বই পরিচিতিঃ আমি মৃণালিনী নই

0
আমি মৃণালিনী নই

বই পরিচিতিঃ আমি মৃণালিনী নই
লেখকঃ হরিশংকর জলদাস
আমি মৃণালিনী নই
‘কবিগুরু, ‘বিশ্বকবি’, ‘গুরুদেব’ সহ নানান শ্রদ্ধাবনত সম্ভাষণে অভিষিক্ত বাংলা সাহিত্যের গর্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমাদের অহংকার আর বিশ্ব সাহিত্যের অলংকার এই প্রবাদপুরুষ নিয়ে অপরাপর মনিষীদের উক্তি এরকম – “বাংলা সাহিত্যের চৌকাঠে আড়াআড়ি হয়ে অবস্থান করছেন রবী ঠাকুর, তাকে ডিঙ্গিয়ে যাবার কোন সাধ্য রাখেননি তিনি আর কারও জন্য!” এবং আমরাও মানি সশ্রদ্ধ চিত্তে সে কথা।
কিন্তু সারা বিশ্বের চোখে এরূপ তাপসসুলভ ব্যক্তিত্ব কি তাঁর ব্যক্তি এবং সংসারজীবনেও অনুরুপ ছিলেন? কোন বৈপরীত্য ছিল কি তাঁর লেখনীর বিশ্বাসে আর পালনকৃত সংসার কার্যে? যেমন বন্দনীয় ছিলেন বাকিদের কাছে, তদ্রুপ কি ছিলেন তাঁর নিজ সংসারেও?

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর! মহান যা ঋষি – মহর্ষি। কিন্তু সে ঋষিসুলভ কার্যকলাপ কি তাঁর পরিবারেও ছিল? জোড়াসাঁকোর যে ঠাকুর পরিবার সুশিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিল, সে ঠাকুর পরিবারেই কি সব চালচলন শিক্ষণীয় ছিল? লম্বা হাতা ব্লাউজ সহ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যমিশেলে যে ফ্যাশন চালু করেছিল ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা যা তখন এবং এমনকি এখনও সমাদৃত, তাঁদের নিজ পরিবারেই কি তাঁদের চলাফেরা বা পোশাকআশাক আদৃত ছিল? নারীপুরুষের মেলামেশায় সংস্কৃতির চর্চা যা তাঁরা চালু করেছিলেন, সে মেলামেশা কি তাঁদের নিজেদের সবার কাছেই গ্রহনযোগ্য ছিল?

এরকম অনেক অনেক বিচিত্রতা এবং বৈপরীত্যের আখ্যান, কবিগুরুকে নিয়ে তাঁর স্ত্রী ভবতারিণীর ব্যক্তিগত অনুভূতির এক আশ্চর্য কাহিনি “আমি মৃণালিনী নই”।

বইয়ের নামকরণের মাঝেই আছে এক বিদ্রোহের সুর যা শুরুতেই পাঠককে ধারণা করিয়ে দেয় এক ভিন্নতার। ভবতারিণী মাত্র নয় বছর নয় মাস বয়সে রবি ঠাকুরের বাইশ বছর সাত মাসের জীবনে আগমন করেন। কন্দর্পকান্তি তরুণ জমিদারনন্দন রবি রূপে-গুণে-জ্ঞানে-বংশগরিমায় বিশাল ব্যবধানে শ্রেয়; আর এ তথ্য এবং অনুভূতি ভবতারিণীর কানে ও মনে গেঁথে দেয়া হয়েছিল তার বাবার বাড়ি থেকেই। সারাজীবনেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি তিনি। আর তাই বাসর রাতেই ভবতারিণীর নাম যখন ঘুচে গেল স্বামীর কাছ থেকে, হয়ে গেলেন তিনি – মৃণালিনী, মেনে নিয়েছিলেন নত মস্তকে!

কিন্তু মস্তক নত হলেও, মন নত হয় না সহজে। তাই বালিকা বধূর মনে আসা প্রশ্ন, তরুণী বধূর চোখে ধরা পড়া অসঙ্গতি, আর অভিজ্ঞ সংসারী নারীর বোধে আসা অনুভূতিগুলোই বিদ্রোহ করেছে নিজের অজান্তেই। অবশেষে এ যেন তাঁর এক টানে সব ছুঁড়ে ফেলার চিৎকার – আমি মৃণালিনী নই!!

সকাম এবং নিষ্কাম রবীন্দ্রনাথ, অর্থহিসেবী রবীন্দ্রনাথ, কন্যাদায়গ্রস্ত রবীন্দ্রনাথ, গৃহী রবীন্দ্রনাথ- এরকম ভিন্ন ভিন্ন অনেক রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথকে আমাদের মত সাধারন মানুষ পাওয়া যায় এ কাহিনির প্রতিটি বুননে ।

হরিশংকর জলদাসের চুম্বক লেখনীতে আর মৃণালিনীর জবানীতে এ উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে জোর ঝাঁকুনি দেয়ার মত, আলোচনার টেবিলে ঝড় তোলার মত। যদিও বৌদির সাথে রবির সম্পর্কের ধরনটা ঠিক কেমন ছিল সে কথা এখনো প্রমাণিত কিংবা অবিসংবাদিত নয়, কলকাতার রঞ্জন থেকে শুরু করে অনেকেই এটিকে পুঁজি করে প্রায় চটিসাহিত্যই রচনা করে ফেলেছেন বলা যায়! হরিশংকরও সে দিকে চোখ রেখেছেন বলেই মনে হল। আর তাই সম্পর্কটিকে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ করলেও শালীনতার সীমা অতিক্রম করেননি।

সব মিলিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ৩০০ টাকা মূল্যের এ বইটি সংগ্রহ এবং আলোচনার দাবী রাখা একটি বই।

বই পরিচিতিটি লিখেছেনঃ সাকু চৌধুরী

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে