তৃতীয়দিন ঊষালগ্নেই দুজনে বের হলাম সোমেশ্বরী নদীতে সূর্যোদয় দেখবো বলে। বিধিবাম, ভোরে জাওবা কুয়াশা ছিল, ক্রমেই তা বাড়তে লাগলো। বুঝলাম আজকে আর সূর্যোদয় দেখা হবে না। বরফ শীতল পানিতেই এক চাচাকে ১০০ টাকা দিয়ে আধাঘণ্টা সোমেশ্বরীতে ডিঙ্গি চালালাম। অতঃপর সকালের নাস্তা খেয়ে বাংলোতে ফিরে সবকিছু গোছগাছ করে নেত্রকোনা থেকে বিদায়ের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আগেই বাংলোর চাচা এবং কিছু মানুষের সাথে কথা বলে ধারণা নিয়েছিলাম কিভাবে তাহিরপুর যাওয়া লাগবে। আশংকার ব্যাপার হলো কেউই পর্যাপ্ত নির্দেশনা দিতে পারেনি। সত্য বলছি। সবাই বলেছে আপনি কলমাকান্দা জান। সেখান থেকে মধ্যনগর বাজার। সেখান থেকে উপায় আছে। কিন্তু এর বেশি কেউ কিছু বলতে পারেনি। দেখা যাক কতদূর যেতে পারি, এই ভেবে কলমাকান্দার উদ্দেশ্যে বের হলাম। উল্লেখ্য, কলমাকান্দার আগের বাজার বা স্টপেজের নাম নাজিরপুর। এলাকাভিত্তিক গ্যাঞ্জামের কারনে সরাসরি কলমাকান্দার গাড়ি বন্ধ। তাই প্রথমে নাজিরপুর হয়ে কলমাকান্দা যেতে হবে।
দূর্গাপুর বাজারের পাশেই ইজি বাইক পাওয়া যায়, এবং মোটর বাইক পাওয়া যায়। মোটর বাইকে সরাসরি কলমাকান্দা যাওয়া যায়। দুজনে ৩০০-৪০০ টাকা। আমরা ইজি বাইকে উঠলাম নাজিরপুরের উদ্দেশ্যে। ২০ মিনিট দেরি করলো যাত্রী গোছানোতে। জনপ্রতি ২৫ টাকা করে ভাড়া। আধা ঘণ্টা পর নাজিরপুরের আধা কিলো আগে নামিয়ে দিলো, যেখানে কলমাকান্দার সিএঞ্জি পাওয়া যায়। এখানেও সিএঞ্জি প্রায় ৪০ মিনিট দেরি করে ছাড়লো। জনপ্রতি ৪০ টাকা করে প্রায় এক ঘনটা পর আমরা কলমাকান্দা বাজারে এসে পৌঁছলাম। মাঝপথে সিএঞ্জিওয়ালা মামাকে জিজ্ঞেস করলাম কলমাকান্দা থেকে মধ্যনগর যাবার উপায় কি। উনি বললেন নৌকা যায় সেখান থেকে। আর বাইক যায়। বুঝলাম, এই এলাকায় ডিফল্ট পরিবহনই বাইক। সিদ্ধান্ত নিলাম নৌকায় উঠবো। ততক্ষণে দুপুর ১২ টা বেজে গেছে। এক ঘণ্টা পর দুপুর ১ টায় নৌকা ছাড়লো, গুনাই নদী এটা। জিজ্ঞেস করে জানলাম নৌকা পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা লাগবে। এই নৌকার দেরি হবার কারণ তারা মাঝপথে বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী নামায়। তদুপরি গুনাই নদীর দুই পাশ, জনপদ-লোকালয়, মানুষের চলাফেরা, মাছ ধরা, পরিবেশ মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে দেখলাম। আসলেই এতটা সুন্দর যা না দেখলে বোঝা যাবে না।
বিকেল ৩ টা নাগাদ মধ্যনগর বাজারঘাট এসে পৌঁছলাম। এবার সত্যিই ঝামেলা। ভেবেছিলাম এখান থেকে অটো বা সিএঞ্জি চলবে। কিন্তু এখান থেকে বাইকই একমাত্র সহজ পরিবহন। এছাড়া ১০ টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে নাকি পাশের এলাকায় গিয়ে সেখান থেকে সিএঞ্জি পাওয়া যায়, কিন্তু এলাকার লোকেরাই আমাকে সঠিকভাবে বলতে পারলোনা। উপায়ন্তর না দেখে এবার বাইকই নিলাম বাধ্য হয়ে। ৩০০ টাকা। বাইক চলছে। বিকেলের আলোও হেলে পড়েছে পশ্চিমে। চারপাশটা এত সুন্দর রঙ্গিন আভায় মেতে উঠছে যে দুই চোখকে বিশ্বাস করা কঠিন। সুনামগঞ্জ গেলে এই পথে অবশ্যই আপনাকে বাইকে চড়ে পারি দেওয়া উচিৎ। দেড় ঘণ্টায় তাহিরপুর চলে আসলাম। Hotel Tangua Inn এ সব রুম বুকড, আগেই ফোন দিয়েছিলাম যদিও। একটাই ছিল, তাও বাথরুম এটাচ না। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। নিতান্তই বাধ্য হয়ে রাজি হতে হলো, কেননা আর কোণ হোটেল নেই যেখানে বউ সহ নিরাপদে থাকা যাবে। এলাকার লোকেরা এই কথা বলল আমাকে। এদিকে এক উটকো ঝামেলা জুটল কপালে, এক লোক পিছে পিছে ঘুরছে নৌকা ভাড়া দেবার জন্য। মানে পারতেছেনা পায় ধরবে। রুমে যেতে দেয় না, সে নৌকার হাল হকিকত বুঝায় আমাকে। কি আজব! ভাই ভেবে ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। ব্যাটা রাতেও ফোন দিয়েছে আমাকে দুইবার।
দিন শেষ হলো। পরদিন ভোরে এক মজার জিনিস খেয়াল করলাম। আগেরদিন নেত্রকোনায় মারাত্মক কুয়াশার অভিজ্ঞতায় আজকে আমি চাইনি ঘুম থেকে উঠতে। আমার ওয়াইফ ডেকে বলে, বাইরে একদম পরিষ্কার। বিন্দুমাত্র কুয়াশা নেই। অথচ তখনও সূর্যই উঠেনি। আসলেই তো! একদম কুয়াশা নেই। এ কেমন কথা? তড়িঘড়ি করে বের হয়ে হোটেল এর পিছনেই শনির হাওড়ের মধ্য দিয়ে বানানো রাস্তা ধরে প্রায় আধা কিলো ভেতরে হেঁটে গেলাম। সূর্যের লাল আভা ততক্ষণে চারদিকে ছড়িয়েছে। কিছুক্ষণ পর দেখি রক্তমাখা সূর্য উকি দিচ্ছে। কি অদ্ভুত অনুভূতি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এক বিন্দুমাত্র কুয়াশা নেই। অথচ ঠাণ্ডা ভালই। সূর্যোদয় দেখলাম। কক্সবাজারের পর দেখা আমার সবচেয়ে সুন্দর সূর্যোদয়।
বেশি বড় না করি। তাহিরপুর গেলে নৌকার মাঝিরা আপনার মাথা খাবে। সবাইকে ডিরেক্ট না করে দিন। বলবেন আপনি ঘাটে গিয়ে নৌকা দেখে দামাদামি করবেন। খাবার হোটেল এর রেকমেন্ডেশনে এক ট্যুরিস্ট গাইড মাঝি চাচার নৌকা ভাড়া করেছিলাম ১২০০ টাকায়। সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, খুব স্বাভাবিক ভাবেই স্বামী-স্ত্রী দুইজনে মিলে হাওড় ভ্রমণ বিপজ্জনক ভাবাটা অসম্ভব নয়। আমার কাছেও তাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু মাঝি চাচা, রেস্টুরেন্ট মালিক ও ছেলেটার আশ্বাস এবং সর্বোপরি আমাদের অভিজ্ঞতায় সেই ভয় ডর কেটে গিয়েছে। দুইজনে নৌকায় রাত কাটানর প্ল্যান না রাখাই ভালো। কিন্তু নিশ্চিন্তে আপনি সারাদিন ঘুরে বেড়াতে পারবেন হাওড় জুড়ে।
প্রথমে আমরা টেঁকেরঘাট যাই। সেখান থেকে উনিই ৩০০ টাকায় বাইক ঠিক করে দেন। সেটা নিয়ে শিমুল বাগান, বারিক্কাটিলা, জাদুকাটা নদী হয়ে নিলাদ্রী, লাকমা ছড়া ঘুরে দেখি। দুপুর হয়ে যাওয়াতে বাইকার ভাই এক বাংলা হোটেল এ খাবারের জন্য থামায়। হারামি হোটেল আলুভর্তা, ডাল, লাল শাক এবং ভাগের জন্য বিল করে ১৩০ টাকা। খুব মেজাজ খারাপ হইছিলো। কি আর করার। আপনারা এই হারামি হোটেল থেকে দূরে থাকবেন। ছবি দিয়েছি।
আবার টেঁকেরঘাট থেকে ওয়াচ টাওয়ার হয়ে তাহিরপুর ব্যাক করি নৌকায়। ফিরতে ফিরতে ৭ টা বেজে যায়। মাঝি চাচা অসম্ভব ভালো ছিলেন। উনি নিজ থেকে কোথায় কি আছে, যাবতীয় ইনফরমেশন, অমুক এলাকার নাম কি, অমুক গাছে বড় পাখি ইত্যাদি সব বলে দিচ্ছিলেন। উনার ট্যুরিস্ট গাইড কার্ড দেখালেন।
তাহিরপুর থেকে সিএঞ্জিতে সুনামগঞ্জ সদরে আসি রাত ৯ টায়। মারাত্মক বাজে রাস্তা ছিল এইটা। সিএঞ্জির রোলার কোস্টারে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। অতঃপর হানিফের কাউন্টারে গিয়ে টিকেট নিলাম দুইটা ৫৫০ করে। ভোরে ঢাকা নামলাম।
এক নজরে দূর্গাপুর থেকে তাহিরপুর এবং হাওড় ভ্রমণের খরচঃ
দূর্গাপুর-নাজিরপুর ২৫ টাকা অটো জনপ্রতি
নাজিরপুর – কলমাকান্দা ৪০ টাকা সিএঞ্জি জনপ্রতি
কলমাকান্দা – মধ্যনগর বাজার ৪৫ টাকা নৌকা জনপ্রতি
মধ্যনগর – তাহিরপুর ৩০০ টাকা বাইকে দুইজন।
হাওড়ে নৌকা ভাড়া ১২০০ টাকা
টেঁকেরঘাটে বাইক ভাড়া ৩০০ স্পট দেখানোর জন্য
তাহিরপুর – সুনামগঞ্জ ১০০ টাকা সিএঞ্জি জনপ্রতি
সুনামগঞ্জ – ঢাকা হানিফ ৫৫০ টাকা জনপ্রতি।
থাকাঃ Hotel Tangua Inn ভালমানের একটি হোটেল। যুবক বিবাহিতরা কাবিনের কাগজ ছাড়া গেলে কিন্তু ওড়া রুম দিবে না। ওদের রুম ভাড়া এসি ১০০০, নন এসি ৪০০ করে। এর বাইরে আপনি নৌকায় থাকতে পারেন। হাওড়ের মাঝে অবস্থিত হাওড় বিলাস কটেজে থাকতে পারেন। ভাড়া জানা নেই।
খাওয়াঃ Tangua Inn এর নিচতলাতেই Tangua Hotel আছে। খুবই ভালো মানের খাবার ওদের, পরিবেশন ভালো। দামও রিজনেবল। গলাকাটার ফন্দি নেই ওদের। হোটেল বয় ছেলেটা খুব ভালো ছিল। হাসান তার নাম। আমাকে সেই নৌকা ভাড়া করে দিয়েছিলো।
একটা ব্যাপার, তাহিরপুর থেকে সুনামগঞ্জে যাতায়াতের জন্য সিএঞ্জির বদলে বাইকই আরামদায়ক হবে। এত বাজে রাস্তায় পেটের নাড়িভুঁড়ি নষ্ট করার মানে হয় না রোলার কোস্টারে উঠে।
নেত্রকোনার মতই সুনামগঞ্জের মানুষের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। আপনাকে হেল্প করতে না পারলে এমন গোবেচারা চেহারা করবে যেন সে নিজেই অপরাধ করেছে আপনাকে হেল্প করতে পারেনি বলে। 🙂
পরিশেষেঃ খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল কিংবা প্লাস্টিক দ্রব্য যেখানে সেখানে ফেলবেন না। মাঝি চাচা এতটাই সচেতন, আমরা চিপস নিয়ে উঠেছিলাম নৌকায়। খাওয়া শুরু করার আগেই উনি বলতেছিলেন, মামা চিপসের প্যাকেট কিন্তু পানিতে ফেইলেন না। বললাম ঠিক আছে মামা, ফেলবো না 🙂
লেখকঃ Masum Rana