লে না দিলে কেমন লাগে সেটা বোঝাতেই এটা করেছি।
– অাপনি একটা ফাজিল।
– ফাজিল মানে তো জ্ঞানী
– তাই?
– হুম, এটা ফাজিল মাদ্রাসার স্নাতক ডিগ্রি।
– বুঝলাম। তো মি. ফাজিল আপনি কি আমাকে চেনেন?
– হুম।
– কিভাবে?
শাকিল এবার কবিতা আওড়ায়-
– এক পলকেই, অনেক চেনা,
লাগে এমন কিছু মুখ,
বুকের মাঝে যতন করে
রাখা যেনো যুগযুগ।
– বাহ! দারুণ তো। আপনি কবি নাকি?
– ‘তোমার বিরস ব্যবহারে,
অস্তমিত রবী।
ফুলগুলো আজও ফোটে,
মরে গেছে কবি।’
মালিহা অবাক হয় এই লোকটার সাথে পাভেলের অনেক মিল। পাভেলও কথায় কথায় ছন্দ মেলাতো।
– দারুণ! তবে কবিদের মরে গেলে চলে না মি.শাকিল।
– ধন্যবাদ। মিসেস অহমিকা।
– দেখুন আমি মোটেও অহংকারী কেউ নই।
– তাহলে দিনের পর দিন আমাকে এভোয়েট করলেন কেন? আপনার নামে আমি মানবাধিকার আদালতে মামলা করবো।
লোকটার কথা বার্তায় মালিহা বেশ মজা পায়।
মালিহা জানতে পারে শাকিল একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় আলাদা থাকেন দু’জন। মালিহাও ধীরে ধীরে স্বামীর সাথে তার দুরুত্বের কথা জানায়। মালিহার সাথে শাকিলের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
প্রাপ্ত বয়স্ক দু’জন ছেলে মেয়ের মধ্যে নাকি কখনও নিরেট বন্ধুত্ব হয়না, যা হয় সেটা ভালোবাসা। স্বামী সোহাগ বঞ্চিত নিগৃহীত একজন নারী নিজের অজান্তেই বিদ্রোহী হয়। মালিহার ক্ষেত্রেও তাই হয়। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। মনো-দৈহিক উষ্ণতায় বিনিময় হয় প্রতিরাতে।
শাকিল মালিহার ছবি চায়। ফোন নম্বর চায়। মালিহা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে ‘সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হয় তখন যখন পরিচিত মানুষ অপরিচিতের মতো আচরন করে। তারচে’ আমরা না হয় একে অপরের অদৃশ্য আশ্রয় হয়েই থাকলাম তাহলে অপরিচিত হয়ে যাবার ভয় থাকবে না কোন দিন।
– নিশিতা, তাহলে কি কোন দিনও আমাদের দেখা হবে না?’
– না।
শাকিলের কন্ঠে এবার অভিমান ঝড়ে পরে।
– এটা আমাদের কেমন সম্পর্ক নিশিতা! তোমার হাজবেন্ডের নামটাও কোন দিন বলতে চাও নি। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও তোমার কোন আগ্রহ নেই। কেন?
– কারন, আমাদের সম্পর্কটা শুধুই ভার্চুয়াল। এটাকে বাস্তবে টেনে আনার চিন্তা আমার আপাতত নেই।
– নিশিতা,আমরা কি এই সম্পর্কটাকে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে আমাদের জীবনে ইনস্টল করে নিতে পারি না, সোনা?
– পারি, তবে নেট ওয়ার্ক এখনও ক্লিয়ার নয় । আমি চাই যত দিন সেটা ক্লিয়ার না হয় তত দিন আমাদের সম্পর্কটা মেসেঞ্জারেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
শাকিল মনে মনে হাসে, নিশিতা অনেকটাই তার স্ত্রীর মতো। ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না। স্ত্রীর চোখ ফাঁকি দিতেই ফেসবুকে নতুন আইডি খুলেছে সে। সে এখন ‘অাশরাফ শাকিল।’
শাকিল নিশিতা (মালিহা) কে মেসেঞ্জারে ভিডিও চেটিং এ আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু মালিহার ফোনটি এন্ড্রয়েট না হওয়ায় সেটি সম্ভব হয় না।
প্রায় দুই মাস পর পাভেল বাসায় এসেছে। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া লাগে আবারও। তদুপরি, পাভেল তার মায়ের কাছে জানতে পারে মালিহা প্রায় সারারাত অনলাইনে জেগে থাকে। পাভেল ক্ষেপে গিয়ে তাকে মারপিট করে।
রাতে দুজন আলাদা বিছানায় ঘুমাতে যায়।
দু’জন দুজনের গোপন আইডিতে লগ ইন করে।
মালিহার মেসেঞ্জারে শাকিলের মেসেজ আসে।
– কেমন আছো সোনা?
– আমি মরতে চাই শাকিল।
– ধুর! মুখে যা আসে তাই বলো!
– আমি সিরিয়াসলি বলছি।
– জান সোনা, কি হয়েছে তোমার?
– ও বাসায় এসেছে। আমাকে মেরে রক্তাক্ত করেছে আজ।
– এখন কোথায় সে?
– পাশের রুমে।
– শালা আসলেই একটা জানোয়ায়।
– আমি ওকে ঘৃনা করি ।
– আজ আমিও বউয়ের সাথে দূর্ব্যবহার করছি। আমি আর ওকে সহ্য করতে পাচ্ছি না, জান। তুমি আমাকে মুক্ত করো সোনা।
– আমিও মুক্তি চাই শাকিল। আমাকে একটু আদর করো সোনা। আমাকে তোমার বুকে আগলে রাখো।
– তোমাকে অনেক আপন করে পেতে চাই, জান।
– আমাকে কাছে পেলে সারা জীবন একইভাবেই ভালোবাসবে তো সোনা পাগলা?
– ভালোবাসা কখনও ফুরায় না নিশিতা।
– মোহ কেটে গেলে ভালোবাসা হারিয়ে যায়,শাকিল। বিয়ের আগে সেও তো তোমার মতো করে আমাকে আদর করতো।
শাকিল রাগ করে-
– ওই জানোয়ারটার সাথে আমাকে তুলনা করছো? তিন মাসে তোমার একটা পিকও পাঠাও নি আমাকে। কখনও ফোনেও কথা হয় নি আমাদের। ভালোবাসা কি কমেছে তাতে?
নিজেদের সংসার জীবনে বিতশ্রদ্ধ শাকিল ও মালিহা সিদ্ধান্ত নেয় কালই তারা বিয়ে করবে। শাকিল তার জন্য ধরলা ব্যরেজে অপেক্ষা করবে। সোজা কাজী অফিসে গিয়ে মালিহা পাভেলকে ডিভোর্স করবে। তারপর শাকিলের সাথে নতুন জীবন শুরু করবে। শাকিল মালিহাকে নীল শাড়ি পরে আসতে বলে। প্রথম বারের মতো আজ তাদের সদ্য কেনা গোপন ফোন নম্বর বিনিময় হলো। বাকি রাতটা সকালের অপেক্ষায় নির্ঘুম কেটে যায় তাদের।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাভেল কর্মস্থলে চলে গেছে। এই বন্দি শালায় আর এক মহুর্ত নয়। মালিহা সব গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পরে।
মালিহাবাসে উঠে বসতেই শাকিলের ফোন আসে।এই প্রথম ফোনে কথা হতে যাচ্ছে তাদের।কিন্তু চলন্তবাসের ভেতর যাত্রীদের কোলাহলে শাকিলের কথা শোনা যাচ্ছিল না। তবে মালিহা এতটুকু বুঝতে পারে যে, শাকিল ধরলা ব্যারেজে তার জন্য অপেক্ষায় করবে।
দেড় ঘন্টার মধ্যেই মালিহা ধরলা ব্যরেজে পৌছে যায়। কিন্তু শাকিলের খবর নেই। শাকিলের ফোন অফ। পার্কের বেঞ্চে বসে বিচলিত হয়ে সে শাকিলের অপেক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ পেছন থেকে দুটি হাত আলতো ভাবে মালিহার চোখ ঢেকে ধরে। ‘সরি জান, দেরী হয়ে গেল। চোখটা বন্ধ করেই রাখ প্লিজ।’ চিরচেনা কন্ঠে অজানা এক আতংকে শিউরে উঠে মালিহা।
শাকিলও তার চোখদুটো বন্ধ রেখে মালিহার চোখ থেকে ধীরে ধীরে হাত সরায়। দুজনে মুখোমুখি দাড়িয়ে একসাথে চোখ খোলে। মহুর্তে দুজনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। এ যে পাভেল আর মালিহা মুখোমুখী দাড়িয়ে!!

মাঈদুল ইসলাম মুকুল

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে