বইয়ের নাম: মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম
লেখক: পিনাকী ভট্টাচার্য
প্রকাশনী: গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস
এক.
বেশ কয়েকদিন সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বইটি পড়া শেষ করলাম। প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে লেখা একটি সাহসী সঞ্চালনা মনে হল। তথ্য উপাত্তের সন্নিবেশন, রেফারেন্স প্রয়োগে মুন্সিয়ানা আর সংক্ষেপে সুবিশাল ও সুগভীর মেসেজ পৌছানোর প্রয়াস লক্ষণীয়। ‘পরিশিষ্ট’ সংযোজনায় পূর্ণতার মাত্রা বাড়ার পাশাপাশি মূল বিষয়টি আরও খোলাসা হয়েছে।
দুই.
‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম’ বইটি হাতে পাওয়ার পর প্রথমত: দুটো বিষয়ে খটকা লাগে:
১. নামকরণে ‘বয়ান’ শব্দের ব্যবহার। ‘চিন্তার কন্সট্রাকশন’ বা ‘চিন্তা কাঠামো’ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে বলা হলেও ‘বয়ান’ শব্দটি বাংলা ভাষাভাষীদের নিকট খুব একটা পরিচিত বা প্রচলিত শব্দ নয়; সর্বজনগ্রাহ্য বা ব্যবহার্য্য শব্দও নয় এটি। আর এজন্যই হয়তো ‘বয়ান’ শব্দটির প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভূমিকা থেকে পরিশিষ্ট সব জায়গায় এটা প্রয়োজনের চেয়ে অধিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে।
২. বইটির প্রচ্ছদে আরবী ক্যালিওগ্রাফিতে তাওহীদের ডিক্লারেশন সুরা ইখলাসের ব্যবহার। ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধ, লেখক মিস্টার ভট্টাচার্য আর প্রচ্ছদে ইখলাছ- কম্বিনেশনটা একটু খাপছাড়া গোছের। ছিচল্লিশ বছরের ক্রমাগত প্রচারণায় মুক্তিযুদ্ধের সংগে ইসলামের দূরেত্বর পর্দাযুক্ত মানসিকতায় আমরা যারা পুষ্ট, এহেন অবয়বে বইটিকে দেখে ধর্মীয় বই ভেবে এটা নাও গ্রহণ করতে পারি বৈকি!
তিন.
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের কার্যকলাপ, ঘোষণা পত্র ও নীতি নির্ধারণী দলিল- সবকিছুতে ইসলামের প্রাসঙ্গিক উপস্থিতি লক্ষ্য করার মত। সংগত কারণে ইসলামের সরব উপস্থিতি এবং ‘লেবেল সর্বস্ব ইসলাম’ পরিহারের একাগ্রতায় ধর্মনিরপক্ষেতার অনুপ্রবেশ কিংবা উপস্থিতির কোন সুযোগই যে ছিল না, এটা ঐতিহাসিক সত্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচন-পূর্ব বঙ্গবন্ধুর মন্তব্য একথারই স্বাক্ষ্য বহন করে।
চার.
পাকিস্তানীদের জুলুম শোষণকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা ‘ইনশাআল্লাহ’ দিয়ে শুরু হয়ে ‘আল্লাহর সাহায্য কামনা’ করে শেষ করা হয়েছে। ইসলামি দলগুলির অধিকাংশ এবং আলেম সমাজের উল্খেযোগ্য অংশ মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করা মুক্তিযুদ্ধ নির্মাণের প্রক্রিয়ায় ইসলাম ও ইসলাম পন্থী দের সুডৌল অবয়বের উপস্থিতি জানান দেয়।সেই সময়ের আলেম সমাজকে ছয় ধারায় নির্মোহ বিশ্লেষণ সত্যিই ব্যতিক্রমী বিষয়। আর এ ছয় ধারার আলেম সমাজের মধ্যে ইসলাম পন্থী দল জামায়াতে ইসলামি ও নেজামে ইসলামির বাইরের এক বিশাল অংশের মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এবং বীরত্ব পূর্ণ ভূমিকা রাখায় খেতাব প্রাপ্তির অজানা তথ্য এ প্রজন্মকে সত্যিই বিস্মিত করে! মরহুম হাফেজ্জী হুজুর, শায়খুল হাদীস, মাও. আব্দুস সালাম, মুফতি মাহমুদ, আসআদ মাদানী প্রমুখের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় অবস্থান আমাদের ইতিহাস-পাঠের নতুন দিগন্ত উদ্বোধন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী উপমহাদেশের আলেম সমাজের অবস্থান ও উপলব্ধি শিরোনামে মাও. আসআদ মাদানী ও বিচারপতি মুফতি তকী উসমানীর উদৃতি এক্ষেত্রে সত্যিই প্রাসঙ্গিক।মাওলানা ভাসানীর জীবন-কর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ যে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ- সেটাও প্রমাণিত হয়েছে স্পষ্টতই।
পাঁচ.
ইসলামি চিহ্ন ও পরিভাষা ব্যবহারের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর অবলিলায় পারংগমতা, অস্থায়ী সরকারের ঘোষণা ও নির্দেশনাবলীতে ইসলাম, জিহাদ, শাহাদাত প্রভৃতি টার্মের সহজাত ব্যবহার উল্লেখ্য। এছাড়া গায়েবানা জানাযা, কোরআন পাঠ,শহীদদের জন্য প্রার্থনা, বিজিত অন্ঞলে মসজিদ স্থাপন ও ইমাম নিয়োগ-এ সবকিছু যুদ্ধ ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিপালন নির্দেশনা যোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল-এই অমোঘ সত্য অলোচ্য বইয়ের মাধ্যমেই জানা গেল। রণাঙ্গনের মুক্তি যোদ্ধাদের চিঠিপত্রে ইসলামি ভাব-প্রভাব এর মহামূল্যবান উদাহরণ। স্বাধীন বাংলা বেতার, যুদ্ধ কালীন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় ইসলাম প্রসংগ এসেছে সংগত ও সাবলীলভাবে।
ছয়.
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা কারীদের বুঝাতে ইসলামের প্রতীক ও চিহ্নের বিকৃত উপস্থাপন যে খুবই পরিকল্পিত ভাবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে করা হয়েছে, এই মনোভাবের সাথে যে যুদ্ধ কালীন বাস্তবতার মিল নেই, তা প্রমানে লেখকের অসামান্য ব্যাকুলতা পরিলক্ষিত হয়। সুদীর্ঘ গবেষণার সারাংশটা ঠিক এরকম:
“কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দের ইসলামি লেবাসে উপস্থাপনের এই কাজটা করেছে ববাংলাদেশের সেকুলারপন্থি ইসলাম বিদ্বেষিরা।
তারা মনে করে কেবল পাকিস্তানের সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শাসকের বিরুদ্ধে নয় অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার কলোনি তুল্য সম্পর্কের বিরুদ্ধেই শুধু নয়- মুক্তি যুদ্ধের লড়াইটা বুঝিবা একই সাথে ইইসলামের বিরুদ্ধে ও হয়েছিল।”
আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী এই ধর্মনিরপক্ষেতার বিরাজ ও বিস্তার যে প্রতিবেশী ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা ও স্বীকৃতির ফলশ্রুতি-এটাও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
সমাপন:
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি ঐতিহ্যের কপালে বাম ও সেকুলারিস্টদের উন্মাদ-প্রয়াসে এন্টি-ইসলামের বলিরেখাগুলি সত্যিই দৃষ্টি কটু ও নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক।মুক্তি যুদ্ধই যেহেতু পুরো জাতিকে এক প্লাটফর্মএ আনতে পেরেছিল এবং ভবিষ্যতে ও পারবে বলে বিশ্বাস,তাই কৃত্তিম ও অপ্রাসঙ্গিক ধর্মনিরপক্ষেতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে পিনাকী ভট্টাচার্য খুবই সফল হয়েছেন-একথা নির্দিধায় বলা যায়।তবে জাতী হিসাবে আমরা অনুভূতিপ্রবণ,যুক্তিপ্রবণ, না গড্ডালিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া অনুভূতি শুন্য- সেটার উপর নির্ভর করবে বইটির গ্রহণযোগ্যতা আর সফলতা।
পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ S.M.MAHMUD HASAN CDCS, CAMS