‘জানিবার গাঢ় বেদনা’- অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির ভেতর দিয়ে জীবনকে জানা কি সহজ?

0

জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ একটা ভৌতিক কবিতা-এইরকমই ভাবতাম আমি একসময়। তার একটা ইনিশিয়াল কারণ এই ছিল যে, ‘যখন গিয়াছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ’ নামে হুমায়ূন সাহেবের একখানা বই ছিল, অই বইয়ে সম্ভবত মাঝরাতে খুনাখুনিজাতীয় কিছু একটা ব্যাপার ছিল, প্রচ্ছদটাও ছিল কিছুটা ভৌতিক। আর ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা তখনও আমি পড়িনাই। এইজন্যে , অই কবিতা পড়ার আগে থেকেই লাইনটার প্রতি এক ধরনের প্রিজুডিস ছিল আমার মনে।

পরে যখিন কবিতা পড়লাম, আমি আরো ভয় পাইলাম। কিসব ভয়ংকর কথা!! কিছুই হয় নাই, প্রেম আছে, বউ আছে, টাকা আছে , যশ আছে-তাও সে জানালায় কান পাতে, আর ভয় বাইড়া যায় আরো, যখন শুনি জানালায় ‘উটের গ্রীবার মত’ অন্ধকার দাঁড়ায়ে আছে, থাকে। এই লাইন পড়ার পর বহুদিন জানালা খুলিনাই ঘুমের সময়।

কিন্তু এই কবিতার সবচাইতে আশ্চর্য, গুরুত্ববহ আর ভয়ের লাইন এগুলা না। লোকটা কেন আত্মহত্যা করল তার কারণ খুঁজতে কেউ কেউ ব্যর্থ হন, কেউ কেউ ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নিয়া ব্যাখ্যায় লিপ্ত হন, কেউ কেউ চইলা যান ‘বোধ’ কবিতার অব্যাখ্যাত বোধের কাছে! কিন্তু কেন লোকটা মরলো, তার একটা সরল নির্দেশিকা আছে অই কবিতার ভিতরেই, নিচের লাইনগুলাতে-‘কোনোদিন জাগিবে না আর/ জাগিবার গাঢ় বেদনার/ আবিরাম আবিরাম ভার/ সহিবে না আর-!’ এইসব কথা উটের গ্রীবার মত এক নিস্তব্ধতা তারে বলছিল।

এই যে, ‘জানিবার গাঢ় বেদনা’, ব্যাপারটা কী?? কিছু জানার ভিতরেও কি লুকায়ে থাকে ভয়ানক ব্যথার বিষাদ?? কিছু বোঝাও কি বোঝা হয়ে ওঠে আমাদের করোটির খোলের ভিতরে, যার অবিরাম ভার সহ্য করা একসময় আর সম্ভব হয় না? বোধ আর উপলব্ধি কি শীতের হাওয়ার মত ঝাঁপটে ধরে জীবনের যাবতীয় তরল উষ্ণতাকে (জীবনের লুতুপুতুমিকে)? কেন?? ইবনুল জাওযীর একটা লেখা পড়ছিলাম, উলুব্বুল হিম্মাহ। উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সেইখানে তিনি লিখছেন, যার যত বুদ্ধি কম, পৃথিবীতে সে তত সুখী। কথাটা ব্যাখ্যার দাবি করে। বিশেষত এইসময়ে, কারণ এইসময় বুদ্ধিমান না হইলে, ঢাকা শহরে থাকাই দুষ্কর, সুখী হওয়া তো দূর কি বাত!! কথা হইল, বুদ্ধি বলতে কী?? আইকিউ বা জিনিয়াসনেসের কথা উনি বলেন নাই। এইসব গার্হস্থ্য বুদ্ধি না থাকলে সুখী হওয়ার চিন্তা বাতুলতা। উনি যারে ‘বুদ্ধি’ বলছেন, আরবিতে তারে বলে হিকমাহ, বাঙলায় প্রজ্ঞা। হিকমত বা প্রজ্ঞা একদিনে অর্জিত হয় না। আমাদের এই জীবনের প্রত্যেকটা দিন বয়ে নিয়ে আসে নতুন চিন্তা, নতুন কথা, নতুন ব্যথা, নতুন শব্দ, নতুন অর্থ, নতুন স্বপ্ন, নতুন দুঃস্বপ্ন, নতুন দিন, নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন সম্পর্ক, নতুন সম্পর্কোচ্ছেদ!! এসবের ভেতর দিয়ে আমাদের ভিতরে জমা হয় একদিকে স্মৃতি, আরেকদিকে অভিজ্ঞতা। এই স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা সবাইরে সমানভাবে কি ছোঁয়?? নাহ। এই স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা ব্যাপারটা কেউ কেউ উপলব্ধিই করতে পারে না। স্মৃতি তাদের কাছে হয়ে ওঠে গার্হস্থ্য কর্মকাণ্ডেরই অংশ, যেন মনে রাখাটা সামাজিক কর্তব্য বইলাই মনে রাখা। কিন্তু কেউ কেউ স্মৃতির জানালার ধারে পেতে রাখেন স্বপ্নশয্যা, প্রচণ্ড শীতে জানালার কাচে যে বাষ্প জমা হয়, সেইখানে তারা দেখে প্রিয়জনদের নাম, তাদের মুখ! তারা জীবনের ভেতরে সর্বদাই জ্বালিয়ে রাখেন এক রঙিন মোমবাতি, সেই মোমের আগুনে পুড়ে পুড়ে তাদের সামনে স্বচ্ছ ও নিখাদ হয়ে ওঠে জীবনের যাবতীয় রঙ, তার যাবতীয় খাদ ও ভেজাল। তারা অনবরত উন্মোচন করে চলেন জীবনের রহস্য, স্মৃতি তাদের কাছে ভবিষ্যতের তালা খোলার প্রধান চাবিকাঠি! তাদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তাদেরকে প্রতিদিনই ঋদ্ধ করে তোলে, জীবন ও জগতের যাবতীয় বোধ প্রতিদিনই তাদের হৃদয়ে এসে জমা হয় খুব ছোট ছোট উপলক্ষের হাত ধরে, তারা জীবনকে উপলব্ধি করেন যেন শাশ্বত সেই জীবনেরই মুখোমুখি বসে!!

এই যে অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির ভেতর দিয়ে জীবনকে জানবার প্রক্রিয়া, এ বড় সহজ তো নয়। প্রতিদিন যেসব সত্য তিলতিল করে উন্মোচিত হয় জীবনের সামনে, যেসব মিথ্যা হঠাৎ করেই স্তব্ধ করে দেয় সময়ের প্রবাহ, যেসব অভিনয় একদিন খুব হালকাভাবে বাস্তবে ফিরে আসে, যেসব মুখ থেকে একদিন খসে পড়ে বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন, যেসব পরিস্থিতি জীবনকে করে হতবিহবল, এই এসবের নামই তো-জানা। জীবনকে জানা। এইভাবে ক্রমাগত জীবন খুঁটে খুঁটে, হৃদয়কে বুদ্ধির প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে জীবনকে যে জানা, তা তো চরমতম এক বেদনারই ব্যাপার। ইবনুল জাওযী একেই বলেছেন বুদ্ধি, এই বুদ্ধি সাধারণ গার্হস্থ্য মানুশের থাকে না, তাই তারা সুখী। য়ারা জীবনকে ভাবেন, এই জামাটা যেমন আমার, এই জীবনটাও তেমনি আমার, এভাবে। জামা আর জীবনের মধ্যে পুরোপুরি মিলই তারা পান, উভয়টিই তাদের মালিকানার জিনিশ। তাই জীবন ও জগত তাদের কাছে জামার মতই সরল।

জানিবার এই গাঢ় বেদনা যাদের জীবনকে আক্রমণ করে, তারা আর কখনোই সাধারণ মানুশের মত হতে পারেন না। শত সুখ, শত শান্তির ভেতরেও তাদের জীবনকে অধিকার করে রাখে হেমন্তের শিশির আর কার্তিক মাঠের চাঁদ, রমণীর বাহুবেষ্টনি থেকে তাদের ছিনিয়ে নিয়ে যায় উটের গ্রীবার মত নিস্তব্ধতা, কুয়াশা জানালার ধারে এসে তাদের গ্রাস করে এক অপার্থিব শীতে, যার অবিরাম ভার বইতে কেউ কেউ হয় অপারগ অক্ষম, আর কেউ কেউ অনবরত চেখে যায় জীবনব্যাপী এইসব বিপন্ন বিস্ময় ও জানার বেদনার স্বাদ।

 

লেখকঃ তুহিন খান

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে