২০০৯ সাল
ওয়াহিদ আনমনে বিড়বিড় করছে। আমি ও বেশ চিন্তিত। এ ধরণের কেইস আগে ডিল করিনি। আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক নই। তবে নিজের আগ্রহেই ওয়াহিদ কে দেখতে এসেছি।
ওয়াহিদ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে ফ্লাইট লেফটেনেন্ট কর্মরত ছিলো। ঘটনাটা বছর দুইয়েক আগের। ফাইটার (যুদ্ধ বিমান) পাইলট ছিল ও। ওদের ব্যাচের সোর্ড ওফ অনার বিজয়ী এক তুখোড় পাইলট। ফ্লাইং অফিসার থেকে ফ্লাইট লেফটেনেন্টে প্রমোশন পাবার পরপরই তার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ও হঠাৎ নিজেকে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর দাবী করে। ওর ব্যাচ মেইট রা প্রথমে জিনিসটা বেশ হালকা ভাবেই নিয়েছিলো। ভাবছিলো ওয়াহিদ ফাইজলামি করছে। কিন্তু ওর পাগলামির মাত্রা চূড়ান্ত হতে থাকে………!
একদিন আকাশে উড়ন্ত অবস্থাতে রাডার স্টেশনে কথোপকথনরত অবস্থায় সে বলে ওঠে –
“ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর বলছি, করাচির মসরুর বিমান ঘাঁটি থেকে। আমি এই মাত্র একটা টি ৩৩ ফাইটার হাইজ্যাক করেছি। এক পাকিস্তানী পাইলটকে কে হত্যা করেছি…….! হে বাংলাদেশ…….. অপেক্ষা করো! আমি ছুটে আসছি তোমাকে মুক্ত করতে!”
রাডার স্টেশন থেকে স্কোয়াড্রন লিডার শাফকাত চিৎকার করে বলেন –
“হোয়াট হেপেন্ড ডিয়ার লেফটেনেন্ট ওয়াহিদ!!!!!
আর ইউ অল রাইট???
আপনি অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত রানওয়েতে ল্যান্ড করুন। আপনি বাংলাদেশেই আছেন । বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।”
ওয়াহিদ বলে ওঠে-
“ইয়েস স্যার!!!!! ইয়েস।
আই লাভ মাই মাদার, আই লাভ বাংলাদেশ। ইয়েস ইয়েস……….. আই এম ল্যান্ডিং। দিস ইজ লেফটেনেন্ট মতিউর……! অ্যাট লাস্ট আই গট দ্যা ফাইটার ফর বাংলাদেশ।”
ওয়াহিদ নিরাপদে ই ল্যান্ড করে। ককপিট থেকে নেমে প্রথম প্রশ্ন করে – “স্বাধীনতা যুদ্ধের কি খবর!”
ওয়াহিদের পাগলামি দিনদিন বাড়তে থাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন – সিজোফ্রেনিয়া (জটিল মানসিক রোগ) নামক রোগে ও আক্রান্ত।
ওকে সারিয়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টাই করা হয় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। তবু ওয়াহিদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। আস্তে আস্তে সে সম্পূর্ণ
মানসিক ভারসাম্য হারায় । বাধ্য হয়েই ওয়াহিদ কে অবসরে যেতে হয়।
ওয়াহিদ বসে আছে আমার ঠিক সামনে।
চুপচাপ কাগজে কি জানি লিখছে….!মায়া লাগছে ছেলেটার জন্য। ওয়াহিদ আমার দূর সম্পর্কের অাত্মীয়। ওর মা আমাকে আজ ডেকেছেন একটু ওকে দেখার জন্য। ওয়াহিদ কয়েক বছর ধরে ই এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ খাচ্ছে।
ওয়াহিদ বয়েসে আমার সমান প্রায়। এখন একা একা থাকে। একেবারে চুপচাপ!!
——“খালাম্মা ওয়াহিদ ভাই অসুস্থ হলো কবে?”
—“বাবা! ও ফ্লাইট লেফটেনেন্ট হবার পরপরই ওর পাগলামিটা সবার চোখে পড়ে। বিমানের ককপিটে উঠে ই বিড়বিড় করতে থাকতো ছেলেটা । বিষয়টা ওর বন্ধু নাসির প্রথম আমাকে জানায়।
একদিন ফোন দিয়ে বলে – ‘খালাম্মা! ওয়াহিদ পাগলামি করছে। রুমের দেয়ালে মতিউর, মতিউর লিখে ভর্তি করে ফেলছে! কথাবার্তাও আগোছালো! কালকে ওর ফ্লাইং আছে, আমার তো মনে হয় – এভাবে ও ফ্লাইং করতে পারবে না আর। “এর পরদিন থেকেই আমার ছেলেটা আস্তে আস্তে অসুস্থ হতে থাকে। ইদানিং নিজের মাথা নিজে বাড়ি মারে। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয় ছেলেটার।”
রাত বাড়ছে। বাসায় ফিরতে হবে আমার। আমি ডায়েরীতে নোট করলাম — নাসির (ওয়াহিদের বন্ধু), সালাম স্যার (আমার দেখা সবচেয়ে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট)…….!
যাবার সময় ওয়াহিদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বিড়বিড়িয়ে বললেন –
“আমার জন্মদিনটাও তুই ভুলে গেলি!!!!! হায়রে অভাগা তুই…….। এতো বড় লজ্জা দিলি আমাকে!”
ফ্লাইট লেফটেনেন্ট নাসির সাহেব চমৎকার মানুষ। এখনো বিমান বাহিনীতেই আছেন। উনার সাথে কথা বলার একপর্যায়ে ভদ্রলোক কেঁদে ফেললেন। বললেন
—“আমাদের ব্যাচে ওয়াহিদ সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছিলো। এক কথায় অসাধারণ একটা ছেলে । ওর আইকন ছিলো – বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর। মতিউরের আত্মত্যাগ ই তাকে উৎসাহ দেয় বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়ার। একদিন আমাকে খুব আক্ষেপ করে বলেছিলো – ‘বুঝলি নাসির! বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর আমাদের মতো বয়সেই পাকিস্তানের করাচির মসরুর বিমান ঘাঁটি থেকে একটা টি ৩৩ ফাইটার হাইজ্যাক করতে চেয়েছিলো। কার জন্য!!!! এই বাংলাদেশের জন্য। এক পাকিস্তানী পাইলটের সাথে বিমান টা ছিনতাই করতে গিয়ে ওর ধস্তাধ্বস্তি হয়। বিমানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে হাতাহাতির এক পর্যায়ে বিমানটা বিধ্বস্ত হয়!
মতিউরের দাফন হয়েছিলো কোথায় – জানিস? মসরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে। কবরে লেখা ছিল – ‘ইধার শো রাহা হে এক গাদ্দার।'”
সেদিন আমি দেখেছিলাম ওয়াহিদের চোখে পানি। ওয়াহিদ প্রমোশন পায় ২৯ শে অক্টোবর । যতদূর মনে পড়ে সেদিন ও কেঁদেছিল। কারণ সেদিন ছিলো মতিউরের জন্মদিন। বাংলাদেশের সব কয়টা জাতীয় পত্রিকা খুলে আমায় বলেছিলো – ‘আজ মতিউরের জন্মদিন! অথচ কোথাও মতিউর কে একটা শুভ জন্মদিন ও কেউ দিলোনা!!!!! আহা! অভাগা জাতি আমার!
বুঝলি নাসির! আমি বা তুই দেশের জন্য বিমান বিধ্বস্ত হয়ে শহীদ হলেও এদেশ একদিন আমাদের ভুলে যাবে হয়তো! ‘
নাসির ভাইয়ের চোখে পানি – ” ওয়াহিদ কে মিস করি খুব! ও পরবর্তীতে ডিপ্রেশনে চলে যায় আস্তে আস্তে। হয়তো হতাশা ওকে গ্রাস করতে থাকে……….! একদিন আমাদের কমান্ডিং অফিসারের সামনে ই চিৎকার করে বলে – ” আমি বীরশ্রেষ্ঠ! অথচ আমার বার্থডে তে কেউ উইশ ই করলেন না আমাকে! আমি দেশের জন্য শহীদ হলাম……..! আর আপনারা সব বেমালুম ভুলে গেলেন? এই আমার প্রাপ্য!!!!!! ”
নাসির কাঁদছেন।
সব শুনে আমার মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।
সালাম স্যার হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে বারান্দায় বসে আছেন। ওয়াহিদ ভাই কে নিয়ে এসেছি স্যারের কাছে। বেচারা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আর একটু পর পর চিৎকার করছে।
স্যার নাম করা সাইকিয়াট্রিস্ট। স্যার সবশুনে আমাকে বললেন – “ওয়াহিদের একটা এম আর আই – ব্রেন করা । আর ছেলেটার সমস্যাটা ভয়াবহ । বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর ছেলেটার আইকন ছিলো। মানুষ যাকে সবচেয়ে ভালোবাসে তার অপমান সহ্য করা মানুষের পক্ষে সহজ নয় । কিছু ওষুধ চেন্জ করে দিলাম! যোগাযোগ রাখিস, ছেলেটাকে আমার ফলোআপে রাখিস। ওর শারিরীক অবস্থা খুব নাজুক। মাথা ব্যাথার ধরণটা মোটেই সুবিধার লাগছে না! এম আর আই করিয়ে নিউরোফিজিশিয়ান কাওকে দেখাবি।”
২০১৫ সাল
ওয়াহিদ মারা গেছে মাস খানেক হলো……….! সুইসাইড করেছে ছেলেটা!
সালাম স্যার অনেক ট্রাই করেছেন, বেশ কয়েকটা মেডিকেল বোর্ড করেছেন ছেলেটার জন্য। লাভ হয়নি কোনো। গত মাসে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওয়াহিদের মা কাঁদতে কাঁদতে আমার ওয়াহিদের ব্যক্তিগত ডায়েরীটা দেখালেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ছেলেটা লিখে গেছে—-”
I AM EXTREMELY SORRY ON BEHALF OF MY COUNTRY DEAR MOTIUR RAHMAN.
I LOVE YOU……. LOVE MY MOTHER……. LOVE MY MOTHERLAND……
ITS 29TH OCTOBOR…….
HAPPY BIRTHDAY TO YOU, DEAR……….!! ”
(কাল্পনিক)
ছোট গল্প – ফ্লাইট লেফটেনেন্ট ওয়াহিদ আর বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর
– আসিফ শুভ্র