প্রায়ই আমার কাছে অনেকে পরামর্শ চায়, দিল্লীতে ঘুরে দেখার মত কি কি দর্শনীয় স্থান আছে, কিভাবে ঘুরে দেখা যাবে, খরচ কেমন ইত্যাদি। লিখবো লিখবো করে আর লেখা হয় না। হার্ড ডিস্কে ছবিগুলো পড়ে আছে আজ কয়েক বছর। তো যারা দিল্লী ভ্রমণে আগ্রহী বা কাশ্মীর, জয়পুর বা দক্ষিণ ভারতে যাবার সময় অল্প সময়ে দিল্লী ঘুরে দেখতে চান, তাদের জন্য আজকের এ লেখা।
দিল্লীতে দর্শনীয় স্থানগুলোর একটা তালিকা দেই, যা দিল্লী ভ্রমণে অবশ্যই দেখতে হবে।
১। লাল কেল্লা।
২। কুতুব মিনার।
৩। হুমায়ুনের সমাধি
(Humayun’s Tomb)
৪। দিল্লী জামে মসজিদ।
৫। চাঁদনি চক মার্কেট।
৬। ইন্ডিয়া গেইট, পার্লামেন্ট ভবন।
৭। বিরলা মন্দির।
৮। মাহাত্মা গান্ধীর সমাধি।
আমি উপরের এই ৮ টি স্থান আর দিল্লী শহরটা ঘুরে দেখেছিলাম। এর বাইরেও ২-৩ টা জায়গা আছে, যেমন – লোটাস টেম্পেল যা আমার দেখা হয়নি।
দিল্লীর ২ টা অংশ আছে, পুরাতন দিল্লী আর নতুন দিল্লী। নতুন দিল্লী সম্পূর্ণ আধুনিক শহরের আদলে বানানো, এখানে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান খুব একটা নেই। যারা মুঘল ইতিহাস, স্থাপনা নিয়ে আগ্রহী তাদের শুরুতেই চলে যেতে হবে পুরাতন দিল্লীতে। পুরাতন দিল্লী খুব ভালোভাবে ঘুরে দেখতে হলে এবং মুঘল আয়েশী খাবারের ফ্লেভার নিতে হলে আপনাকে নূন্যতম দেড় দিন সময় পুরাতন দিল্লীর জন্য রাখতে হবে। এর বাইরে তালিকার অন্যান্য স্থান ঘুরতে আরো ১ দিন সময় দিতে হবে। অর্থ্যাৎ, সম্পূর্ণ দিল্লী ঘুরতে ২ দিনের কিছু বেশি সময় অবশ্যই লাগবে। এই ২ দিনে দিল্লী ঘুরতে, হোটেল থাকা, যাতায়াত, টুকটাক কেনাকাটায় খরচ হবে ৫-৬ হাজার রূপীর মতো।
প্রথম দিনই দিল্লী এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সিতে চলে যাবেন কুতুব মিনার (যা দিল্লী থেকে ৭-৯ কি.মি দূরে)।
# কুতুব মিনার :
ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট। আজ থেকে প্রায় ৯০০ বছর আগে দিল্লীর সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেক ১১৯২ সালে ২৪০ ফিট উচ্চতার এ মিনারটি নির্মাণ করেন। শুধুমাত্র ইট দিয়ে নির্মিত পৃথিবীর সমচেয়ে উঁচু মিনার এটি। কুতুব মিনার ও এর আশেপাশের স্থান সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতে সময় লাগবে ২ ঘন্টার মতো। আগে কুতুব মিনারের একদম উপরে উঠা যেতো। কিন্তু ৪ জন ছাত্র উপর থেকে পড়ে মারা যাবার পর থেকে তা নিষেধ করে দেয়া হয়েছে।
কুতুব মিনার ঘুরে সকাল ১১-১২ টার মধ্যে চলে আসতে হবে পুরাতন দিল্লীতে। পুরাতন দিল্লীতে এসে প্রথমে দেখে ফেলতে হবে দিল্লী জামে মসজিদ।
# দিল্লী জামে মসজিদ :
৫ম মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৫৬ সালে তৎকালীন প্রায় ১০ লক্ষ রূপী খরচ করে এই বিশাল মসজিদটি নির্মাণ করেন। টাকার অঙ্কটা বলার কারণ হলো, তখন ১ টাকায় ৮ মণ বা ৩২০ কেজি চাল পাওয়া যেতো !! এটি ইন্ডিয়ার অন্যতম সুন্দর মুঘল কারুকার্য মন্ডিত বড় মসজিদ যেখানে একসাথে প্রায় ২৫,০০০ মুসল্লি নামাজ পড়তে পারে।
পুরো মসজিদ কমপ্লেক্সটি ঘুরে দেখতে প্রায় ১ ঘন্টা সময় লাগবে।
দিল্লী জামে মসজিদ থেকে বের হলেই নাকে লাগবে পুরাতন দিল্লীর মুঘল ট্রেডিশনের সব খাবারের ঘ্রাণ। কারণ মসজিদটির ঠিক পাশেই সব খাবারের দোকান। আর দিল্লী জামে মসজিদ থেকে ১০ মিনিট হাঁটা পথেই লাল কেল্লা ও চাঁদনি চক মার্কেট। জামে মসজিদের পাশেই শুধুমাত্র খাবারের দোকানগুলো নিয়ে ২-৩ টি বড় লেন আছে। এখানেই বিভিন্ন রকমের শাহী টিক্কা, কাবাব, নান, বিরিয়ানী, লাচ্ছি দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকালে ঘুরে দেখতে হবে লাল কেল্লা।
# লাল কেল্লা (Red fort) :
ইন্ডিয়াতে লাল কেল্লা ২টি। একটি দিল্লীতে যা মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৯ সালে নির্মাণ করেন। আরেকটি আগ্রায় যা সম্রাট শাহজাহানের দাদা সম্রাট আকবর নির্মাণ করেন। দুইটা লাল কেল্লাই আমার দেখা হয়েছে। এই দুই লাল কেল্লাই সম্পূর্ণ Red stone এ তৈরী। এ পাথরগুলো তৎকালীন পারস্য থেকে আনা হয়েছিলো এবং পারস্যের বিখ্যাত ইমারত নির্মাতারা এ কেল্লাগুলোর নকশা করেছিলো। আজ ৪০০ বছর পরেও বড় রকমের কোন সংস্কার ছাড়াই কেল্লাদুটি ঠাঁয় দাড়িয়ে আছে। তবে আগ্রার লালকেল্লার সাথে দিল্লীর লালকেল্লা ৯০% মিল থাকলেও আগ্রার লাল কেল্লায় কেল্লার বাইরের দিকটায় ২ স্তরের পরিখা আছে যা দিল্লীরটায় নেই। এর মূল কারণ, আকবরের সময়টা পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যে যুদ্ধ লেগেই থাকতো, কিন্তু শাহজাহানের সময়টায় মুঘল সাম্রাজ্য অনেক স্থিতিশীল ছিলো। দিল্লীর লালকেল্লা থেকেই ভারতের স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তোলা হয়। লালকেল্লা সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতে ২-৩ ঘন্টা সময় লাগবে। লালকেল্লার ঠিক ভিতরে একটি মার্কেট রয়েছে যেখানে মুঘল সময়কার অস্ত্র, অলংকার নির্মাতাদের বংশধরদের দোকান এখনও আছে, যারা souvenir সংগ্রহ করেন তাদের জন্য এটা আদর্শ জায়গা। লালকেল্লায় সন্ধ্যার ঠিক পরেই ৭-৮ টা পর্যন্ত লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয় যেখানে সম্রাট বাবর থেকে মোঘল সাম্রাজ্যর শেষ সম্রাট আওরঙ্গজেবের ইতিহাস দেখানো হয়। পূর্ণিমা চাঁদের আলোর নিচে মনোমুগ্ধকর এই ইভেন্টটা কোন ভাবেই মিস দেয়া যাবে না।
লালকেল্লায় লাইট এন্ড সাউন্ড শো শেষে ১-২ ঘন্টায় দিল্লীর বিখ্যাত ও সবচেয়ে বড় চাঁদনি চক মার্কেট ঘুরে দেখতে পারেন এবং কেনাকাটা করার থাকলে করে নিতে পারেন। দিল্লী জামে মসজিদের আশে পাশেই সব হোটেল রয়েছে। তবে হোটেলগুলো মধ্যম মানের। রাতটা এখানে পার করে দিয়ে পরদিনের দিল্লী ভ্রমণের প্রস্তুতি নেয়া।
দ্বিতীয় দিন –
পরদিনটা শুরু করা যায়, সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি (Humayun’s tomb) ভ্রমণ দিয়ে।
# সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি (Humayun’s tomb) :
১৫৭০ সালে নির্মিত হুমায়ুনের সমাধি দিল্লীর ইউনেস্কো ঘোষিত আরেকটি ওয়ার্ড হেরিটেজ সাইট। এটি হলো আগ্রার তাজমহলের mother structure. এর কারণ এটি তৈরীর পরপরই এর অনুকরণে পরবর্তীতে আরো বৃহৎ আকারে ও নকশায় আরো পরিবর্তন এনে আগ্রার তাজমহল তৈরী করা হয়। এখানে সমাহিত আছেন, মুঘল সাম্রাজ্যের ২য় সম্রাট হুমায়ুন। নান্দনিক সৌন্দর্য আর কারুকার্যে ভরা এ কমপ্লেক্সটি ঘুরে দেখতে সময় লাগবে ১-২ ঘন্টা। এখানে একটি চোরা বুদ্ধি আমরা খাটিয়েছিলাম, একই কাজ আগ্রার তাজমহল দেখার সময়ও করেছিলাম। ভারত ছাড়া অন্য সব দেশের নাগরিকদের জন্য টিকেট প্রায় ৫০০ রুপি করে আর ভারতের নাগরিকদের জন্য ৫০ রুপি। ভারতবর্ষের মানুষদের গায়ের রং কাছাকাছি। তাই আমরা আসামের বলে টিকেট কিনেছিলাম। গেইটে জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে, “আসাম সে আয়া হু”, কেউ কলকাতা বলতে যাইয়েন না কিন্তু। কারণ কলকাতার মানুষদের হিন্দী বলা অনেক স্পষ্ট, যা আমাদের অনেকেই পারবো না। আসামদের হিন্দী বলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা, তাই গেইটে আসাম বললে ধরা খাবার চান্স কম। আর পাসপোর্ট হাতের পার্সেল বা পকেটে না রেখে বড় ব্যাগে রাখবেন, গেইটে পাসপোর্ট চেক করা হয়।
হুমায়ুনের সমাধি দেখার পর পুরাতন দিল্লী দেখা প্রায় শেষ। পুরাতন দিল্লী থেকে ট্যাক্সিতে বা মেট্রো ট্রেনে চলে আসতে হবে নতুন দিল্লীতে। দিনের বাকি সময় দেখে নিতে পারেন বিরলা মন্দির, ইন্ডিয়া গেইট, পুরো ভারতের সমস্ত সিদ্ধান্তের প্রাণকেন্দ্র পার্লামেন্ট ভবনের বিশাল এলাকা, রাজঘাটে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর সমাধি। এ স্থানগুলো কাছাকাছি হওয়ায় একটা ট্যাক্সি ৫০০-৮০০ রূপীতে রিজার্ভ করে নেয়াটাই ভালো।
উপরের বর্ণনার সব জায়গাই আমার ঘুরে দেখা হয়েছে। অ্যালবামটিতে এ স্থানগুলোর ৪০টির মতো ছবি দেয়া হলো। আমার মতে, বাংলাদেশ থেকে কাশ্মীর, শিমলা-মানালী-লাদাখ, আগ্রা-জয়পুর এ সব জায়গা ভ্রমণের সময় হাতে ২ দিন সময় রেখে দিল্লীটা সবার ঘুরে দেখা উচিত। কারণ, মুঘল সাম্রাজ্যে ৪০০ বছর আগে নিজেকে আবিষ্কার করার জন্য দিল্লী, আগ্রা ভ্রমণ ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।
ডা: আরিফ উর রহমান