ঢাকা এট্যাক : নেগেটিভ রিভিউ

0
ঢাকা এট্যাক

প্রথমেই সংবিধিবদ্ধ সতর্কিকরন

যারা যারা বলবেন, আপনি নিজেই আরো ভালো একটা মুভি বানান না দেখি কেমন পারেন অথবা আপনার জন্যে বাংলা মুভি না আপনি গিয়া হলিউড দেখেন গা অথবা দেশের ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে হলে দেশিয় কাজগুলোকে উতসাহিত করতেই হবে… আপনাদের জন্যে এই রিভিউ না। আমি মনে করি যে কোনো শিল্পের ভালো মন্দ একই পাল্লায় যাচাই হয়া উচিত এবং আমি আমার স্বল্পজ্ঞানে সেটাই এখানে করতে চেষ্টা করছি।

স্পয়লার এলার্ট:

মুভির কিছুটা প্লট, চরিত্র এবং বিশেষ কিছু দৃশ্য খুঁটিনাটি আলোচনা করা হবে। আপনি যদি ইতিমধ্যেই ঢাকা এট্যাক না দেখে থাকেন তবে ভুলেও আর সামনে এগুবেন না।

এখনো আছেন?

তবে চলুন শুরু করি…

Review: The Hype is NOT REAL!!! ঢাকা এট্যাক

মুভির শুরুতেই মুভির সাথে সংশ্লিষ্ট পুলিশ, সরকারি মন্ত্রি আমলা এবং সকল স্পন্সর কে লম্বা সময় নিয়ে আলাদাভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। তারপর মুভির আসল ইন্ট্রো। সত্যি বলতে পুরা মুভির এর ইন্ট্রো টাই সবচেয়ে ভাল্লাগসে। বেয়াহ একটা গ্রিটি নয়ার একশ্যান স্টাইল ভাইব ছিল, সাথের মিউজিক টাও জোশ ছিল।

তারপর মুভি শুরু হল। আমরা প্রথমেই একটা কেমিক্যাল ল্যাবে দুধর্ষ ডাকাতি দেখলাম। তারপর একে একে খুন হয়ে গেল ডাকাতির সাথে জড়িত সবগুলো ডাকাত, প্রতিটা লাশের বুকে ছুরি দিয়ে কেটে একটা ইংরেজি হরফ আর একটা নাম্বার লেখা। বুঝাই যাচ্ছে কোনো এক সাইকো কিলার ডাকাতগুলো কে খুন করছে এবং লাশের বুকে লেখা র‍্যানডম হরফ গুলো আসলে মোটেই র‍্যানডম নয় বরং খুনি একটা কিছু ম্যাসেজ দিতে চাইছে।

সো ফার সো গুড

তারপর আমরা গল্পের মেইন প্রোটাগনিস্টের সাথে ইন্ট্রোডিউসড হলাম…and the movie took a nose dive..
আমি জানি ঢাকা এট্যাকের গল্প লিখেছেন একজন পুলিশ অফিসার। এর ছাপ গল্পে স্পষ্ট। পুলিশি তদন্তের টেকনিক্যাল দিকগুলি খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। মুল কাহিনি আহামরি কিছু না হলেও সার্ভিসেবল বলা যায়। এর চেয়ে অনেক স্বস্তা গল্প নিয়ে হলিউডে মুভি হয়। তাই গল্প নিয়ে আমার তেমন অভিযোগ নাই। আমার সমস্যা ডায়লগ নিয়ে। প্রতিটা ডায়লগ এত্তো বোরিং এত্তো বোরিং যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না 😕😕 সংলাপের মুল উদ্দেশ্য কিন্তু খালি এক্সপোজিশন ডাম্প আর প্লট প্রোগেশন না। সংলাপের মাধ্যমে গল্পের চরিত্রগুলো রুপ পায়, তাদের মোটিভেশন, ইনার কনফ্লিক্ট ফুটে উঠে। কিন্তু ঢাকা এট্যাকের প্রতিটি সংলাপ এত্তো চাছাছোলা যে প্রতিটি চরিত্রকে নির্জিব রোবট বানিয়ে ফেলেছে। সত্যি বলতে পুরা মুভিতে এক ভিলেন ছাড়া আর কারো কোনো পার্সোনালিটি নাই। সবাই কার্ডবোর্ড কাট আউট।

অভিনেতারা কেউ এমন কোনো আহামরি কাজ দেখাননি যে এই বোরিং সংলাপকে আকর্ষনিয় মনে হবে। আরেফিন শুভ ন্যাকমিটা ভালো পারেন। কিন্তু এই মুভিতে স্টোয়িক পুলিশের ভুমিকায় তো আর ন্যাকামি দেখানো যায় না। তাই তার চরিত্রের ক্যারিজমা আর এক টুকরা ইটের মধ্যে কোনো পার্থক্য পাইনি। সবচেয়ে বড় ধরা খেয়েছেন এবিএম সুমন। বেচারা দেখতে শুনতে পুরাই একজন সুদর্শন সোয়্যাট কপ এর মতন কিন্তু বেচারা বোধ হয় অভিনয়ে একেবারেই কাচা তাই পরিচালক তাকে নিয়ে খুব বেশি রিস্ক নেন নাই। পুরা মুভিতে তার একটাই ডায়ালগ সোয়াট গেট ডাউন গেট ডাউন….

আরেফিন শুভ আর সুমন এর মধ্যে বেশ একটা বাড্ডি কপ কেমিস্ট্রি করা যেত, ভালো কিছু ব্রোমান্স দেখানো যেত। কিন্তু হায়। শুভ আর সুমন বেয়ারলি কোনো সিন শেয়ার করেছেন। অথবা হাতেগোনা যে দুইচারটা দৃশ্যে তারা দুইজন একসাথে আছেন সেখানেও তাদের মাঝে কথা হয়েছে খুব কম। কোনো ফানি ব্যান্টার নাই, কোনো উইটি কুইপ নাই, কোনো ইমোশন্যাল ব্যাক এন্ড ফোর্থ নাইই।

তবে সবচেয়ে গা জ্বালানো ক্য্রারেক্টার ছিল মাহিয়া মাহি। তার ঢংিপনা দেখে কতবার যে পর্দার দিকে স্যান্ডেল ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করেছে। মুভির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে নায়কের সাথে আঠার মতো লেগে আছে। শুভ বান্দরবনে রেইড দিতে যাবে, সাথে যাবে কে? মাহিয়া মাহি। শুভ বম্ব ডিস্পোজ করতে যাবে, হুন্ডায় কে চড়ে বসল? মাহিয়া মাহি। শুভ ভিলেনের সাথে লাস্ট মুকাবিলা… পিছে কে আছে??? এনি গেস??? আবার জিগায়… মাহিয়া মাদারফা***ং মাহি। শেষের দিকে মনে হইসে শুভ যদি এখন কইষা মাহিরে একটা বন চটকনা লাগায় তাইলে পুরা হলভর্তি দর্শক হাততালি দিবে। কিন্তু হায়…

মুভির কাস্টিং ফিফটি ফিফটি… সব চরিত্রের আউটলুক বডি সেইপ পার্ফেক্ট.. কিন্তু কেউ চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সাইড নোট: আফজাল ভয়েস ডাবিং করা হয়েছে অন্য আরেকজনের গলায়। এর কারন কি? আফজাল কি ডাবিং এর টাইম দিতে পারেননি? যাই হোক আফজালের মুখে অন্য কারো কন্ঠ শুনতে খুবি বেমানান, ভাগ্য ভালো তার খুব বেশি স্ক্রিন টাইম ছিল না।

ব্লান্ড ডায়লগ আর কুকি কাটার ক্যারেক্টারাইজেশন ছাপিয়ে মুভির সবচেয়ে বড় দোষ হয়ে উঠেছে এর এডিটিং। আমি জানি নআ এডিটর সাহেব কি খেয়ে কম্পিউটারের সামনে বসেছিলেন। কসাই চাপাতি দিয়ে যেভাবে ঘ্যাটাঘ্যাট ঘ্যাটাঘ্যাত কিমা বানায়, মুভির ফিল্মের উপরেও মনে হয় সেভাবে চাপাতি দিয়ে এলোপাথাড়ি কুচিকুচি করে তারপর টুথপেস্ট দিয়ে জোড়া দেয়া হয়েছে। কোনো একটা শট এর দৈর্ঘ দশ সেকেন্ডের বেশি না। এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে ট্রাঞ্জিসনের বালাই নাই। সারাক্ষণ মনে হয়েছে কোত্থেকে কোথায় যাচ্ছি?কে কোথায় আছে? কোনটা দৃশ্যের শুরু কোনটা শেষ?? হয়তো এডিটর মশাই একটা ননস্টপ রোলার কোস্টার রাইডের ফিলিংস দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাতে করে আমার মোশন সিকনেস উঠে গেছে। আবহ মিউজিকগুলো খুবি ভালো ছিল কারন প্রায় প্রতিটি মিউজিক বিদেশি কোনো না কোনো মুভি থেকে চুরি করা। সবচেয়ে মেজাজ খারাপ হয়েছে ডার্ক নাইট রাইজেস এর বেন আর ইন্সেপশন এর মোম্বাসা থিম চুরি করায় ক্যামেরার কাজ সত্যি ভালো হয়েছে শুধু যদি এডিটর মশাই সটগুলো দশ সেকেন্ডের বেশি বেচে থাকার সুযোগ দিতেন তাহলে হয়তো ক্যামেরার কাজ নিয়ে আরো কিছু লিখতে পারতাম। একশ্যান দৃশ্যগুলোর এডিটিং পুরাই কোপা সামসু… দুই হাতে দুই চাপাতি লয়া কোপা.. এক্সট্রিম ক্লোজ আপ, হার্ড ক্যাম, শেকি ক্যাম, ব্লাইন্ডিং ফাস্ট কাটিং… মানে দুর্বল স্টান্ট ওয়ার্ক, লো প্রোডাকশন ভ্যালু লুকাতে যা যা ট্রিকস এপ্লাই করা যায় পরিচালক তার সবগুলোই ব্যাবহার করেছেন। এখানে অবশ্য পরিচালক কে দোষ দেব না। তার বাজেট আর টেকনিক্যাল নো হাউ দিয়ে যতটুকু কুলিয়েছে তিনি ট্রাই করেছেন।

এডিটিং আর স্ক্রিপটিং এর সব চেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল মুভির সংগ প্লেসমেন্ট। গান গুলি এমন এমমন সময় শুরু হয়েছে যখন গানের কোনো প্রয়োজনই নাই। বিশেষ করে মুভির ক্লাইম্যক্সের সময়, নায়ক যখন বম্বস্যুট ছাড়া খালি হাতে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে যাবে, একটু ভুল হয়ে গেলে বেচে ফিরার আশা নেই.. এমন একটা চরম টেনশনের সময় আচমকা নায়ক নায়িকার স্লো বিরহের গান… পথ যে ডাকেএএএএএ… আই মিন… হোয়াট দ্যা হেল??

অরিজিত সিং কে দিয়ে টুপটাপ চুপচাপ গানটি করানো হয়েছে। গানের সুর দৃশ্যায়ন সবই ভালো হয়েছে। তবে অরিজিত কে দিয়ে কি আরেকটু চ্যালেঞ্জিং কোনো গান করানো যেত না? টুপটাপ টাইপের গান তো আমাদের হাবিব বালাম ওরাই পারে।

শেষ করব ভিলেনের কথা বলে। এই তাসকিন ছেলেটা একটা এস্যেট। পুরা মুভিতে ওর অভিনয় সবচেয়ে ভালো হয়েছে, এবং ওর চরিত্রটাই সবচেয়ে বেটার রিটেন ক্যারেক্টার। ছেলের অভিনয়ের কিছু কিছু জায়গায় ইমর্টাল হিথ লেজারের জোকারের ছায়া দেখতে পেয়েছি। এক কথায় অসাধারণ। কিন্তু ছেলেটা স্ক্রিন টাইম পেয়েছে খুব কম। মেইন ভিলেন রিভিল করা হয়েছে মুভির একবারে শেষে। মেইন এন্টাগোনিস্টকে রহস্য করে রাখা এক জিনিস… যেমন জেমস বন্ডের স্কাইফল এ হাভিয়ারের আবির্ভাব হয় মুভির মাঝামাঝিতে। কিন্তু ঢাকা এট্যাকে ভিলেনের প্রবেশ ঘটাতে কাহিনিকার একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছেন। তারপর ভিলেনের এন্টায়ার ব্যাকস্টোরি তাড়াহুড়া করে যেনতেন ভাবে ফ্ল্যাশব্যাক আর মনোলগের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পিপল.. দিস ইজ মুভি মেকিং রুল ওয়ান ও ওয়ান…Show… Don’t Tell

মাঝখানে পনেরো মিনিটের জন্যে আমরা লাফ দিয়ে মালয়েশিয়া থেকে ঘুরে এসেছি। এই ডিট্যুর টা না হলেও চলত। মুভিটা হাসপাতাল বম্বিং এর মাধ্যমেই শেষ করে দেয়া যেত। তা না করে আরেকটা স্কুল বম্বিং পর্যন্ত টেনে নেয়া হয়েছে। যার প্রয়োজন ছিল না।

যাই হোক… অনেক আশা নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। আশা পুরন হয়নি। তবে জিরো এক্সপেক্টেশন নিয়ে দেখতে বসলে হয়তো ভালোই লাগত। এই মুভির মাধ্যমেই বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরে আসবে কিনা জানি না। তবে এর মাধ্যমে শুরুটা হল। এই বা কম কি।

আরেকটা পজিটিভ। আমাদের পাশের দেশ ভারতের ৯৯% থ্রিলার বিদেশি মুভির কপি পেস্ট। সেখানে আমরা মৌলিক গল্প দিয়ে যাত্রা শুরু করেছি। এই ঢাকা এট্যাকেই যদি আরেকটু টাইট স্ক্রিপ্ট, বেটার ডায়ালগ, বেটার ক্যারেক্টারাইজেশন আর বেটার এডিটিং করা যেত তবে হয়তো এটাই একটা মাইলফলক মুভি হতে পারত। আশা রাখছি মুভির সিক্যুয়েল ঢাকা এট্যাক এক্সট্রিম এ এইসব ভুলত্রুটি কাটিয়ে উঠা যাবে।

আপাতত সেই অপেক্ষায়….

লেখকঃ Ashif Rudlefuz

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে