বইঃ মোগল হেরেমের অন্তরালে
লেখকঃ আনিস সিদ্দিকী
শতচ্ছিন্ন, ময়লা পোশাকযুক্ত অনাহার, অর্ধাহারে বিপর্যস্ত একদল মুসাফির ভাগ্যের অন্বেষণে পারস্য ছেড়ে হিন্দুস্তানের দিকে রওনা হয়েছে। তাদের হাতে নেই কোন টাকা, কোন খাবার। চলার পথে কোন গ্রাম পড়লে গ্রামবাসীদের কাছে ভিখারীর মত খাবার চেয়ে খেয়ে কোনমতে টিকে রয়েছে তারা।
এইরূপ অবস্থায় মরু পাড়ি দেওয়ার সময় দলের প্রধান কর্তা মির্জা গিয়াস বেগের গর্ভবতী স্ত্রী কোনরকম প্রসব বেদনা ছাড়াই এক কন্যাসন্তান প্রসব করলেন। তখন ছিল অমাবস্যার রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সদ্য জন্মানো শিশুটির গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বের হলো না। বের হবে কি করে! জন্মদাত্রী মা দীর্ঘদিন অভুক্ত থাকায় পেটের শিশুটি কোন খাবারই পায়নি। ফলে কাফেলার সবাই শিশুটিকে মৃত ভেবে ফেলে চলে যায়!
হিন্দুস্তানের অধিপতি তখন মুঘল-এ-আজম মহামতি আকবর। তারই এক রাজকর্মচারী ঠিক ঐ পথ দিয়েই রাজধানী আগ্রায় ফিরছিলেন। পরদিন প্রত্যুষে মরু বালুকায় কন্যা শিশুকে দেখে তুলে নেন তিনি। পথিমধ্যে সেই মরুযাত্রী দলের সাথেও তার দেখা হয়। তাদের দুঃখ, দৈন্য, দুর্দশা দেখে সম্রাট আকবরকে বলে রাজমহলে তাদের কোন একটা বন্দোবস্ত করার আশ্বাস দেন তিনি।
ভাগ্য সহায়! চাকরি পেয়েও যান মির্জা গিয়াস বেগ এবং এবং তার ছেলে মির্জা আসফ বেগ। স্বীয় যোগ্যতা, দক্ষতা, বিশ্বস্ততায় ধীরে ধীরে সম্রাটের আস্থাভাজন হতে থাকেন গিয়াস বেগ। এদিকে সেদিনের মৃতপ্রায় কন্যা শিশুটিও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। রূপে, জৌলুসে ভরপুর হতে থাকে সে। একটি পরিপূর্ণ গোলাপের ন্যায় প্রস্ফুটিত হতে থাকে আস্তে আস্তে মেহেরুন্নেসা।
অপরূপ রূপসুষমা ও বিশিষ্ট গুণের অধিকারীণি মেহের তার রূপলাবণ্যের বদৌলতে মোঘল হেরেমে জায়গা করে নেয়। শিল্পকলা, চিত্রকলা, সঙ্গীত ও উচ্চশিক্ষার পাঠদান নিতে থাকে সে মোঘল হেরেমের শিক্ষয়িত্রীদের কাছ থেকে। প্রেম সাম্রাজ্যের মহানায়ক শাহজাদা সেলিম(পরবর্তিকালের সম্রাট জাহাঙ্গীর) তখন সদ্য কৈশোর পেরুনো টগবগে তরুণ। বুকে তার উথালপাতাল প্রেমের ঢেউ খেলে সবসময়। একদিন সন্ধ্যায় তার নজরে পড়ে যায় সারা দেহে রূপের ঝংকার তোলা সদ্য প্রস্ফুটিত টকটকে লাল গোলাপের ন্যায় সুবাস ছড়ানো কিশোরী মেহেরুন্নেসা।
শাহজাদা থ’মেরে যায় কিশোরী মেহেরের রূপ দেখে। রীতিমত রূপের আগুনে ঝলসে যেতে থাকে সে। কোন মানুষ যে এত সুন্দর হতে পারে তা এই মেয়েটিকে না দেখলে বিশ্বাসই করতো না শাহজাদা সেলিম। যে করেই হোক, মেয়েটিকে একান্ত আপন করে পেতেই হবে। মোঘল হেরেমের বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটিকে কোনভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।
সেদিন সারারাত ঘুম হলো না যুবরাজ সেলিমের। পরদিন সোজা চলে গেল সে সাম্রাজ্যের রাজমহিষী, হেরেমের প্রধান কর্তী তার সৎ মা সলীমা বেগমের নিকট। কোন রকম ভণিতা ছাড়াই বলল, আমি মেহেরকে বিয়ে করতে চাই, আপনি আব্বাকে বলে ব্যবস্থা করুন। যথাসময়ে খবর পৌঁছল সম্রাট আকবরের কাছে। প্রমাদ গুণলেন মহামতি আকবর! হিন্দুস্তানের ভাবী সম্রাটের রূপের প্রতি এত দুর্বলতা থাকা উচিত না। রূপের মোহে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াও কাজের কথা নয়। তাছাড়া মেহেরুন্নেসার শরীরে কোন রাজরক্ত নেই। কোন অবস্থাতেই এই মেয়ের সাথে সেলিমের বিয়ে হতে পারে না।
বিচক্ষণ সম্রাট খুব সুকৌশলে মেহেরুন্নেসাকে মোঘল হেরেম থেকে বের করে দিলেন। ১৭ বছরের লাবণ্যময়ী কিশোরীকে বিয়ে দিলেন মোঘল সাম্রাজ্যের কর্মচারী পুরুষ সিংহ আলী কুলি খানের সাথে। তারপর তাকে পাঠিয়ে দিলেন আগ্রা থেকে বহুদূরে বর্ধমানে। কিশোরী মেহেরুন্নেসাও গেলেন স্বামীর সাথে পাহাড়ি অঞ্চলে। এদিকে শাহজাদা সেলিমকেও বিয়ে দিয়ে তার প্রেমের ফল্গুধারা পরিবর্তন করে দেন সম্রাট আকবর। কিন্তু শাহজাদার স্মৃতির মানসপটে তা রয়েই গেল অবচেতনে, অজান্তে।
ইতিমধ্যেই সম্রাট আকবর মারা যাওয়ায় ১৬০৫ সালে ৩৬ বছর বয়সে যুবরাজ সেলিম নুরউদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে ভারতবর্ষের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন, সুনিপুণ সামরিক অভিযান, সুশাসনের দিকে মনোযোগ দেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। অল্পদিনেই পুরো সাম্রাজ্যের প্রজা সাধারণের নিকট আস্থা, ভরসার প্রতীকে পরিণত হতে থাকেন তিনি। দেশশাসনে রাখতে থাকেন মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর।
এদিকে মেহেরুন্নেসাও শান্তিতেই বাস করছিলেন। ততদিনে তিনি আর কিশোরী নাই। রূপের সমস্ত আভা বিচ্ছুরিত করে পরিপূর্ণ যুবতীতে পরিণত হয়েছেন তিনি। তার একটি কন্যাও হয়েছে। মেয়েটিও পরমাসুন্দরী। তার স্বামী আলী কুলি খান তখন খালি হাতে বাঘ মেরে নতুন উপাধি ‘শেরে আফগান’ পেয়ে বর্ধমানের গভর্নর। দুর্দান্ত পৌরুষত্বের অধিকারী আলী কুলি খান ও অনিন্দ্য সুন্দরী মেহেরুন্নেসার সুখের সংসার। কিন্তু সুখ বেশি দিন কপালে সইলো না শেরে আফগানের। হঠাৎই বিদ্রোহ করে বসলেন তিনি।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে তাকে হত্যা করে তার স্ত্রী, কন্যাকে বন্দী করে মোঘল হেরেমে নিয়ে আসা হলো। হেরেমে এসেই সলীমা বেগমের নজরে পড়লেন মেহেরুন্নেসা। মুগ্ধ হলেন বৃদ্ধা সলীমা বেগম পূর্ণযৌবনা এক মোহিনী নারীকে দেখে। তার হেরেমে এই মেয়েটির মত এত সৌন্দর্য আর কারোই নাই। তারচেয়েও বেশি অবাক হলেন মেহেরের জ্ঞান, দক্ষতা, প্রজ্ঞা দেখে। বর্ষীয়ান রাজমহিষী স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এরকম প্রজ্ঞাবান নারীর মেধার বিকাশ কেবল সম্রাজ্ঞী হয়েই সম্ভব।
সুকৌশলে সম্রাটের নজরে আনলেন মেহেরুন্নেসাকে। সম্রাট জাহাঙ্গীর, যুবক বয়সের শাহজাদা সেলিম মেহেরকে দেখে জীবনে দ্বিতীয়বারের মত হতবাক হলেন। ১৫ বছর পূর্বের সেই স্মৃতি তার হৃদয়পটে ভেসে উঠলো। সম্রাট আবার প্রেমে পড়লেন। এবার আর কেউ তার প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি ভারতবর্ষের সম্রাট, চাইলে সবই পারেন!
দিনটি ছিল ২৫মে, ১৬১১ সাল। সালতানাতে মোঘলের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে মহা ধুমধামের সাথে বিয়ে হলো সম্রাট সেলিম ও মেহেরুন্নেসার। বিয়ের পর সম্রাট মেহেরের রূপ, গুণে মুগ্ধ হয়ে নাম দিলেন ‘নূরমহল’ মানে মহলের আলো। পরে দিলেন ‘নূরজাহান’ মানে জগতের আলো। ইনিই সেই নূরজাহান। মোঘল সালতানাতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারী ব্যক্তিত্ব।
পাঠক, আমরা ফিরে যাবো সেই অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে। যে রাতে এক মৃতপ্রায় কন্যা জন্মেছিল রুক্ষ মরুর বালুকাবেলায় সেদিনের সেই কন্যাই ৩৪ বছর পর পরিচিত পান জগতের আলোরূপে। প্রথমে রূপের গুণে মোঘল হেরেমে প্রবেশ। শেরে আফগানের মত সিংহ পুরুষের স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন। পরে পুরো ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী। তারপর তৎকালীন বিশ্বের আভিজাত্যপূর্ণ মোঘল হেরেমের একচ্ছত্র কর্তী। অতঃপর আকাশ হয়েছিল তার সীমানা!
ক্ষমতার উত্তাপ শক্তিবর্ধক! বলবর্ধক! ক্ষমতার উত্তাপে একসময়ের মৃতপ্রায় কন্যাটিই ধীরে ধীরে প্রভাবশালী নারীতে পরিণত হন। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে তার বাঘিনী রূপ! দরজার অন্তরাল থেকে সাম্রাজ্য শাসনে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন তিনি। সম্রাট জাহঙ্গীরের নূরজাহানে প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা, সারাক্ষণ আফিমে চুর হয়ে থাকা, সম্রাজ্ঞীর স্বীয় মেধা ও যোগ্যতায় হিন্দুস্তানের শাসনভার চলে যায় কার্যত নূরজাহানের হাতে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতে থাকেন পর্দার অন্তরালে থেকে। সম্রাট জাহঙ্গীর শুধু উপলক্ষ মাত্র।
সুকৌশলে ভাবী সম্রাট শাহজাদা খুররমের(পরবর্তিতে সম্রাট শাহজাহান) সাথে বিয়ে দেন আপন ভাই মির্জা আসফ বেগের কন্যা আর্জুমান্দু বেগমকে(পরবর্তিতে মমতাজ)। নিজ কন্যা লাডলী বেগমকে বিয়ে দেন শাহজাদা পারভেজের সাথে। এভাবেই সাম্রাজ্যে নিজ অবস্থান সুসংহত করেন তিনি।
কিন্তু হেরেমের কিছু নারীর কূটচালে তার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। বিশেষ করে পৃথ্বী নামের এক নর্তকী যার সাথে সম্রাটের ভালো খাতির ছিল হেরেমে পুনরায় নূরজাহানের প্রবেশের আগ পর্যন্ত তিনি সর্বদা নূরজাহানের ক্ষতিসাধনে তৎপর থাকেন। নূরজাহানের একান্ত ভক্ত, অনুরক্ত ভাবী সম্রাট শাহজাদা খুররমকে ধীরে ধীরে বিষিয়ে তোলেন নূরজাহানের প্রতি। কূটচালের এই বিষাক্ত ছোঁয়া সাম্রাজ্যের প্রধান উজির নূরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ও ভ্রাতা আসফ বেগকেও স্পর্শ করে।
তারাও নূরজাহানের একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিতে পারছিলেন না। একসময় তারাও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন নূরজাহানের। আর এসবের কলকাঠিই নাড়তে থাকেন পৃথ্বী নামের সেই নর্তকী। কিন্তু সেসবকে কোন পাত্তাই দিতেন না নূরজাহান। সম্রাট স্বয়ং তার হাতের পুতুল!
তবুও নূরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে একটা সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে ভাবী সম্রাটের সাথে দূরত্ব ঘুচিয়ে আনার বহু চেষ্টা চালান। কিন্তু ফল হয় উল্টো। ধীরে ধীরে নূরজাহানের প্রতি অবিশ্বাস, বিতৃষ্ণায় ছেয়ে যেতে থাকে শাহজাহানের মন।
এরই মধ্যে খোঁজা প্রহরীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় নর্তকী পৃথ্বীকে। পৃথ্বী মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তার মৃত্যুর সমস্ত দায় নূরজাহানের উপড় চাপিয়ে এক দীর্ঘ চিঠি শাহাজাহানের নিকট লিখে কূটচালের শেষ চাল দেন।
শাহজাহান চিঠির প্রতিটি বর্ণই বিশ্বাস করেন। নূরজাহানের কার্যের খেসারত যাতে তার জীবন দিয়েই দিয়ে যেতে হয় সেই পরিকল্পনা প্রণয়নে শাহজাহান হন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ!
(‘মোগল হেরেমের অন্তরালে’র কাহিনী এখানে শেষ। এরপর সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষের সম্রাট হন শাহজাহান। নূরজাহানের শেষ জীবন সুখের হয়নি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও উচ্চাভিলাষী এই নারী তার শেষ জীবন লাহেরে প্রিয়তম স্বামী সম্রাট জাহাঙ্গীরের কবরের পাশেই কাটিয়ে দেন। জাহঙ্গীরের মৃত্যুর পর তিনি আর কোনদিনই সালাতানাতে মোঘলের রাজধানীতে ফিরে আসেন নাই। ঐতিহাসিকগণের মতে সম্রাট শাহজাহানের কাছে অপমান বা প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ার ভয়েই তিনি আগ্রাতে আসেন নাই। প্রথমদিকে সম্রাট শাহজাহানও কোন জোরাজুরি করেন নাই। কিন্তু পরে হয়তো শাহজাহানের ভুল ভেঙ্গেছিল। অনেক চিঠি লিখেন তিনি নূরজাহানকে ফিরে আসার জন্য। কিন্তু নূরজাহান তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। শেষ পর্যন্ত ১৬৪৫ সালে ৬৮ বছর বয়সে লাহোরেই মারা যান এই মহীয়সী নারী।)
পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখেছেনঃ মাহমুদুল হাসান ফয়সাল