ব্ল্যাকবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখাঃ ‘মে-শি-ন’
অর্ধচন্দ্রাকৃতি ক্লাসরুমে ঢোকার সাথে সাথে লেকচার শিট ধরিয়ে দেয়া হলো আমাদের। সিটে বসে গুঞ্জন থামানো পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন বোর্ডের সামনে বসা অধ্যাপক। চল্লিশের মতো বয়স, ধূসর চুলে জবজবে করে তেল মাখা, পরনে ঢলঢলে আকাশি রঙের শার্ট, পকেট থেকে উঁকি দিয়ে আছে তিনটা কলমের ক্যাপ… ঠিক যেন মেশিনগানের বেল্টে আটকানো বুলেট। সাথে আবার চকও আছে।
‘সবাইকে স্বাগতম। আমি প্রফেসর দুবে, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। তো… কলেজের প্রথম দিনে তোমাদের অনুভূতি কী?’ একঘেয়ে সুরে কথাগুলো বলল লোকটা।
কেউ কোন জবাব দিল না। সবাই লেকচার শিটের পাতা উল্টেপাল্টে দেখতে ব্যস্ত।
এই কোর্সটার নাম ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস, সংক্ষেপে ডাকা হয় ম্যান-প্রো। শিটের শুরুতেই কোর্সের কাঠামো অর্থাৎ উৎপাদনসংক্রান্ত ব্যাপারগুলো লেখা। সেই সাথে আছে সাধারণ বিষয়বস্তু যেমন যন্ত্রের গঠন, ঢালাই, স্থানান্তর, রুপান্তর ইত্যাদি। সব শেষে গ্রেডিং সিস্টেম।
মেজর: ৪০%
মাইনর: ২০%
প্র্যাকটিকাল: ২০%
অ্যাসাইনমেন্ট(৬-৮)সহ সারপ্রাইজ কুইজ(৩-৪): ২০%
আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করলেন প্রফেসর দুবে। ‘এসব পরে দেখবে। আপাতত বাদ দাও।’ বলে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগোলেন।
পকেট থেকে একটা চক বের করে বোর্ডের লেখাটার নিচে দাগ দিলেন তারপর… এক এক করে মোট ছ’বার।
‘মেশিন, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের অস্তিত্বের সর্বপ্রধান কারণ। এখন, কেউ একজন আমাকে বলো মেশিন কাকে বলে?’
পুরো ক্লাসে পিনপতন নীরবতা।
‘কেউ পারবে না?’ ছাত্রদের দুই সারির ফাঁক দিয়ে এগোতে এগোতে আবার জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর। মাথা নিচু করে রেখেছে সবাই, চায় না প্রফেসরের চোখে চোখ পড়ুক। চারপাশে তাকালাম আমি। আমাদের ব্যাচেই মোট আছে তিনশো জন। এই ক্লাসে সত্তরজনের মতো হবে।
‘তুমি বলো,’ অতিরিক্ত নড়াচড়ার জন্যই হোক, বা অন্য যে কারণেই হোক, আমাকেই প্রথম শিকার বানালেন প্রফেসর। সাথে সাথে মনে হলো যেন তালুর সাথে আটকে গেছে জিহ্বা, জমে গেছে শরীরের পেশী, বন্ধ হয়ে গেছে রক্ত চলাচল।
‘এই যে, আমি তোমাকেই বলছি,’ জোর দিলেন প্রফেসর।
‘জানি না,’ প্যাঁচার মতো মুখ করে কোনরকমে জবাব দিলাম।
‘আজব তো!’ বিস্ময় প্রকাশ করে আরেকজনের দিকে ফিরলেন তিনি এবার। ‘এই যে, চেক শার্ট। তুমি বলো।’
ব্যস্ত ভঙ্গিতে লেকচার তোলার ভঙ্গি করছিল ও ব্যাটা। মনোযোগী হাবভাবই কাল হলো আর কী! তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘স্যার… মেশিন… স্যার… একটা জিনিস… বড় বড় যন্ত্রপাতি… স্যার বিশাল বড় যন্ত্রপাতি…’
‘কী!’ প্রফেসর দুবের মুখের ভাব দেখে মনে হল যেন থুথু ফেলবেন ছেলেটার গায়ে। ‘দিন দিন রসাতলে যাচ্ছে আমাদের ভর্তি পদ্ধতি। আরও কঠোর হতে হবে বুঝলে।’ বলতে বলতে তেল চিটচিটে মাথা নাড়তে লাগলেন প্রফেসর।
‘হ্যাঁ, আরও কঠোর হতে হবে,’ পাশ থেকে বিড়বিড় করল রায়ান। ‘একশো জনে এক জন বেছে নেয়ার পরও কঠোর হয়নি আর কী!’
‘হিশশশশশ…’ চুপ করতে ইশারা করলেন প্রফেসর দুবে। ‘যাই হোক, মেশিনের সংজ্ঞা খুবই সহজ। মানুষের কষ্ট যা কমায়, তা ই মেশিন। দেখলে তো, তার মানে আশেপাশে উপকারী যা দেখি সবই হচ্ছে মেশিন।’
মানুষের কষ্ট কমায়… মনে মনে আউড়ালাম আমি। সহজ বলেই তো মনে হচ্ছে।
বলে চলেছেন প্রফেসর। ‘তো বিশাল বড় স্টিল কারখানা থেকে শুরু করে সাধারণ ঝাড়ু, কষ্ট কমানোর জন্য অগুনতি মেশিন আবিষ্কার করেছে মানুষ।’ সেই সাথে লক্ষ্য করলেন, এরকম সহজ একটা সংজ্ঞা দেয়াতে ক্লাসের সবাই সম্মানের চোখে দেখেছে তাকে।
‘এরোপ্লেন?’ সামনের সারির একজন বলল।
‘মেশিন,’ প্রফেসর জবাব দিলেন।
‘স্টেপলার?’ এবার আরেকজন।
‘মেশিন।’
মজার তো ব্যাপারটা। গাড়ি, ব্লেন্ডার, চামচ, ছুরি, চেয়ার-নানা ধরণের জিনিসের নাম নিতে লাগল ছাত্ররা। প্রফেসরের জবাব একটাইঃ মেশিন।
‘চারপাশে যা দেখছ, সব ভালবাসতে শুরু করো,’ প্রথমবারের মতো হাসি দেখা গেল প্রফেসরের মুখে। ‘তাহলেই মেশিনের জাদুকর হতে পারবে।’
গোমড়া মুখে হাসি ফুটতে দেখে আনন্দের হলকা ছড়িয়ে পড়ল গোটা ক্লাসে।
‘স্যার, ব্যায়ামাগারের যন্ত্রপাতির ব্যাপারে কী বলবেন? যেমন ধরুন, একটা বেঞ্চ প্রেস?’ রায়ান জানতে চাইল।
‘সমস্যা কোথায়?’
‘এগুলো তো মানুষের কষ্ট কমায় না। উল্টো বাড়ায়।’
আবারও নীরবতা নেমে এল।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি বোঝাতে চেয়েছি…’ কথার মাঝখানে থেমে গিয়ে রায়ানের দিকে তাকালেন প্রফেসর। বুঝতে চেষ্টা করলেন, ছেলেটা কী আসলেই তর্ক করতে চাইছে কি না।
সাহায্য করার ভঙ্গিতে আবার মুখ খুলল রায়ান। ‘সংজ্ঞাটা কি আসলেই এত সহজ?’
‘তোমার উদ্দেশ্যটা কী বলো তো,’ সামনে এগোলেন প্রফেসর। শক্ত হয়ে এসেছে চোখ-মুখ। ‘বলতে চাইছ আমি ভুল, তাই তো?’
‘না স্যার, আমি তো শুধু…’
‘চুপ করো, এটা আমার ক্লাস। এখানে আমি যা বলব শুধু তাই ঠিক।’ বলতে বলতে বোর্ডের সামনে ফিরে গেলেন প্রফেসর দুবে। ‘ঠিক আছে তবে… অনেক মজা হয়েছে। এবার ম্যান-প্রোর দিকে মন দেয়া যাক।’ মুছে ফেললেন বোর্ডের লেখাটুকু। ‘এই কোর্সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই মনোযোগী হও। ক্লাস মিস দেয়ার কথা ভুলেও ভেবো না। যথাসময়ে অ্যাসাইনমেন্ট সেরে রাখবে আর সদা প্রস্তুত থাকবে। যে কোন সময় সারপ্রাইজ কুইজ নাজিল হবে আকাশ থেকে।’
তারপর শুরু হলো লেকচার। বিষয়ঃ লোহা গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে বিভিন্ন আকৃতি প্রদান। থামল ঘণ্টাখানেক পর। ‘আজকের জন্য এটুকুই থাক। এখানে সুযোগ পাওয়ার জন্য আবারও অভিনন্দন। ডিপার্টমেন্ট হেড প্রফেসর চেরিয়ানের কথাগুলো সবসময় মনে রাখবে। গ্রেডই সব। ফলাফল ভালো হলে জীবন সুন্দর। আর গ্রেড খারাপ হলে কপালে কিছুই জুটবে না… না চাকরি, না অন্য কিছু। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই বলছি, পথ হারিও না। একবারের জন্যও না। আফসোস করতে হবে।’
কথাটা শোনার সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম আমরা সবাই। ডাস্টার দিয়ে টেবিলে বাড়ি মারলেন প্রফেসর। সাথে সাথে চারপাশে চকের গুঁড়োর একটা বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ল যেন। তারই আড়ালে গটগট করে হেঁটে তিনি হারিয়ে গেলেন বাইরে।
ফাইভ পয়েন্ট সামওয়ান
আসছে… নভেম্বরের মাঝামাঝি।
অনুবাদকঃ আদনান আহমেদ রিজন