আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সঙ্গীতাঙ্গনে পীরবাদ; বিস্মৃত থাকছেন পীর ছাড়া বাকি সবাই

0
জেমস

জেমস তার সেরা গানগুলো কনসার্টে গান না। জেমসের সেরা গান কোনগুলো— এ নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। আপনার পছন্দের লিস্ট আমার সাথে মিলবে না—এটাই স্বাভাবিক। তবু আমার মনে হয়, জেমসের যে লিরিকনির্ভর গানগুলো—এই গানগুলো কখনো জেমসকে গাইতে শুনি না। জানালা ভরা আকাশ, প্রিয় আকাশী, যে পথে পথিক নেই—এই গানগুলো না শুনতে পাই কনসার্টে, না কোন টিভি প্রোগ্রামে।

কথা হতে পারে, কনসার্টে তো মানুষ যায় ঝাকানাকা গান শুনতে। জেমস মানুষের সেই ডিমান্ডকেই সার্ভ করেন মাত্র। প্রিয় আকাশী কি জমবে ওপেন এয়ার কনসার্টে? জমবে না। অন্তত দর্শকের তাই ধারণা। বা ব্যক্তি জেমসও হয়তো তাই মনে করেন।
জেমস

যে গানগুলো গেয়ে জেমস ‘জেমস’ হয়েছেন, যাদের লিরিকের উপর দাঁড়িয়ে জেমস একদিন নিজের আলাদা জাত চিনিয়েছিলেন—তাদের কাউকেই আমরা মনে রাখিনি। জেমস নিজেও হয়তো রাখেননি। ফান্টি, বাবু, শিবলি, দেহলভী—এদের কাউকেই এদের প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা দিতে পারিনি। কলকাতায় যে কাজটা কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত-রা মিলে করেছিলেন,এইখানে সেই কাজটাই শিবলি, দেহলভী আর মারজুক রাসেলরা করছেন। পর্দার আড়ালে থেকে। মারজুক তবু ফারুকীর সাথে ট্যাগড হয়ে নিজেকে চালিয়ে লাইমলাইটে রেখেছেন। বাকিদের তো ইউটিউবের ‘song description’ এও দেখা মেলে না।

চাই না, তবু বারবার ভারতের সাথে তুলনা দিতে হয়। যে লোক ‘প্রিয় আকাশী’ লিখতে পারেন, যে লোক ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’ লিখতে পারে,সেই লোক কি কোন অংশে জাভেদ আখতার বা গুলজারের চেয়ে কম? জাভেদ আখতার-গুলজারদের লাইফস্টাইল দেখেন আর আমাদের মারজুক-দেহলভীদের লাইফস্টাইল দেখেন। ওরা খালি গায়কদেরই পয়সা দিয়ে বড় করে নাই, লিরিসিস্টদেরও খাইয়ে পরিয়ে বাঁচায়া রাখসে। বড় বড় ফাংশানে ডাকসে। প্রাপ্য সম্মানটুকু দিসে। আমরা দেহল্ভীদের কী দিসি?

Ishtiak Islam Khan (যার লেখা থেকে এই লেখার অনুপ্রেরণা) এর বিবরণটাই প্রায় হুবহু তুলে দিচ্ছিঃ “জেমস ভাই’র স্টুডিও বা বাসায় প্রায় প্রতিদিনই একজন মধ্যবয়েসী চশমা পরা সাদাসিধে লোক এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকতেন। এতটাই সাধারণ সেই লোক যে সাতদিন মিটিঙে বসলে হয়ত একদিন কারো চোখে পরবে রুমের কোণায় একটা মানুষ বসে আছে। প্রতিদিন চুপচাপ দীর্ঘক্ষণ তিনি এভাবে বসে কাটিয়ে দেন, রাত হলে উঠে লোকাল বাস ধরে অফিস ফেরত ছাপোষা যেকোনো মানুষের মতই বাড়ি ফিরে যান। একদিন জানা গেলো, এই ভদ্রলোকই নাকি দেহলভী।”

জাভেদ আখতারদের কি লোকাল বাসে ঝুলে ঝুলে বাসায় যেতে হয়?

একটা ইন্ডাস্ট্রি আসলে এমনি এমনি বড় হয় না। সবাইকে দিয়ে থুয়ে খাইলে তবে সেটা বড় হয়। আমাদের এইখানে যেইটা চলে—সেটা স্রেফ পীরবাদ। এক পীরের পূজা করতে গিয়া আমরা দরগার বাকি লোকদের কথা ভুলে যাই। জেমসকে আমরা পীর মানি। জেমস কিন্তু পীর হইতে পারতেন না যদি না দেহল্ভীরা তার কণ্ঠকে ধারণ করতে পারে—এমন লিরিক না লিখতেন। জেমসের সেই কণ্ঠ তো আজও আছে। সেই তেজ, সেই ঝাঁঝ—আজও আছে। তাইলে জেমসের নতুন গান নাই কেনো? এই মানুষগুলো নাই বলে। এই অভিমানী মানুষগুলো দূরে সরে গেছে বলে।

বলছি না যে, এই মানুষগুলোকে ধরে রাখার দায়িত্ব একা জেমসের ছিল। ছিল আরো মানুষের। ক্যাসেট ব্যবসার টাকা যেই মানুষগুলোর পকেটে যেত—তাদের সবার। জেমসের যতোটুকু দায় ছিল—সেটুকু কি জেমস করেছেন? উত্তর—না, করেননি। আমাদের দেশে আমরা এক একজন হিমালয় পাই। সবাইকে ছাপিয়ে তিনি অনেক উঁচুতে উঠে যান। এতোই উঁচুতে যে সেই উচ্চতা থেকে নিচের মানুষদের আর দেখতে পান না তিনি। জেমস আমাদের সেই হিমালয়।

এমনই হিমালয় ছিলেন হুমায়ূন আহমদেও। তিনিও পারতেন আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে একটা এ্যাক্টিভ রোল নিতে। হুমায়ূন কখনোই সেটা নেননি। জনপ্রিয়তম লেখক হিসেবে বাংলাদেশের পাঠককে আরো লেখকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার একটা দায়িত্ব কিন্তু তার উপর বর্তায়। শহিদুল জহীর, মাহমুদুল হক—এদের সাথে পাঠকের একটা যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারতেন তিনি। হুমায়ূন নিজে এদের লেখা পড়েননি—এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পাঠক হিসেবে ভীষণ উঁচু মানের ছিলেন হুমায়ূন। এই কাজটুকু করলে হুমায়ূনের বইয়ের বিক্রি তো কমতোই না, বরং লোকে এক লেখকের পাঠক থেকে বহু লেখকের পাঠকে পরিণত হতে পারতো। আমাদের প্রকাশনা শিল্পের জন্যও সেটা ভালোই হত।

হুমায়ূন যেই জায়গাটায় ‘মানুষ’ হিসেবে আটকে গিয়েছেন, জেমসও সেই জায়গাটায় মানুষ হিসেবে আটকে আছেন। হিমালয়ের সম্মানটুকু পাচ্ছেন ঠিকই, হিমালয় হতে পারছেন না।

 

লেখকঃ আশফাক আহমেদ
পিএইচডি গবেষক, ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে