১। হুমায়ূন আহমেদ বাজারী লেখক কারণ তিনি বাজার ধরার জন্য লিখতেন। হুমায়ূন আহমেদ মাঝারি লেখক কারণ তাঁর লেখায় উচ্চমান নেই। হুমায়ূন আহমেদ মাজারী লেখক কারণ তিনি পীর প্রথার আদলে কিছু মুরিদ রেখে গেছেন যারা সাহিত্যের কিছুই বুঝে না।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ ব্যাপারে খুব প্রচলিত সমালোচনার সারাংশ। হুমায়ূন আহমেদ জীবদ্দশায় এসব সমালোচনা শুনে গেছেন। নিজেদের “কবি সাহিত্যিক” দাবী করা কিছু লেখক যখন নিজেদের চরম জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করে দেখলেন তাদের বই কেউ ধরে দেখছে না, এসব বই কেউ কারো ঘরে দেখছে না, অত্যন্ত উচ্চমানের এসব বই কেউ নেড়ে দেখে না, “কী এমন লিখছে” কৌতূহল নিয়ে মেলা থেকে কেউ বই খানা পেড়ে দেখে না তখনই মুলত “হুমায়ূন সমালোচনা” নামে বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি ধারার সূচনা হলো যা অদ্যাবদি বর্তমান।
এই ধারার সুবিধা হলো আপনি যখনই আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছেন দেখবেন তখনই হুমায়ূন আহমেদের নামে কিছু একটা বলে ফেলুন। আপনি আবার আলোচনার টেবিলে জায়গা পেয়ে যাবেন।
হুমায়ূন আহমেদের কথায় যাওয়ার বাইরে আরো কিছু কথা বলে ফেলি।
বাংলা উপন্যাস জগতে ব্যাপক আমজনতার সাড়া সর্বপ্রথম যিনি পেয়েছিলেন তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই আমজনতার সাড়া তাঁর জন্য কম পীড়াদায়ক হয় নি। শরৎ আর দেবদাস এখন সমার্থক শব্দ। দুঃখের ব্যাপার এই দেবদাস বই নিয়ে তিনি সমালোচনা শুনেছেন সবচেয়ে বেশি। অনেকেই এই বইকে ছাইপাশ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই বই “ক্যামতে” সাহিত্য হয় আর ইহা কতদিন টিকবে তা নিয়ে সাহিত্য বিশারদদের মধ্যে প্রবল চিন্তা ছিল। বেচারা শরৎ বাবু এই বই লিখেছেন ১৯০১ সালে। সমালোচনার ভয়ে তালাবন্ধি করে রেখেছিলেন পাণ্ডুলিপি। পল্লীসমাজ লেখার পর যখন তিনি লেখক হিসেব খানিকটা মর্যাদা পেলেন তারপর ১৯১৭ সালে প্রকাশ করেন “বাজারি” বই দেবদাস।
আজকে যারা হুমায়ূন আহমেদের বই দুই দিন টিকবে না বলছেন তারা কী বলবেন ১০০ বছর আগের বাজারি বই “দেবদাস” এখন আছে কি নাই?
তারাশংকর, বিভূতিভূষণ, বনফুল, মানিক সর্বোপুরি রবীন্দ্র বলয়ে যে শরৎচন্দ্র ছিলেন সবচেয়ে নিম্নমানের লেখক, যাকে নিয়ে আলোচনা ছিল না সেই তিনি এখন আছেন না নেই?
তারাশংকরের “কবি” বা বিভূতির “পথের পাঁচালি” মতো করে তিনি হয়তো লিখতে পারেন নি। কিন্তু শরত চর্চা আর সবার থেকে কম হচ্ছে নাকি বেশি হচ্ছে?
আমি বলছি না হুমায়ূন আহমেদের “হলুদ হিমু কালো র্যাব” আর “দেবদাস” এক জিনিষ। আমি শুধু এটাই বলতে চাই কে টিকে থাকবেন আর কে থাকবেন না সেটা কোন ব্যক্তি নির্ধারণ করতে পারে না, নির্ধারণ করবে সময়। শরৎ এত বড় বড় পাণ্ডবদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে গেছেন। আপনি বলুন হুমায়ূন আহমেদের পরে স্বাধীন বাংলাদেশের কজন লেখক আছেন যারা শক্ত কম্পিটিশন করতে পারবেন? আমি জানি আপনি কিছু জনবিচ্ছিন্ন লেখকের নাম বলবেন। সেই লেখক আর লেখার খবর বেঁচে থাকলে ৫০ বছর পরে নেয়া যাবে।
২। যখন ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করি তখন থেকে নিয়েই একটা কথা খুব বেশি শুনতাম, শচীন ওয়ানডে ম্যাচ হারায়। কীভাবে ম্যাচ হারায়?
সেঞ্চুরি করে।
খুব অদ্ভুত লাগত এ কথা শুনে। সেঞ্চুরী করে কীভাবে ম্যাচ হারানো যায়?
কিন্তু কথাটা এতটাই প্রচলিত ছিল যে এর বিরুদ্ধে কিছু বলার কোন স্কোপ ছিল না। শচীন সমালোকদের এই বাক্যবাণ শুনে শুনেই শচীনের খেলা দেখতে হয়েছে। শচীন সেঞ্চুরি করলেই এক শ্রেণীর দর্শক নাক সিটকানো শুরু করে দিত। “এই দেখ, এবার ইন্ডিয়া না হেরে পারে না। শচীন কোন প্লেয়ার না। এরচেয়ে দ্রাবিড়, যুবরাজ অনেক ভালো।”
একটু ক্রিকেট পরিসংখ্যান দিয়ে দিই। শচীনের ৪৯ সেঞ্চুরীর মধ্যে ভারত হেরেছে ১৪ টি। ১ টা টাই, ১ টার রেজাল্ট নেই। শচীন সমালোচকদের আপত্তি ছিল এখানেই। এই লোকের ১৪ সেঞ্চুরি দলকে হারিয়েছে! কী জঘন্য, কী জঘন্য!!
কিন্তু বিপরীত চিত্রটা এই সমালোচক শ্রেণী ভাবতে পারে নি। শচিনের সেঞ্চুরির পর ভারত জিতেছে ৩৩ ম্যাচ। মজার ব্যাপার হচ্ছে শচিন ছাড়া আর কারো ৩৩ সেঞ্চুরিই নেই। ম্যাচ জেতানো তো বহুদূর।
হুমায়ূন আহমেদ পড়েছেন এই কাতারে। অসংখ্য বই লেখা এই লেখকের কিছু বই দিয়ে তাঁকে প্রতিনিয়ত নিচে নামানোর চেষ্টা করা হয়। এ গুলোকে বারবার রেফারেন্স দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় তিনি বাজারি লেখক। একটা মানুষ ৫ টা বই লিখলে সব মাস্টারপিস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ১০০ টা বই লিখলে সেখানে ২০ টা বই বাজে হবে না এমন তো কথা না। হুমায়ূন আহমেদ কয়শ বই বাজে লিখেছেন সেই তালিকা না করে কয়টা বই ভালো লিখেছেন সেই তালিকা করে দেখুন। দেখবেন আপনাদের জনবিচ্ছিন্ন উচ্চমার্গীয় লেখকের সম্মিলিত বইয়ের সংখ্যা এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ হয় কিনা। পুরো ক্যারিয়ারে ১২ সেঞ্চুরি করা রাহুল দ্রাবিড় আপনার কাছে সেঞ্চুরিয়ান ম্যাচ উইনার হতে পারে। শচিনের জলে ফেলে দেয়া সেঞ্চুরিও কিন্তু এর চেয়ে বেশি। কোন লাইনে হিসেব করবেন সেটা আপনার ব্যাপার।
৩। হুমায়ূন সমালোচনার আরেকটা বড় পয়েন্ট লেখার সরলতা। আমরা সাহিত্য বলতে যা বুঝে থাকি ” বাবুজি শ্বেত শুভ্র ধুতি পরিধান করিয়া দক্ষিণ বাহুতে লোহিত বর্ণ চাদরখানি বিছাইয়া বাটির সম্মুখে আসিয়া স্মৃতির কপাটে নাড়া দিয়ে দেখিলেন আসল জিনিষখানাই তো আনা হয় নাই। ইহা ভাবিতেই তাঁর চারিখানা দন্ত রৌদ্রের প্রতিফলনের কারণ হইল”।
হুমায়ূন সেই দন্তভাঙ্গা জগতকে ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি সাহিত্যকে করে ফেললেন নিজের মতো করে সহজ। এটাই হয়ে গেল সমালোচকদের আক্রমণের জায়গা।
কথা হচ্ছে সাহিত্য কি স্থির থাকা কোন বিষয়? চর্যাপদ থেকে নিয়ে সাহিত্য কবে স্থির ছিল? সাহিত্যের কোন পরিবর্তন হয় নি?
“আপনা মাংসে হরিণী বৈরি” থেকে নিয়ে “যে জন বঙ্গে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী” হয়ে ” হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন” আর বর্তমান ” হয়তো তোমাকে হারিয়ে দিয়েছি, নয়তো গিয়েছি হেরে” এর মধ্যে কোন ব্যবধান নেই?
বঙ্গিম থেকে নিয়ে রবি ঠাকুরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই?
তাহলে হুমায়ূন একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করলেই তাঁকে কেন আস্তাকুড়ে ফেলে দিতে হবে? এই অধিকার সাহিত্য কাকে কবে দিয়েছে?
প্রমথ যখন সাধু রীতিকে পাল্টে দিয়ে চলিত রীতি শুরু করলেন তখন ব্রাহ্মণবাদী সাহিত্যিকের দল হায় হায় করে উঠল। এ কোন পাগল ছাগল এলো! সাহিত্য তো শেষ। সাধু ছাড়া সাহিত্য চলিবে কি করিয়া?
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ চলিতকে বুকে টেনে নিলেন। তারপর কী হলো?
চলিত এখন আছে কী নেই? সাধুর জায়গা চলিত কি দখল করতে পারে নি?
আবারো বলি, সাহিত্য ধরা বাধার জিনিষ না। সাহিত্যকে দড়ি দিয়ে আটকে রাখতে পারবেন না। সাহিত্যকে বিশেষ কোন জার্সি পরাতে পারবেন না। কে কীভাবে লিখবে সেটা কেউ কাউকে নির্ধারণ করে দিতে পারে না। লেখার মান এতটাই উচ্চ হলো যে সেটা আসমান থেকে মাটিতে নেমে পাঠকের হাতে পৌঁছাতে পারল না?
লাভ কী তাতে। লেখার মান যদি কিছুটা খারাপ হয়েও পাঠকের হাতে যেতে পারে সেটাই কী ভালো না?
ভিভ রিচার্ডস নেটে ব্যাট করছেন। একটা বলকে তিনি সজোরে হাঁকালেন। কোচ দৌড়ে এসে বললেন, হায় হায় করছো কী তুমি? তোমার পা কই? ফুটওয়ার্ক নেই কেন?
ভিভ বললেন, আমার পা কই সেটা দেখতে হবে না। বল কই সেটা আগে দেখ।
হুমায়ূন আহমেদের পা কই দেখার দরকার নেই। তিনি বল কই পাঠিয়ে দিয়েছেন সেটা আগে দেখুন।
৪। একটা ট্যাকনিকাল প্রশ্ন করি।
রবীন্দ্রনাথ কোন রাইটারের সমালোচনা করেছেন এমন কিছু মনে করতে পারেন?
সম্ভবত না। রবীন্দ্রনাথ কোন রাইটারের সমালোচনা করেন নি। বরং শরত, নজ্রুল এদেরকে বই উৎসর্গ করেছেন। ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রমথ বা তখনকার একদম জনবিচ্ছিন্ন জীবনানন্দের। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের রাজার আসনে বসে তিনি কেন কারো সমালোচনা করলেন না?
যে তো যে কাউকেই বলতে পারতেন ” তুই ছাই পাস লিখছিস।”
এবার বলুন আপনি কী কোথাও দেখেছেন হুমায়ূন আহমেদ নাম ধরে কারো সমালোচনা করছেন?
সম্ভবত না।
এরা কারো সমালোচনা করতেন না কারণ তাঁদের সেটা করার দরকার নেই। তাঁরা সমালোচক জন্ম দেন, সমালোচনা করে তাঁদের বাঁচতে হয় না। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এখনো এমন বহু মানুষ পাবেন যাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ চুলের লেখক।
হুমায়ূনের সমালোচনা কারা করতেন তাঁদের নাম আমি নিতে ইচ্ছুক না। তবে যারা করতে পারতেন, করেন নি এমন দুজনের নাম বলছি। একজন সুনীল, অন্যজন সমরেশ। লেখা নিয়ে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে তবে এই তিন জনের মধ্যে থাকতে পারত। অথচ চরম জনপ্রিয় এই তিন জন কখনো কারো সমালোচনা কেউ করেন নি। বরং হুমায়ূন সমালোচনায় বিরক্ত হয়ে সুনীল নিজেই বলেছেন ” হুমায়ূনের খুঁত ধরে বিখ্যাত হওয়ার এ তো দারুণ হিড়িক পড়েছে দেখছি।”
কার ভেতর কিছু আছে আর কে অন্তঃসারশূন্য সেটা তার কথা বলা দেখেই ধারণা করা যায়। নিজের চেয়ে অন্যকে নিয়ে বেশি চর্চা প্রমাণ করে আসলে এসব মানুষদের নিজের বলে কিছুই নেই।
৫। লেখা শেষ করে নিচ্ছি। শেষে কিছু কথা।
হুমায়ূন লেখা শুরু করেছিলেন অশান্ত একটা সময়ে। দেশ তখন টালমাটাল। হাতে হাতে অস্ত্র। সাহিত্য তখন সামান্য কিছু এলিট শ্রেণীর মানুষদের ড্রয়িং রুমে আলোচনা আর টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বেডরুমে চর্চার বিষয়।
হুমায়ূন সাহিত্যকে আম জনতার কাতারে নিয়ে আসলেন। সাহিত্য ড্রয়িং রুম থেকে বাঁশের মাচায় আসল। বেডরুম থেকে চৌকিতে পৌঁছে গেল। পাঠকের বয়স নেমে যেতে শুরু করল। বই হয়ে উঠল কিশোর কিশোরী, বৃদ্ধ-মাঝবয়সি সবার।
এই কৃতিত্ব কেন আপনি হুমায়ূনকে দিতে চান না?
আপনি যদি ধারণা করে থাকেন হুমায়ূন পাঠকরা হুমায়ূন ছাড়া কিছুই পড়ে না সেটা আপনার মানসিক বিকারগ্রস্থতার ব্যাপার। বেশিরভাগ সমালোচকদের চেয়ে হুমায়ূন পাঠকরা অনেক বেশি বই পড়ে।
এই যে বর্তমান ইন্টারনেট যুগে অন্য সব কিছুর সাথে ফেসবুকে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে কি হুমায়ূনের কোন ভূমিকা নেই?
বাস্তব সত্য তিতা লাগুক আর যাই লাগুক, হুমায়ূন আহমেদ নামের একজনের জন্ম না হলে একবিংশ শতাব্দীর একটা সময় সাহিত্যে আরেকটা অন্ধকার যুগ নেমে আসত। একুশে বইমেলায় অলস লেখকরা চার জন চার জন করে বসে লুডু খেলত। ফেসবুকে কোন বইয়ের গ্রুপে দুই তিন হালি করে মানুষ থাকত।
হুমায়ূন আহমেদকে গুরু মেনে তাঁকে অনুকরণ করে লিখছে এমন কয়েকশ জন আছে। সমালোচকদের সমালোচনা মেনে নিয়েই বলছি এদের বেশিরভাগের লেখাই হয়তো সত্যিই বস্তাপচা। কিন্তু এদের মধ্যে কি কম হলেও দশ জন নেই যাদের লেখা পড়ার যোগ্য বা মানুষ পড়ছে? আপনি কি বিশ্বাস করেন না এই দশ জন থেকেই দুই তিন জন আগামী দিনে বাংলা সাহিত্যকে লিড করবে?
বিপরীতে যারা অতীতে হুমায়ূন আহমেদের সমালোচনা করে গেছেন আর বর্তমানে করছেন তাঁদের অর্জন একটু দেখতে চাই।
আপনি হুমায়ূনের প্রোডাক্ট দেখেন, বাই প্রোডাক্ট দেখার কি দরকার।
আর সবাই যদি লেখা বাদ দিয়ে সমালোচক হয়ে যেত তাহলে আজকে আর কারো বই পত্র পড়তে হত না। খালি সমালোচনা সাহিত্য পড়েই দিন কেটে যেত।
শুভ জন্মদিন সাহিত্যগুরু।
আপনার জন্ম না হলে হয়তবা জানাই হতো না সাহিত্য বলে একটা তৃতীয় জগত আছে। এখানে হাজারটা জীবন আছে, এখানে হাজার মানুষের কান্না আছে, সুখ আছে।
যে কান্না যে সুখ, যে আনন্দ বেদনা ছুঁয়ে যেতে পারে নিজেকেও। বইয়ের কয়েকটা কালির অক্ষর ভিজিয়ে দিতে পারে নিজের বালিশ, হাসিয়ে দিতে পারে নিজের অজান্তেই, শিহরিত করে দিতে পারে পুরো শরীর।
জাদুর মতো ব্যাপার না?
ওপারে ভালো থাকবেন জাদুকর।
লেখকঃ জয়নাল আবেদিন