ধরুন, আপনি ঘুরতে ভালোবাসেন। দেখিতে গিয়াছেন পর্বতমালা, দেখিতে গিয়াছেন সিন্ধু। তো, এসব নদী-পাহাড়-সাগর পাড়ি দেবার ফাঁকে ফাঁকে আপনার সামনে লোভনীয় সব খাবার এমনভাবে সার্ভ করা হচ্ছে যে ভ্রমণের আনন্দ এবং রসনার তৃপ্তি দুটোই পাচ্ছেন। কি ভাবছেন? এমন ভ্রমণই তো চাই, তাইতো? কিন্তু ভ্রমণ যদি এমন হয় যে ঘুরে তেমন দেখা হলোনা কিছু, আসা যাওয়া নাম কা ওয়াস্তে, ঐ খাবার খাওয়াটাই হয়ে দাঁড়াল মূখ্য উদ্দেশ্য। তখন কেমন হবে ব্যাপারটা,বলুনতো? আগেই বলেছি, খাবার সুস্বাদু। সুতরাং খেতে বসে আফসোস হবেনা ঠিকই, কিন্তু ভ্রমণের মন ভরিয়ে দেবার আনন্দটুকু পূর্ণ হবেনা।
ভাবছেন, বইয়ের গ্রুপে হঠাৎ করে ভ্রমণ আর খাবার দাবার নিয়ে আলাপ জুড়ে বসলাম কেনো? ভড়কাবেন না। ব্যাপারটা খোলাসা করেই বলি তাহলে। একজন লেখক তার লেখার মাধ্যমে পাঠককে হারিয়ে যেতে সাহায্য করেন তার কল্পনার রাজ্যে। লেখকের কলমে ভর করে চার দেয়ালের মাঝে বসে থেকেও আমরা দেখে আসি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, ঘুরে আসি অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে মহাবিশ্বের অপরপ্রান্তে। আর আমাদের এইসব যাত্রায় আহারের প্রয়োজন মেটায় লেখকের পরিবেশন করা নিরেট তথ্যাদি। লেখকের লেখনী যত মজবুত, তার লেখায় ডুবে যেতে আয়েশও ততোটাই। কিন্তু কাহিনী বিন্যাস এবং নিরেট তথ্যের পরিবেশনায় সামঞ্জস্য থাকা চাই। নইলে, কলা বেচা হবে ঠিকই, রথের দেখা আর পাওয়া যাবেনা।
বলছিলাম, মুহম্মদ আলমগীর তৈমূর স্যারের ‘বংশালের বনলতা’ বইটার কথা। মোট ছয়টা গল্প নিয়ে সাজানো সংকলনের অধিকাংশ গল্পেই উপরের কথাগুলো খাটে। প্রায় প্রতিটা গল্পে ঘটনা প্রবাহ গুরুত্ব পায়নি বললেই চলে। বরং একটা ঘটনা ঘটতে শুরু হবার পর হঠাৎ থেমে গিয়ে তথ্যের আগমন, এবং তথ্য পরিবেশন শেষ হবার পরপরই গল্পের সমাপ্তি। তবে হ্যাঁ, তথ্যপ্রাণ গল্পগুলোতে যেভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা, গুপ্ত সংঘ কিংবা প্রাচীণ দেব-দেবী সম্পর্কে বলা হয়েছে, সেটা যাকে বলে একেবারে টপ নচ। লেখকের বলার ধরণটাই এমন যে অতীতের কোনো কিছুর বর্ণনা যখন একবার শুরু হয়ে যায় তখন আর ছাড়া যায়না, পুরোটা শেষ করে তবেই স্বস্তি। এর চাইতে ঘটনাপ্রবাহ বা কাহিনীর প্রেক্ষাপট যেটাই বলি, সেই অংশটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দূর্বল। অনেকক্ষেত্রে লেখক অযাচিত কালক্ষেপন করেছেন বলেও মনে হয়েছে। প্রত্যেকটা গল্পেরই আলাদা করে পাঠ-প্রতিক্রিয়া দিয়ে দিলাম। সেই সাথে এটাও বলে নিচ্ছি, অন্তত দুটো গল্প থেকে দূর্দান্ত উপন্যাস লেখা যেতো, গল্প আকারে পড়তে হলো বলে দু:খই হচ্ছে।
১. বংশালের বনলতা: পুরান ঢাকার এক ব্যাচেলর চাকুরিজীবী অনেকটা দৈবক্রমে একটা নারীমূর্তির সন্ধান পেয়ে যায়। মৃর্তিটা দেবী লিলিথের। প্রাচীন কাবালিস্টদের মতে, এই লিলিথই ছিলেন প্রথম সৃষ্ট নারী। মূর্তিটা পাবার পর থেকেই বন্যার তোড়ের মতোন শুরু হয় তার ভাগ্যপরিবর্তন। কিন্তু কথায় বলে না, সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। শেষটা ভালো হবে তো?
গল্পটা প্রথম পড়ি বছর দুয়েক আগে। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মতো যে ক’টা লেখা পড়েছি, তারমধ্যে এইটা একটা। গল্পটা পড়ার পর প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে অবসেসড হয়ে পড়েছিলাম রীতিমতো, সেই অবসেশন আজও কাটেনি। তবে গল্পের মানের বিচারে খুব ভালো বলবোনা।
২. অসীম আচার্য্যের অন্তর্ধান: সদ্য কেনা প্রাচীন এক জমিদার বাড়িতে ঢুকে হারিয়ে গেলেন এক স্কুল শিক্ষক। কি এক রহস্য আছে বাড়িটা ঘিরে! কিন্তু কি সেটা? পুকুর থেকে উঠে আসা ষাড়ের মাথাওয়ালা যকের গল্পটা কি সত্যি? তবে কি দেবতা মার-এর প্রভাব এখনো আছে সে বাড়িতে?
সংকলনের সবচেয়ে দূর্বল গল্প। কলেবরের তুলনায় সন্তুষ্ট করতে পারেনি। লেখনীও অন্যন্য গল্পের তুলনায় কাঁচা।
৩. কালো পাথর: আসামের গহীন অরণ্যে কালো পাথরের অবস্থান। পাথরটাকে কারা ওখানে এনেছিলো, কি ছিল তাদের উদ্দেশ্য তা নিয়ে মতভেদ আছে বিস্তর। বন্ধুর আত্নহত্যার রহস্যভেদ করতে গিয়ে লেখক গিয়ে পৌছালেন কালো পাথরের পাদদেশে। লেখক কি তবে নরকের দেবতা আহুরার দর্শন পাবেন এবার? অস্ট্রিক যে উপজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন ইউসুফ ক্বররানি, তারাই কি আবার অতীত থেকে হাজির হবে বাস্তবতা হয়ে?
আমার মতে সংকলনের সেরা গল্প। জাস্ট দূর্দান্ত। উপন্যাস হতে পারতো।
৪. বজ্রযোগীর প্রত্যাবর্তন: অদ্ভুত এক লোকের সাথে দেখা হয়ে গেলো লেখকের। লোকটা শোনালো অদ্ভুত এক গল্প।।সে গল্পে আছেন তান্ত্রিক রাজা অংশুদেও, আছেন বৈশালী রাজ্যের সবথেকে শক্তিশালী তান্ত্রিক চিত্রকূট, আছে এক অদ্ভুত এক তন্ত্র সাধনার কথা।
মোটের উপর ভালোই। খারাপ লাগেনি।
৫. ইব্রাহীম কাদরির মৃত্যু: প্রাচীন মিশরের সবথেকে ভয়ংকর দেবতা এপোফিস ঘিরে গড়ে ওঠা কাল্টের সাথে জড়িয়ে গেছেন ইব্রাহীম কাদরি। ভারতবর্ষে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের শুরুর দিকের একটা ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে এই দেবতার মন্দিরের হদিস, তাও বাংলাদেশে। লেখক ইব্রাহীম কাদরিকে বাতলে দিলেন সেই মন্দিরে যাবার পথ। তারপর?
নি:সন্দেহে এই গল্পটা উপন্যাস হবার দাবি করে। এতো আকর্ষণীয় একটা প্লট গল্পে আটকে রাখাটাই অন্যায়। কাহিনীর পাশাপাশি ছোট ছোট হিউমারগুলোও উপভোগ করেছি বেশ।
৬. হাকিনী: বাবাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়ে দেয়ার প্রতিশোধ নিতে এক ছেলে বদ্ধপরিকর। পেয়েও গেলো অব্যর্থ অস্ত্র। নিম্নশ্রেণীর একধরনের পিশাচের মাধ্যমে কার্য সমাধা করবে সে। এই পিশাচকে ডেকে এনেছিলো লক্ষণ সেন, বখতিয়ার খিলজিকে বধ করার উদ্দেশ্যে।
এই গল্পটাও আগেই পড়া ছিলো। মোটামুটি ভালোই।
সবশেষে বলবো, সুপার ন্যাচারাল হরর ধাঁচের গল্প যাদের ভালো লাগে তাদের জন্য বেশ ভালো একটা সময় কাটবে। সেই সাথে প্রাচীন মিথগুলো উপরি পাওনা। সবমিলিয়ে সংগ্রহে রাখার মতোন একটা সংকলন।
পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ বর্ষণ হাসান অয়ন